১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০১:৪২:৩৮ পূর্বাহ্ন


নানা সমীকরণ
জাতীয় পার্টিও কি আ.লীগের মতো নিষিদ্ধ হবে?
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৯-২০২৫
জাতীয় পার্টিও কি আ.লীগের মতো নিষিদ্ধ হবে? ভাঙচুর করা জাতীয় পার্টির অফিস


আওয়ামী লীগের পর এবার জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি উঠছে জোরেশোরে। তবে এ প্রক্রিয়ার জোরালো ভূমিকায় নেই বিএনপি। ২৯ আগস্ট রাজধানী ঢাকায় গণঅধিকার পরিষদ এবং জাতীয় পার্টির কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরে গণঅধিকার পরিষদের সমাবেশে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হামলায় দলটির সভাপতি নুরুল হক নুরসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। সে থেকে নুরু হাসপাতালের কাতরাচ্ছেন। 

সেদিন রাতেই ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর এমনকি আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ৩০ আগস্ট এক প্রতিবাদ সমাবেশে জাতীয় পার্টিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিষিদ্ধ করা, নুরের ওপর হামলার ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা এবং হামলার ঘটনার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগের দাবি তুলেছে গণঅধিকার পরিষদ। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেওয়া না হলেও অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জাতীয় পার্টি ‘নিষিদ্ধের আইনগত দিক খতিয়ে দেখার’ কথা বলেছেন। জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে ওপর দলটির ওপর চাপ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী নিজেও এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি এমন কোনো কাজ করেনি যা দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার মতো। 

গত ৭ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে গেলে এই ইস্যুতে আন্দোলন তৈরি হয়। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ ছিল, পরিকল্পিতভাবে আবদুল হামিদের দেশত্যাগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যাতে তার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়। এরপরই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে এনসিপি, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন। ১০ মে এক নির্বাহী আদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই দল এবং দলটির অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু থাইল্যান্ড থেকে চিকিৎসা শেষে এক মাস পর ৮ জুন দেশে ফিরে আসেন আবদুল হামিদ। এরপর তাকে গ্রেফতার বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া নিয়ে আর উল্লেখযোগ্য কোনো দাবি ওঠেনি।

জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রেও অনেক বিশ্লেষকই একই ধরনের আবহ তৈরি করা হচ্ছে বলে মনে করছেন। নুরুল হক নুর যে হামলায় মারাত্মক আহত হয়েছেন। কিন্তু সেই সুযোগকে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধে চাপ বাড়ানোর কাজে লাগানো হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

গণঅধিকার পরিষদসহ আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ জানিয়েছে। তারা মনে করছেন, তাদের ইন্ধনেই নুরের ওপর হামলা হয়েছে। ওই ঘটনার পর বিভিন্ন জেলার পর ৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকার কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও হামলার ঘটনা ঘটেছে।

গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসান বলেন, জাতীয় পার্টি ফ্যাসিস্টের দোসর। তারা পতিত হাসিনা সরকারের অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছে। তাদের অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে। আমরা সরকারকে আমাদের দাবি জানিয়েছি। জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে আমরা আন্দোলন আরো জোরদার করবো।

তার অভিযোগ, জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। এজন্যই নুরের ওপর হামলা করা হয়েছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী এ কাজ করেছে। সরকারও এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই জাতীয় পার্টিকে আর দেখতে চাই না। এরা আওয়ামী লীগের বি-টিম। তারা আওয়ামী লীগের পুতুল।

এনসিপিও জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করবে জানিয়ে সংগঠনটির যুগ্ম-আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, জাতীয় পার্টি ভারতের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের কাজে নেমেছে। জিএম কাদের ভারতে গিয়ে সে বৈঠকই করে এসেছেন। কিন্তু সেটা হতে দেওয়া হবে না। জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করতে হবে।

তিনি বলেন, নুরুল হক নুরের ওপর হামলা জাতীয় পার্টিকে সহায়তারই অংশ। একটি মহল জাতীয় পার্টির হয়ে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। কিন্তু তারা ফ্যাসিবাদের দোসর। তাই শুরু থেকেই আমরা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি দুইটি দলই নিষিদ্ধের দাবি করে আসছি। সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করলেও জাতীয় পার্টির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি। কিন্তু নিতে হবে।”

জাতীয় পার্টির নিষিদ্ধের ব্যাপারে এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ সোচ্চার থাকলেও বিএনপি তেমন কোনো কথা বলেনি। তবে জামায়াতে ইসলামীও এনসিপির মতো নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে। 

জামায়াত ইসলামী 

আওয়ামী লীগের মতো জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। রোববার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যমুনায় বৈঠক শেষে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের তাদের এ দাবির কথা বলেন। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে বলেছি, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সহযোগী ছিল জাতীয় পার্টি। যেভাবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার চার দিন আগে ২০২৪ সালের ১ অগাস্ট নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকার দলটির ওপর থাকা সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ২৮ অগাস্ট।

এরপর চলতি বছর জানুয়ারিতে আদালতের আদেশে এক যুগ পর রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন ফিরে পায় জামায়াত।

অন্যদিকে আন্দোলনের দাবির মুখে অন্তর্বর্তী সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে চলতি বছরের মে মাসে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়।

গত শুক্রবার রাতে জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সংঘর্ষ ঘিরে যৌথবাহিনীর লাঠিপেটায় গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের দাবি ওঠায় রাজনৈতিক অঙ্গনে আবার উত্তাপ দেখা দিয়েছে।

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ 

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আমরা মনে করি, জাতীয় পার্টির (জাপা) কোনো অধিকার নেই বাংলাদেশের রাজনীতি করার। জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছিল দলটি। ৩১ আগস্ট রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গণধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে দেখতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেন নাহিদ। 

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের সংস্কার হবে, নির্বাচন হবে ও নতুন সংবিধান হবে। এটা জনগণের কাছে আমাদের প্রতিশ্রুতি।

এ সময় নাহিদ ইসলামের সঙ্গে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে চীন সরকারের আমন্ত্রণে পাঁচদিনের সফর শেষে রোববার রাতে দেশে ফেরেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের প্রতিনিধিদল। এরপর সরাসরি তারা ঢামেক হাসপাতালে চলে যান।

অ্যাটর্নি জেনারেল 

এদিকে গত শনিবার ঝিনাইদহে এক অনুষ্ঠানে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানকে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন। জবাবে তিনি বলেন, যদি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হতে পারে, জাতীয় পার্টি কেন পারবে না? জাতীয় পার্টি ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছে। রক্ত নিয়ে খেলেছে। 

তিনি আরো বলেন, জাতীয় পার্টি জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছে। সুতরাং নুরের ওপর হামলা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটা সুগভীর চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। সে কারণে যে দাবি ( জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ) উঠেছে তার আইনগত দিক যাচাই-বাছাই করে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় আমি তা দেখবো।

শেয়ার করুন