৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৫:১৯:৫০ অপরাহ্ন


বাজেট ন্যায়ের প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে হয়ে ওঠে বৈষম্যমূলক
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-০৫-২০২৫
বাজেট ন্যায়ের প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে হয়ে ওঠে বৈষম্যমূলক


বাজেট যদি নাগরিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতিফলন ঘটাতে না পারে, তবে তা হয়ে ওঠে বৈষম্যমূলক। কিন্তু আমাদের পূর্বতন বাজেটে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতূল।

আজ ঢাকাস্থ সিরডাপ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে অংশিদারিত্ব ও জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬-এ তাদের বরাদ্দ নিয়ে অনুষ্ঠিত এক জাতীয় সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন।
 এতে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন মানবাধিকার কর্মী ও এএলআরডি-র চেয়ারপারসন খুশী কবির। 

প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক ড. খায়রুল চৌধুরী, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান এবং এএলআরডি-র শামসুল হুদা। এছাড়া আঞ্চলিক পর্যায় থেকেও অনেকে এই আলোচনায় অংশ নেন।  সেমিনারে গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইচডিআরসি-র গবেষক আসমার ওসমান বিষয়ভিত্তিক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।


উপস্থাপক আসমার ওসমান বলেন, এই বাজেট আলোচনায় সকলের অংশগ্রহণ রয়েছে। আমাদের পূর্বতন বাজেটে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতূল। আমাদের এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের পূর্বতন বাজেটগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কি ধরণের বরাদ্দ রেখেছেন এবং কতটুকু বরাদ্দ রাখলে ভাল হত।  গবেষণার ছয়টি লক্ষিত জনগোষ্ঠী পারিবারিক কৃষিসংশ্লিষ্ট মানুষ, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, নগর দরিদ্র, যুব সমাজ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের সাথে সম্পৃক্ত মানুষ।  গ্রামীণ নারী জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ প্রায় ৩৪ শতাংশ। যুব জনগোষ্ঠী ১৫-২৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ৩ কোটি ২৪ লক্ষ, যা মোট জনসংখ্যার ১৯%।  এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১ কোটি ১১ লক্ষ যুব শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা কর্সংস্থানের সাথে সম্পৃক্ত নন। বাংলদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত নয়। তাদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিস্তর আলাপ এবং মতানৈক্য রয়েছে। কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের সাথে সম্পৃক্ত মানুষ বাংলাদেশে বিশাল জনগোষ্ঠী-২০১৬ সালের গবেষণা অনুযায়ী, এরা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৩%; এবং রক্ষণশীল হিসাব ধরলেও কমপক্ষে ৭০% বা ১১ কোটি ৮৬ লক্ষ জন।  ২০২৪ সালে বাংলাদেশের নগর দরিদ্রের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৭ লক্ষ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৭.৫ %।  বাজেটের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায় এই ছয় বর্গের মানুষের বাইরে আরো কয়েক বর্গের মানুষের প্রতি অগ্রাধিকারভিত্তিতে গুরুত্ব দেয়া দরকার। যেমন- হিজড়া, দলিত জনগোষ্ঠী, চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠী, নদী-ভাঙা মানুষ এইসব বর্গের মানুষকে নিয়ে বাজেটের বরাদ্দ বিষয়ে পরবর্তীতে আরো গবেষণা এবং আলোচনা করা প্রয়োজন।


এসময় তিনি আরো বলেন, বাজেট যদি নাগরিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতিফলন ঘটাতে না পারে, তবে তা হয়ে ওঠে বৈষম্যমূলক। বাজেটের অঙ্ক বাড়ানো যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন ন্যায্যতা-ভিত্তিক অংশগ্রহণমূলক কাঠামো। বাজেট পরিকল্পনা, বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নের প্রতি ধাপে দরকার সংস্কার—যা একমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের দর্শনের ভিত্তিতেই সম্ভব। রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং গণমানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রকৃত-অধিকারভিত্তিক সমাধান সম্ভব নয়।

মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির বলেন, বাজেট প্রণয়নে আমাদেরও একটা অংশীদারিত্ব থাকা উচিৎ। এবারে পালার্মেন্ট নেই, বাজেট প্রণয়ন সরকার করবে। এই ধরণের বাজেট বিষয়ক আলোচনার মাধ্যমে আমাদের প্রয়োজনগুলো উঠে আসে। সরকার সবসময় যে আমাদের এই কথাগুলো শুনবে তা নয়, আমাদের এই কথাগুলো বলার চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। হয়তো একদিন আমাদের প্রয়োজনের কথাগুলো রাষ্ট্র শুনবে।
স্বাগত বক্তব্যে এএলআরডি-র উপ-নির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি সকলকে আয়োজনে অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ প্রদান করে বলেন, আলোচনা সভার প্রধান উদ্দেশ্য হল, বাজেটে জনগণের অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা এবং বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে অংশীদারিত্ব ও সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাবনা বর্তমান সরকারের কাছে প্রদান করা।

সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, বাজেট প্রণয়ণের ক্ষেত্রে নিয়ম-পদ্ধতি পরিবর্তন হওয়া দরকার। বাজেট প্রণয়ণের আগে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে যাওয়া দরকার, তাদের সাথে আলোচনা করা দরকার এবং বাজেটে সকল শ্রেণীর মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকা দরকার। বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে সুচিন্তিত বরাদ্দ রাখতে হবে, যাতে প্রান্তিক মানুষ স্বল্প ও প্রয়োজনে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করতে পারে। মানুষের কর্মশক্তি উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার প্রদানের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে, খেলাধুলার সরঞ্জামের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।
উন্নয়ন গবেষক মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, প্রান্তিকীকরণ বিষয়টি অনেক ধরণের বৈশিষ্ট্যের আদলে দেখার সুযোগ রয়েছে। জীবিকা, ভূমির অভাব, পরিচয় এবং নগর ও পরিবেশ ইত্যাদি নিরীখে প্রান্তিকীকরণের বিষয়টি আলোচনায় উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অস্তিত্বের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। যেমন- পাহাড়ী অঞ্চলে যারা আছে বম, মারমা তারা পরিচয় সংকটে আছেন, হিজড়া জনগোষ্ঠী নিজেদের পরিচয় সংকটে রয়েছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল এই সংকটগুলোকে চিহ্নিত করে উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা। মযার্দা ও ন্যায়ের প্রতিফলন বাজেটে থাকতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খায়রুল চৌধুরী বলেন, আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার, সামরিক সরকার এবং জনমতের সরকার দেখতে পেয়েছি। বর্তমান সময়ে জনমতের সরকারের প্রতিনিধিরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে কাজ করে আসছেন। এই জন প্রতিনিধিরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদাকে কিভাবে আসন্ন বাজেটে প্রতিফলিত করে তা অমরা দেখতে আগ্রহী। বিকল্প ভাবনার বাজেট যদি উপস্থাপন করা যেতো তবে বাজেট আলোচনা আরো ফলপ্রসূ হতে পারতো। উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে বাৎসরিক উন্নয়ন কর্মসূচী থাকে। তিনি উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ ও ব্যয়ের চিত্র নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করার প্রস্তাব দেন।

এএলআরডি-র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, আমরা অগ্রাধিকারভিত্তিতে বাজেটের সুপারিশগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, বিশেষ করে যেসকল খাতে আসন্ন বাজেটেই বরাদ্দ নিশ্চিত করা সম্ভব। তিনি আরো বলেন বাজেটে আমরা একটি যৌক্তিক অংশ বরাদ্দ চাই। তবে তা করতে হলে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি পর্যাপ্ত সময় নিয়ে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাজেটের সঠিক চাহিদাপত্র তৈরি করে তার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ দেয়া সম্ভব বলে মনে করেন। তিনি প্রত্যাশা করেন যে, জনগণের অংশীদারিত্বে জনমুখী বাজেট প্রণীত হবে, যেটি হবে জনগণের বাজেট।   


