বাংলাদেশকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ভারতীয়দের আকাশে! ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ সরকারের গণঅভ্যুত্থানে পতনের পর যে ভ্রু কুঁচকেছে ভারত, সেটা এখনো ওই পর্যায়েই। স্বাভাবিকই হতে পারছে না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বোভৌম দেশ। কিন্তু এটা যেন শুধু কাগজে কলমেই থাকবে। বাস্তবে বাংলাদেশের সবকিছুর মাতব্বরিটা ভারতই করবে। বাংলাদেশও তার ভালো-মন্দ যেন ভারতকে জিগ্যেস করে অনুমতি নিয়েই করতে হবে।
মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাতেও এমন দাদাগিরি চলছিল। সেখানকার মানুষ মুক্ত হয়েছে। এরপরই ভারতের সন্দেহ ছিল বাংলাদেশও ওইভাবে হাতছাড়া হয়ে-না যায়। সে জন্যই ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনটা বিশ্বের গণতন্ত্রমনা সব দেশকে সাইট করে ভারত তার ইচ্ছেমত এক তরফা করার সুযোগ করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন এমনভাবে করে যে বিরোধী কোনো দলও পাচ্ছিল না। ফলে নিজ দলের একজনকে ডামি-বিরোধী দল বানিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বিপুল আসনে জয়লাভ করে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পদদলিত হয়।
ভারত যাদেরকে ওই ফরমুলায় নির্বাচন করিয়ে নিজের পছন্দের সরকার তৈরি করে নিজের কব্জা করে রাখে, সেখানে আর ভিন্নমত আসবে কোত্থেকে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন শেখ হাসিনা ও ভারতের সেই সাজানো সংসার তছনছ করে গণঅভ্যুত্থান ঘটায়। সে থেকেই বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না ভারতীয়দের। ভ্রু কুঁচকে যায়, কীভাবে কী হলো সেটা ঠাহর করতে ব্যর্থ হওয়ার লজ্জায়। শেখ হাসিনাকে নিজ দেশে আশ্রয়ই শুধু নয়, হাজারো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঠাঁই দিয়ে উদারতা দেখায়। পাশাপাশি সেই ৫ আগস্টের পর থেকে যা যা তারা করেছে, সে বর্ণনা এখন আর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দুদণ্ডও শান্তি দেয়নি তারা বাংলাদেশের মানুষকে ও উপদেষ্টা পরিষদকে। বহু ইস্যুতে উত্তপ্ত করার চেষ্টা চলে। বাংলাদেশের মানুষও পরিস্থিতি বুঝে শান্ত থেকে ভারতের পাতা ফাঁদে দেয়নি পা। সর্বশেষ যে পরিস্থিতি তারা করেছে কলকাতা ও আগরতলায়। বাধ্য হয়ে দুই উপ-হাইকমিশনকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। এ হাইকমিশনে হামলা, পতাকায় আগুন, লুটপাটও বাংলাদেশের মানুষ শান্তভাবে হজম করেছে। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কাল্পনিক ও মিথ্যা সব ঘটনা তৈরি করে প্রচারে ব্যস্ত বিশ্ব মিডিয়ায়। পরিস্থিতিটা এমন পর্যায় চলে গেছে যে, বাংলাদেশের উপদেষ্টা পরিষদ তটস্থ। সংখ্যালঘু নির্যাতনের কার্ড এখনো চালাচ্ছে ভারতীয় মিডিয়া। এতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আছে কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ হলেও তাদের মিডিয়াকে এমন অপপ্রচার রোধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি শতবার আন্তর্জাতিক মিডিয়া ফ্যাক্টচেক করে ভারতের মিডিয়ার মিথ্যা তথ্য প্রকাশের তথ্য প্রকাশের পরও।
ভারত সরকার ওই মিথ্যা সব তথ্য বিশ্বাস করেই যাচ্ছে যার প্রমাণ মমতা ব্যানার্জি ও সর্বশেষ ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্য। নানাভাবে ভারত বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণকে হয়রানির চেষ্টা করে, ভিসা প্রদান বন্ধ, আমদানি রফতানিতে বিঘ্ন ঘটিয়ে। বাংলাদেশ বাধ্য হয়ে পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানির উপায় খুঁজে বের করে। একই সঙ্গে ইউরোপের অনেক দেশে বাংলাদেশের ছাত্র ও শিল্পপতিদের ভিসা নিতে দিল্লিতে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া সেটাও ভারতীয় ভিসা না দেওয়ায় চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা তাইতো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭ দেশের কূটনীতিবিদদের ঢাকায় আমন্ত্রণ করে