সিডনি ম্যারাথনে অংশ নিতে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন একজন স্বপ্নবাজ বাঙালি নাসির শিকদার। আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিতব্য এই ম্যারাথনে তিনি ২৬.২ মাইল দৌড়াবেন। নিউইয়র্ক সিটি ম্যারাথন, বোস্টন ম্যারাথন, হ্যাম্পটন্স ম্যারাথন, মায়ামী ম্যারাথন ও ৫০ কিলোমিটারের দুটি আলট্রা ম্যারাথনসহ ১২টি ম্যারাথনে দৌড়েছেন তিনি মাত্র আট মাসে।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা এক সময়ের নাসির শিকদার এখন সারাবিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ম্যারাথনে অংশ নিয়ে। ম্যারাথন এখন তার জীবনের স্বপ্ন আর বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন।
নাসির শিকদারের বয়স যখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই তখন তার জীবনে বাসা বাঁধে নানারকম অসুখ-বিসুখ। হার্টের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, হাই কোলেস্টরল, পায়ের পাতায় জ্বালাপোড়া, ডায়াবেটিস, গ্যাস্টিকের প্রদাহ, অত্যধিক ওজন বৃদ্ধি, শক্তি কমে যাওয়াসহ নানাবিধ রোগের কারখানা তখন তার শরীরে। বেশিদিন আর বাঁচবো না-এই আতঙ্ক নিয়ে ছিল তার নিত্যদিনের বসবাস। মৃত্যুচিন্তা সারাক্ষণ ঘিরে থাকতো তাকে। এতোগুলো দৈহিক সমস্যায় ধীরে ধীরে কমে আসছিল তার কর্মস্পৃহা।
একটা স্থবির জীবনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে হঠাৎ একদিন তিনি অটোফেজি নিয়ে একটা ভিডিও পেলেন। যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপরই শুরু হয় তার ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম! তিনি শুরু করলেন স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা। বই, পত্রিকা, গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব ঘেঁটে তিনি সন্ধান করতে থাকলেন কীভাবে অবিসিটি মুক্ত হওয়া যায়! মৃতপ্রায় মনে তার জেগে উঠলো নতুন করে বাঁচার উদ্যম।
গবেষণালব্ধ জ্ঞান এবার নিজের ওপর প্রয়োগের পালা। তিনি শুরুতেই বদলে ফেললেন তার খাদ্যাভাস। ফিরে গেলেন ন্যাচারাল ফুডের কাছে! তিন বেলার আহার কমিয়ে দুই বেলা খাওয়া শুরু করলেন। ছয় মাস পর তার ওজন কমে গেল ১০ কেজি। শরীর একটু হালকা হলে তিনি নিজেকে দৌড়ের উপযোগী মনে করলেন। শুরু হলো তার দৌড়-জীবন! প্রথমে থেমে থেমে দৌড়াতে লাগলেন। তার এই হাঁটা-দৌড় চলতে থাকলো দিনের পর দিন। তখনও তার হার্ট দুর্বল। দৌড়ের জন্য উপযোগী নয়। কিন্তু তার পায়ে তো তখন দৌড়ের স্বপ্ন!
তাই তিনি শুরু করলেন হার্ট নিয়ে নানাবিধ পড়ালেখা। এবং খাবার থেকে বাদ দিলেন রান্নার তেল। রান্নায় তেলের বদলে যুক্ত হলো বিশুদ্ধ জল। তেল পুড়িয়ে রান্না বাদ দেওয়ার তিন মাস পর তিনি লক্ষ করলেন, তার হার্টের অসাধারণ পরিবর্তন। ৩ মাইলের দৌড় গিয়ে পৌঁছলো ৬ মাইলে। ছয়মাসে তার দৌড়ের দৈর্ঘ্য হলো ১০ মাইল। এভাবে হার্টের সাপোর্ট পেয়ে বছর না ঘুরতেই নাসির শিকদারের চোখে তখন ম্যারাথন দৌড়ানোর স্বপ্ন। পুরো ২৬ মাইলের দৌড়। ততদিনে তার ওজন কমে ৯২ কেজি থেকে ৭০ কেজিতে এসে দাঁড়িয়েছে। হার্টের পরিপূর্ণ সাপোর্ট পেয়ে, তিনি তখন দৌড়কে শুধু শারীরিক ব্যায়াম ভাবছেন না। দৌড়কে তিনি উপভোগ করছেন। তিনি দৌড়ে যাচ্ছেন, একই সঙ্গে লাইভে যুক্ত হচ্ছেন, কথা বলছেন, পা চলছে সমানতালে! প্রতিদিন তার নিজের সঙ্গে নিজের দৌড় প্রতিযোগিতা। একটু একটু করে আগের দিনের নাসির শিকদারকে ছাড়িয়ে যেতে লাগলেন।
তারপর এলো সেই ম্যারাথন স্বপ্নের পেছনে দৌড়ের পালা। তিনি নাম লেখাতে শুরু করলেন বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ম্যরাথন দৌড় ইভেন্টে! প্রথমে ডাক পেলেন স্যান ফ্রান্সিস্কো ম্যারাথনে! অবশ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৌড়ের আগে তিনি অনুশীলনের জন্য দৌড়ে নিয়েছেন আরো কিছু ম্যারাথন। এক সরকারি ছুটির দিনে তিনি শুরু করেছিলেন তার প্রথম ম্যারাথন। অনেক কষ্টে তিনি আট ঘণ্টায় এই দৌড় শেষ করেন! অথচ বর্তমানে তিনি তার অধিকাংশ ম্যারাথন শেষ করেন প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টায়!
ধীরে ধীরে তার ম্যারাথন দৌড়ের ঝুলিতে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক দৌড়মানচিত্র। নাসির শিকদার মনে করেন, মনে একাগ্রতা থাকলে মানুষ তার যে কোনো প্রতিকূল অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন একজন মানুষ দৌড়ের মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছেন নতুন জীবনের সন্ধান। তাই তিনি তার নিজের জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প ও অনুশীলন পৌঁছে দিতে চান আরো হাজারো মানুষের কাছে! তিনি অবিসিটি মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন।
স্বাস্থ্যসচেতন সমাজকর্মী নাসির শিকদার যিনি একসময় ওষুধনির্ভর জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন ওষুধহীন জীবনযাপনের পক্ষে এই আন্দোলন। নাসির শিকদার বলেন, ‘আমি জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে থেকে ফিরে এসেছি। সেখান থেকেই উপলব্ধি করেছি-ওষুধ নয়, অভ্যাসই বদলায় জীবন। শারীরিক চর্চা, সুষম খাদ্য আর সামাজিক প্রেরণা-এই তিনটিই স্বাস্থ্যবান জীবনের মূল চাবিকাঠি। আমি চাই, এ বার্তা যেন আরো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।’