৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:২৯:১৮ অপরাহ্ন


সংস্কার না নির্বাচন কোনটা আগে?
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-১০-২০২৪
সংস্কার না নির্বাচন কোনটা আগে? মুক্তিযুদ্ধকালীন পতাকা


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে নিহতের চূড়ান্ত সংখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি। চেষ্টা চলছে। খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে এক হাজার পাঁচশত জনের নাম। এতগুলো নিহতের সাথে পঙ্গুত্ব বরণের সংখ্যা কয়েক হাজার। ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ক’দিন হলো, আঙ্গুলের কর টিপে বলতে পারবেন। কিন্তু এত বিশাল পরিমাণ ছাত্র জনতার আত্মত্যাগ এখন মূল আলোচনায় নেই। মাঝে মধ্যে রেফারেন্সে উঠে আসে আবু সাঈদের নাম। মুগ্ধ’র নাম। অন্য যে আরো দেড় হাজার নিহত, এদের মধ্যে ১০ জনের নাম বলতে বলা হয়, কোনো উপদেষ্টা, রাজনীতিবিদ, সুশীল বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। 

এ আত্মত্যাগের ইতিহাস এখন আড়ালের পথে। স্মৃতিতে। বাস্তবে নেই। এখনও খবরের কাগজে চোখ রাখলে দেখা যাবে আন্দোলনে গুলি খাওয়া কেউ কেউ মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করছেন। ভ্রুক্ষেপও নেই। আহতরা কাতরাচ্ছেন। অন্তত একটু চিকিৎসার আবদার। অনেক নিহতের পরিবারের আহাজারি, কেউ খবর নিতে আসেনি। সাহায্য সহযোগিতা তো দূরে থাক। এমনিতে বাচ্চা বা স্বজন হারানোর বেদনা। এরপর কারোরই খবর না নেয়া ওসব পরিবার অন্যরকম এক অপমান, যন্ত্রণা মনে করছেন। 

ভুলতে বসেছেন অনেকেই গণঅভ্যুত্থানে পরাস্ত হওয়া দীর্ঘ ১৬ বছর শাসন করা আওয়ামী লীগের অপকর্মের কথা। দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে, সেগুলো কিভাবে উদ্ধার করা যায় বা তা নিয়ে কারোর আফসোস শোনা যায় না। দীর্ঘ ১৬ বছরে যে আওয়ামী লীগ বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন ও আয়না ঘর বানিয়ে বছরের পর বছর আটকে রেখে অনেক ভিন্ন মতের মানুষের প্রতি নির্মম অবিচার, অত্যাচার করেছে, সেগুলো এখন অদৃশ্য। 

বিগত সরকারে থাকা মন্ত্রী, এমপি, আমলা থেকে শুরু করে বহু লোক দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে, পাচার করে অন্যায় করেছে তাদের যে শাস্তির আওতায় আনতে হবে- এ দাবি নেই। তাদের আটক করতে হবে এটা কেউ এখন আর বলে না। এদের ৯৮% দেশে ছিলেন শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পরও। কিন্তু বিপুল সংখ্যক শীর্ষ নেতা, মধ্যম সারির, নিচের সারির নেতা কোথায় গেলেন- হদিস নেই। দেশে আছেন না পালিয়ে গেছেন। সেটাও কারোর জানা নেই। অবাক করার বিষয় এদের কারো কারো অমুক স্থানে রয়েছেন, তমুক স্থানে রয়েছেন এমন গুঞ্জনে সেখানে আইনশৃংখলাবাহিনী গিয়ে ঘেরাও নাটক করছেন। কিন্তু একজনকেও সেখান থেকে আটক করতে পারছেন না। এটা দিয়ে প্রশাসন বুঝানোর চেষ্টা করছে যে তারা অপরাধি বা অপরাধীর দোসরদের আটক করতে আন্তরিক। 

আসলে সাধারণ জনগণ বা প্রশাসনে এ বিষয়গুলোতে অজ্ঞাত এক নীরবতা। কী ঘটেছে। কোথায় একটা রফাদফা হলো, কেউ জানে না। ভেতরে ভেতরে কিছু একটা না ঘটলে এসব অপরাধি যারা সহস্রাধিক খুনের সঙ্গে জড়িত তারা কিভাবে হাওয়া হয়ে গেছে। পুলিশের অলোচিত সেই বাক্তিত্বগণ উধাও। যাদের অতি উৎসাহী মনভাব ও হুমকিতে বিরোধী দলসমূহের উপর জুলুম নির্যাতন হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ গড়ারও আছে ভয়ানক অভিযোগ। সবই আড়ালে চলে গেছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাজারে এখন একটাই কথা ‘নির্বাচন’। কবে হবে জাতীয় নির্বাচন। প্রফেসর ইউনূস বা প্রধান উপদেষ্টা কবে দেবেন সেই নির্বাচন এ আলোচনায় এখন সর্বত্র। মানুষের, রাজনীতিবিদদের যেন আর তর সইছে না। সেটা সব দলেরই। আর অন্তর্বর্তী সরকার তাদের উপর নির্বাচনী প্রেসারে বিগত সরকারের বিরুদ্ধে যে কিছু অ্যাকশন নিতেন সেগুলো বেমালুম ভুলে গেছেন! বা সময়ও পাচ্ছেন না। 