তাদের সঙ্গে সোমবার তেজগাঁওস্থ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বৈঠক করে। কিন্তু অনেকটাই ঠিক ওইদিনই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জরুরি এক সফরে আসেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক বিশেষ বিমান নিয়ে। বৈঠক করেন পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে। দেখাও করেছেন তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। ৫ আগস্টের পর এটাই প্রথম কোনো ভারতীয় কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফর। কিন্তু প্রশ্ন পররাষ্ট্র সচিবের এমন একটা দিন বেছে নিতে হবে যেদিন ইইউর ২৭ দেশের কূটনীতিকরা যখন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করতে ঢাকা পা রেখেছেন। কিছুটা রহস্য তো আছেই। কী বলতে কী বলে ফেলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস হয়তো সেটা এড়াতেই অনেকটা নমনীয়তা প্রদর্শন করে ভারত ওই কর্মকর্তার জরুরি ঢাকায় আগমন।
প্রফেসর ইউনূসও ছাড় দেওয়ার মানুষ নন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তারও বিচরণ কম নয়। কোথায় কীভাবে কাকে দমাতে ব্যবহার করতে হবে, সেটা তার চেয়ে কে ভালো জানবেন! প্রধান উপদেষ্টা ক্লিয়ার করেই বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু যেমনটা সংখ্যালঘু ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া প্রচণ্ড রকম প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রফেসর ইউনূস ইইউর কূটনীতিবিদদের সহায়তা কামনা করেছেন। তিনি এ-ও বলেছেন, যে বিভিন্ন দেশের মিডিয়াকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কী ঘটছে, সেটা দেখতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বারবার। এখানে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান সব ধর্মের মানুষের। তবুও মিথ্যা প্রচারণা উদ্দেশ্যমূলক। এটাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
ফলে এটা বড় ধরনেরই এক অভিযোগ, ইইউর কাছে বাংলাদেশের। একই সঙ্গে আরো একটা অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ভারতীয়দের ভিসা দেওয়া সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বাংলাদেশিদের জন্য আপনাদের দেশের যে ভিসা প্রদান সেন্টার, সেখানে বাংলাদেশের ছাত্ররা, শিল্পপতিরা যেতে পারছেন না। এতে তাদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন, এমনকি ব্যবসায়ীদেরও ক্ষতিসাধন হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য ভিসা প্রদান কার্যক্রম হয়, বাংলাদেশে নতুবা পার্শ্ববর্তী অন্য কোনো দেশে স্থাপন করে দিন। এ অভিযোগ বা আবেদনটাও একরকম বড় ধরনের অভিযোগ যে ভারত নিরীহ মানুষকে প্রয়োজনীয় ভিসা প্রদানে কারসাজি করছে, যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ।
জানা গেছে, প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় ওই আলোচনা। যেখানে সব দেশের কূটনীতিক খোলামেলা আলোচনা করেন। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসও বিভিন্ন সহায়তা চান ও একই সঙ্গে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার যে গণঅভ্যুত্থান সে ব্যাপারে ক্লিয়ার ধারণা দেন। একই সঙ্গে ওই সময়ের নানা ঘটনা ও শেখ হাসিনা সরকারের নানা দুর্নীতি ও লুটপাটসহ নানা স্বৈরাচার কর্মকাণ্ডেরও বর্ণনা দেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব ডেলিগেশন মাইকেল মিলার। বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলে ১৯ জন সদস্য ছিলেন। অন্যান্য ইস্যুর মধ্যে ছিল বাণিজ্য সুবিধা, জলবায়ু পরিবর্তন, সংখ্যালঘু ইস্যু, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে উভয়ের অঙ্গীকার ও করণীয় ইত্যাদি।
এ নিয়ে এক ব্রিফিংয়ে কূটনীতি বিভাগের মহাপরিচালক রফিকুল আলম জানিয়েছিলেন, ইইউর ২৭ দেশ ছাড়াও আরো একটি দেশের রাষ্ট্রদূত অংশগ্রহণ করবেন এ বৈঠকে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৩টি ইউরোপীয় দেশের দূতাবাস রয়েছে।