৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৬:৫৫:৩১ পূর্বাহ্ন


অভিবাসী নয় যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল পাচারে প্রধান ভূমিকা রাখছে মার্কিন নাগরিকরাই
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৭-২০২৫
অভিবাসী নয় যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল পাচারে প্রধান ভূমিকা রাখছে মার্কিন নাগরিকরাই ফেন্টানিল


গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিলজনিত অতিরিক্ত মাদক গ্রহণের কারণে মৃত্যুর হার ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ২০১৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই মৃত্যুহার দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০২২ সাল, যখন ফেন্টানিল সেবনের কারণে প্রাণ হারায় ১ লাখ ৭ হাজার ৯৪১ জন মানুষ। ফেন্টানিল একটি অতিশক্তিশালী ব্যথানাশক ওষুধ, যা মূলত হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়। তবে এটি যখন অবৈধভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন তা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটিও এই মাদকের করাল গ্রাস থেকে রেহাই পায়নি। ইতোমধ্যে অনেক বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী ফেন্টানিলের ছোবলে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। যদিও ২০২৪ সালে এই মৃত্যুহারে কিছুটা হ্রাস লক্ষ্য করা গেছে, তবে ফেন্টানিল-জনিত সংকট এখনো যুক্তরাষ্ট্রে একটি বড় জনস্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে। এ প্রেক্ষাপটেই দীর্ঘদিন ধরে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বক্তব্যে অভিবাসীদের দায়ী করে আসছেন, যারা দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করছে বলে তার দাবি। ট্রাম্পের ভাষ্যে মাদক সংকট ও অভিবাসনকে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বলে উপস্থাপন করা হয়। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারি পরিসংখ্যানগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা ফেন্টানিলের অধিকাংশই সীমান্তের স্থল বন্দরগুলোর মাধ্যমে আসছে এবং এই চোরাচালানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাই প্রধান ভূমিকা রাখছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন (সিবিপি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যসেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ফেন্টানিল পাচারের সময় যেসব ব্যক্তি দক্ষিণ সীমান্তে ধরা পড়েছে, তাদের প্রায় ৮০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। বাকি ২০ শতাংশ ব্যক্তিরা অধিকাংশই ছিলেন ভিসা, বর্ডার ক্রসিং কার্ড অথবা অন্যান্য বৈধ ভ্রমণের অনুমতিপত্রধারী। এ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ফেন্টানিল সংকটের দায় অভিবাসীদের ওপর চাপানো এক ধরনের রাজনৈতিক অপপ্রচার এবং বাস্তবতার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।

২০২৫ সালের মার্চ মাসে দক্ষিণ সীমান্তের স্থল বন্দর দিয়ে দৈনিক গড়ে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার যাত্রী পার হয়েছেন, সঙ্গে ছিল দুই লক্ষাধিক ব্যক্তিগত যানবাহন ও হাজার হাজার বাণিজ্যিক ট্রাক ও কার্গো কন্টেইনার। এমন বিপুল পরিমাণ বৈধ চলাচলের ভিড়ে মাত্র ৫ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি ও ২০ শতাংশ বাণিজ্যিক গাড়িকে আধুনিক স্ক্যানিং প্রযুক্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ফলে চোরাচালানকারীরা সহজেই সীমান্ত অতিক্রম করে মাদক যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করাতে পারছে। ২০১৩-১৪ সালে ফেন্টানিল মূলত চীনে তৈরি হতো এবং ডাকযোগে কিংবা মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতো। কিন্তু ২০১৯ সালে চীন ফেন্টানিল উৎপাদনে কড়াকড়ি আরোপ করলে মাদক উৎপাদনের কেন্দ্রস্থান হয়ে ওঠে মেক্সিকো। সেখানে অবৈধ ল্যাবরেটরিতে চীনা রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয় ফেন্টানিল, যা পরে পাচারকারীরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করায়। যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন (সিবিপি) ২০১৫ সাল থেকে ফেন্টানিল জব্দের পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে শুরু করে। ওই বছরে জব্দকৃত ফেন্টানিলের পরিমাণ ছিল মাত্র ১০০ পাউন্ডের নিচে। ২০২৩ অর্থবছরে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ২৩ পাউন্ডে। যদিও ২০২৪ সালের পর থেকে জব্দের পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পেতে শুরু করে।

কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে প্রকাশিত ৭০০টির বেশি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মধ্যে ৭৫ শতাংশেরও বেশি ফেন্টানিল জব্দের ঘটনা ঘটেছে সীমান্তের স্থলবন্দরগুলোতে। মাত্র ১০টি ঘটনায় দেখা গেছে ফেন্টানিল পায়ে হেঁটে পার হওয়ার চেষ্টা করেছে কেউ। অর্থাৎ বাস্তবে পায়ে হেঁটে সীমান্ত পার হওয়া অভিবাসীদের মাধ্যমে ফেন্টানিল পাচারের ঘটনা প্রায় নেই বললেই চলে। সিবিপির সরকারি তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে ফেন্টানিল জব্দের ৯২ শতাংশই ঘটেছে সীমান্তের বন্দর এবং বর্ডার প্যাট্রোলের চেকপয়েন্টগুলোতে। এসব ঘটনার অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জড়িত থাকার প্রমাণ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যাম্পোতে রাত ৩টায় একটি পিকআপ ট্রাক থামিয়ে ২৫০ পাউন্ড ফেন্টানিল জব্দ করা হয়। চালক ছিলেন একজন মার্কিন নাগরিক এবং মাদক লুকানো ছিল তার গাড়ির গ্যাস ট্যাংক ও অতিরিক্ত টায়ারের ভেতরে। ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্ট আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০১৯ অর্থবছর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দক্ষিণ সীমান্তের বিভিন্ন বন্দরে ফেন্টানিল পাচারের দায়ে যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের ৮১ দশমিক ২ শতাংশই মার্কিন নাগরিক।

সাধারণত পাচারকারীরা পায়ে হেঁটে, ব্যক্তিগত গাড়িতে এবং বাণিজ্যিক ট্রাকের মাধ্যমে এ তিনটি উপায়ে ফেন্টানিল যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসে। এসব পদ্ধতি কখনো কখনো অত্যন্ত সৃজনশীল। ২০২৩ সালে নোগালেস বন্দরে একজনের শরীরের ভেতরে, আরেকজনের মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন অংশে এবং কারো জুতার ভেতরে ফেন্টানিল পাওয়া গেছে। ব্যক্তিগত গাড়িতে করে আনা ফেন্টানিলের পরিমাণ সাধারণত বেশি থাকে, যার পরিমাণ প্রায়ই ৫ পাউন্ডের বেশি হয়। সবচেয়ে বড় জব্দের ঘটনা ঘটেছিল একটি সবুজ শিমের চালানে, যেখানে প্রায় ৮০০ পাউন্ড ফেন্টানিল পাওয়া গিয়েছিল।

ফেন্টানিল পাচারে জড়িত ব্যক্তিরা সাধারণত তরুণ এবং অর্থনৈতিকভাবে অসহায়। যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত যেসব মার্কিন নাগরিককে ফেন্টানিল পাচারের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের গড় বয়স ছিল ৩০ বছর। ইউএস সেন্টেন্সিং কমিশনের ২০২৩ সালের তথ্যেও দেখা গেছে, যাদের ফেন্টানিল পাচারের দায়ে দণ্ডিত করা হয়েছে, তাদের ৮৬ দশমিক ৪ শতাংশই মার্কিন নাগরিক এবং গড় বয়স ৩৪ বছর। চোরাচালানকারী চক্র সাধারণত আর্থিক সংকটে থাকা তরুণদের টার্গেট করে। সহজে হাজার ডলার আয় করার প্রলোভনে এসব তরুণদের ফুসলানো হয়। একবার রাজি হলে, পাচারকারীদের মেক্সিকোতে নিয়ে গিয়ে মাদক হস্তান্তর করা হয় এবং কখনো কখনো গাড়িও দেওয়া হয়, যাতে করে সহজে সীমান্ত পার হওয়া যায়। এভাবে সীমান্ত পার হওয়ার সময় তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের নজরে পড়ে।

সর্বশেষে বলা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিলের মূল প্রবেশদ্বার হচ্ছে সীমান্তের স্থলবন্দরগুলো এবং এ মাদক পাচারের পেছনে প্রধানভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব নাগরিকরাই জড়িত। তাই মাদক সংকটের জন্য অভিবাসীদের দোষারোপ করা একেবারেই অবাস্তব এবং অনুচিত। সমস্যার কার্যকর সমাধানের জন্য বাস্তবভিত্তিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কাজ করা প্রয়োজন, রাজনৈতিক প্রচারণা ও ভুল ধারণা ছাড়া। সীমান্তে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাই হতে পারে এ সংকট মোকাবিলার সফল পথ। অতএব মাদক পাচারের জন্য নিরীহ অভিবাসীদের দোষারোপ বন্ধ করে সত্যিকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি।

শেয়ার করুন