প্রধান উপদেষ্টা একটা সংস্কারের রুপরেখা নিয়ে আলোচনা করছেন। সংস্কার করতে ইতিমধ্যে ৬টি কমিশনও গঠিত হয়েছে। এটা ভবিষ্যতে যাতে দেশে এমন অরাজকতা না করতে পারে সে প্রটেকশন। কিন্তু অপরাধীদের কী হলো। একটা কথা এখন স্ট্যাবলিশ হয়ে গেছে যে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে আটক বা অপরাধিও বলা যাবে না। এ টেকনিকে বেঁচে যাচ্ছেন অপরাধিরাও। নির্বাচন হয়ে গেলে বোঝাপড়ার মাধ্যমে তারা স্বভূমিকায় ফিরবেন এটা আর বলার কি। 

প্রশ্ন উঠছে যে সংস্কারে হাত দিয়েছেন, ওগুলো আদৌ হবে কি না। অবশ্য উপদেষ্টা পরিষদ গঠনই যেখানে একটা অসাংবিধানিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের করা সংস্কার কতটা গ্রহণযোগ্য হবে সেটাও আলোচনায়। সংবিধান আগেরটাই বহাল। যথাযত মানা হচ্ছে সেটা। কিন্তু তাতে নেই অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সিস্টেম। দেশে বিরাজমান অন্তর্বর্তী সরকার। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মীরা প্রথম দিকে ভীষণ ভড়কে গেলেও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তোলপাড়ের সুবাদে তারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ দেখছে। 

এখন যে প্রশ্নটা জনমনে যে সংস্কারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল আওয়ামী লীগ ছাড়া আর সবাই। সে সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার হাত দিলেও সেটা শেষ করতে পারবেন তো! 

সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনে যারা রয়েছেন, বহু আলোচনা গবেষণা করে এটা যথার্থভাবে জনগণের পছন্দসইভাবে দাঁড় করাতে বেশ সময় লাগবে। এরপর নির্বাচন সেটা বলছেন প্রধান উপদেষ্ট। কিন্তু কতদিন?

যার একটা রূপরেখা সেনাপ্রধান ইতিমধ্যে বলে দিয়েছেন। ১৮ মাসের মত। এ সময়ে সংস্কার হয়ে নির্বচানটা অনুষ্ঠান করা যাবে বলে সেনা প্রধান আশা পোষণ করেছেন। আপাতত এটাই অন্তর্বর্তী সরকারের মতের প্রতিফলন হিসেবে ধরে নেয়া হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টার তরফ থেকে তার প্রেস সেক্রেটারিও যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, সংস্কার শেষে সব দলের তথা জনগণের দেয়া সময় অনুসারে নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করবেন। তবে তিনি একটি সাক্ষাতকারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, সংস্কারের ১৮ মাস পর নির্বাচন। বার বার যে রূপরেখা বা রোডম্যাপ চাচ্ছে রাজনীতির বিভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে সেগুলোর জবাবেই ওই উত্তর। কিন্তু এটাকে দীর্ঘতম সময় মনে করছেন রাজনৈতিক দলসমূহ। এবং সংস্কারসমূহ অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক যথার্থ হবে না বলেও অভিমত। ফলে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকার এসব সংস্কার করবেন বলে মত প্রকাশ করছেন তারা। 

সদ্য দেশে ফিরলেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বনেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা হয়েছে। এতে লক্ষ্যণীয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জোয়ে বাইডেনের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের ঘনিষ্ঠ পরিবেশে বৈঠক। প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে সফরে যাবার আগেও ডোনাল্ড লুসহ যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ এক দল কর্মকর্তা সফর করে গেছেন। সব মিলিয়ে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাবার পর যে একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছিল বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় সে দুশ্চিন্তা আপাতত কেটে গেছে। অভ্যন্তরীণ বিষায়াদিও দ্রুত সমাপ্তি ঘটবে বলেও উপদেষ্টারা মনে করেন। 

কিন্তু মানুষের মনে স্বস্তি প্রয়োজন। যেটা নানা কারণে আশ্বস্ত হতে পারছেন না তারা। রাজনীতিবিদরা তাদের স্বভাবসূলভ একটা চাপ তারা দিয়ে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর মধ্যেই দ্রুত সময়ের মধ্যে উপদেষ্টারাও তাদের কর্মগুলো সম্পাদন করবেন। তবে সমস্যা এ উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে। 

গণঅভ্যুত্থানের পর যে সরকারটি রাষ্ট্রের দায়িত্বটা নিয়েছে তাদের মুড হওয়া উচিৎ বেশ চটপটে বা তড়িৎ গতির তথা অ্যাটাকিং। কিন্তু বেশিরভাগ সুশীল সমাজের লোকজন নিয়ে এমন উপদেষ্টা পরিষদের ঢিলেতালের কর্মে যাদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হলো তারা দাঁড়িয়ে যাবার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে বলে জনমনে কষ্ট জাগছে। মামলা মকদ্দমা কম হয়নি। কিন্তু ধরপাকড় নেই অজ্ঞাত কারণে। এতে মানুষের মধ্যে সন্দেহ বাড়ছে। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে যে দলটিকে হটানো হলো সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও কী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে এমন প্রশ্ন এখন সর্বত্র। 

সংস্কারে সময় লাগুক। নির্বাচন হোক। কোথাও সমস্যা নেই। কিন্তু দীর্ঘ ১৬ বছর একক ক্ষমতা বলয় তৈরি করে চেপে বসা দলটি আবারও পুনর্বাসিত হয়ে গেলে সেটা ছাত্র জনতার রক্তের সঙ্গে বেইমানী হবে বলে শহীদ ও আহতদের স্বজনেরা মনে করেন। 

শেয়ার করুন