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, রাষ্ট্র মানুষ বানায় বিত্তবানের সম্পদ পাহারা দিতে । আমাদের রাষ্ট্র হল আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এটি জনগণের অর্জিত হলেও, জনগণের রাষ্ট্র হয়ে ওঠেনি। কারণ সংখ্যালঘুরা সংখ্যাশূন্য হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বরগুনায় বসবাসরত  রাখাইনদের তথ্য উল্লেখ করে বলেন, ৬০-৭০ হাজার রাখাইন এখন ২৩৫১ জনে পরিণত হয়েছে। আর ১০ বছর পরে রাখাইন শূণ্য হয়ে যাবে বলে আশংকা করছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে একজন চাকমা নারী ২-৩ টি সন্তানের বেশি নিতেন না, কিন্তু বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক পলিটিক্সের শিকার হয়ে বাঙালি সেটেলারের আগ্রাসনে এখন একজন চাকমা নারী ৭-৮ টি সন্তান গ্রহণ করছেন। যা নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের হুমকি। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, কাঠামোগত বাজেটের মাধ্যমে সংস্কার সম্ভব নয়, প্রয়োজন সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে বাজেট প্রণয়ন।  

অঞ্চলভিত্তিক আলোচনায় আফজাল হোসেন বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ে প্রান্তিক স্তরে কৃষকদের জন্য একটি কাঠামো থাকা জরুরি। এক্ষেত্রে তিনি কৃষক সমবায় কেন্দ্রিক ব্যবস্থা হতে পারে বলে উল্লেখ করেন।  


এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা বলেন, বাজেট হতে হবে তৃণমূল থেকে। যা কখনো হয়নি। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এবারের বাজেট বিভিন্ন কারণে গতানুগতিক হবে না। তাই আমি এই সেমিনারের আলোচনা ও সুপারিশগুলোর প্রতিফলন আসন্ন বাজেটে দেখতে চাই।  এসময় তিনি উল্লেখ করেন, উন্নয়ন আগ্রাসনের কারনে পাহাড়ী আদিবাসীরা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। যা প্রতিহত করার জন্য বাজেটে রবাদ্দ রাখতে হবে। বাঁশ-বেতের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পাহাড়ী আদিবাসী যুব সমাজের কর্মদক্ষতা বাড়াতে হবে।

পরিবেশকর্মী নাজের হোসেন বলেন, জাতীয় বাজেটের আকার প্রতিবছর বাড়ে, কিন্তু এই প্রস্তাবিত বাজেট ঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা এটা মূল্যায়নের সুযোগ রয়েছে। আমরা দেখি বাজেট প্রণয়নের আগে ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা করা হয় কিন্তু প্রান্তিক মানুষের সাথে আলোচনা হয় না। বাজেট প্রণয়নের এই প্রক্রিয়া পরিবর্তন হওয়া জরুরী।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন- সিলেটের কাশমির রেজা, সাতক্ষীরার খাদিজা আক্তার, জকিগঞ্জের জুবায়ের আহমেদ, কৃষ্ণপদ মুন্ডা, রফিকুল আলম, আকরাম হোসেন রুমি, রাজকুমার শাও, বিচিত্রা তির্কী, শন্তি বিজয় চাকমা, তনু হিজড়া ও পলি হিজড়া প্রমুখ।  


আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে অগ্রাধিকার সুপারিশমালা দেওয়া হয়। এতে বলা হয় গ্রামীণ নারীর জন্য বরাদ্দ কমপক্ষে ৪৩ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করতে হবে।  আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ কমপক্ষে ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করতে হবে, যার ৬০% সমতলের এবং ৪০% পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য নির্ধারণ করতে হবে।  নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ কমপক্ষে ২৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করতে হবে।   হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করতে হবে।  দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করতে হবে।  চা জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকা নির্ধারণ করতে হবে।  নদী-ভাঙা মানুষের জন্য বরাদ্দ কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকা নির্ধারণ করতে হবে।


শেয়ার করুন