গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। যদিও এই বৈঠকের জন্য ভারতকে অনেক দেন-দরবার করতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট গত ২০ জানুয়ারি শপথ নেওয়ার পর বেশ কয়েকবার ভারতের পররাষ্ট্র জয়শঙ্কর আমেরিকায় এসেছিলেন। অবশেষে সে বৈঠকের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি। ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ওইদিনই ট্রাম্প ও মোদির বৈঠকের সময় হোয়াইট হাউসের সামনে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। এ প্রতিবাদ সমাবেশে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের উভয় গ্রুপ এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নিউইয়র্ক থেকে বাসযোগে ওয়াশিংটন যান। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু গোল বাধে যখন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। স্লোগানের ভাষা ছিল- ওয়েল কাম ওয়েল কাম মোদিজি, মোদিজি, ইউ সাপোর্ট- মোদিজি মোদিজি ইত্যাদি। এ নিয়ে কমিউনিটিতে চরম বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি মোদিকে স্লোগান দেবেন? অনেকেই প্রশ্ন করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ কি ভারতের বিজেপির শাখায় পরিণত হয়েছে? মোদি কী আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতায় অভির্ভূত হয়েছেন? শেখ হাসিনাকে বাঁচানোর জন্য এতো নিচে নামতে হলো যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগকে? যে উদ্দেশ্যে এসব স্লোগান দেওয়া হয়েছে, তা হিতে বিপরীত হয়েছে? এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান এক টিভি টকশোতে বলেছেন, আমি বাংলাদেশের নাগরিক নই। তার এ কথাও বিতর্ক শুরু হয়েছে। টকশোতে অংশ নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতা হেলাল উদ্দিন সিদ্দিকুর রহমানের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি রাষ্ট্রদ্রোহের কাজ করেছেন? বাংলাদেশি না হয়েও আপনি কেন বাংলাদেশি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন?
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমরা যখন প্রতিবাদ সমাবেশ করছিলাম, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেখতে পাই। তাই আমরা তাকে স্বাগত জানিয়ে স্লোগান দিই। তারা আমার নেত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের স্থান দিয়েছে। তাই স্লোগান দিই। এটাতে তো আমি দোষের কিছু দেখি না। আমাকে যখন দেশদ্রোহী বলা হয়, তখন আমি বলেছিলাম, আমি বাংলাদেশি নই। এমনকি আমি ডুয়েল সিটিজেনও নই। আমি সত্য কথা বলেছি। আর আমি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নই। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাখা নয়। তাহলে শেখ হাসিনা কীভাবে কমিটি দেন। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশকে তালেবানি রাষ্ট্র বলিনি, অন্য কেউ বলতে পারে।
এ ব্যাপারে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য গিয়াস আহমেদ বলেন, ড. সিদ্দিকুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ করেছেন? কোনোভাবেই তিনি মোদিকে স্বাগত জানাতে পারেন না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, মোদি কী বাংলাদেশের নাগরিক? তা না হলে একজন বাংলাদেশি হয়ে তিনি কীভাবে মোদিকে স্বাগত জানান। তিনি প্রমাণ করেছেন, আওয়ামী লীগ সব সময় ভারতের দালাল। অথবা আওয়ামী লীগ বিজেপির বাংলাদেশ বা যুক্তরাষ্ট্র শাখায় পরিণত হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী ড. সিদ্দিকুর রহমানের মতো নেতাদের দেশপ্রেম নেই। তারা বাংলাদেশের বিপক্ষে, ভারতের পক্ষের শক্তি।
আরো অনেকেই বিভিন্নভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। একজন লিখলেন, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে আমার এক ফেসবুক বন্ধু স্ট্যাটাস দিলেন, ‘১৩ তারিখের পর সব বদলে যাবে।’ আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক ওই বন্ধু ১২ ফেব্রুয়ারি লিখলেন, ‘কাল বিরাট সুসংবাদ আসছে।’ শুধু আমার ওই বন্ধু নন, আরো অনেক ফেসবুক বন্ধুকে দেখলাম একই ধরনের কথা লিখতে। কেউ কেউ খুব মারমুখী কথাও লিখেছিলেন। যেমন, ‘কাল সব উল্টে যাচ্ছে। একজনও পালানোর পথ পাবে না’; ‘কাল ইউনূস সরকারের বিদায় ঘণ্টা বাজবে’; ইত্যাদি।
কেন তারা ‘সব উল্টে যাবে’ বলে অতি আশায় উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন, তা বোঝা যাচ্ছিল। কারণ ১৩ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। বৈঠকের আগের দিন আমেরিকায় বসবাসকারী আওয়ামী সমর্থকেরা ‘ওয়েলকাম, মোদিজি!’ লেখা প্ল্যাকার্ড ফেসবুকে পোস্ট করেছেন এবং সবাইকে মোদিকে স্বাগত জানানোর জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এরপর ‘মোদিজি’ ওয়াশিংটনে এলেন। ফেসবুকে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখলাম, এক বয়স্ক লোক স্লোগান দিচ্ছেন, ‘অয়েলকাম! অয়েলকাম!’ (সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘ওয়েলকাম’) বাকিরা বলছেন, ‘মোদিজি! মোদিজি!’ এরপর তিনি বলছেন, ‘উই সাপোর (সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘উই সাপোর্ট’), উই সাপোর!’ বাকিরা সম্মিলিতভাবে বলছেন, ‘মোদিজি! মোদিজি!’ এরপর ভদ্রলোক স্লোগান দিচ্ছেন, ‘উই আর ফর, উই আর ফর!’ বাকিরা তখন বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা! শেখ হাসিনা!’
এরপর ট্রাম্প-মোদি বৈঠকটি হলো। কিন্তু কিছুই উল্টালো না
তবে কিছু একটা উল্টালো তাদের বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে। সেখানে ট্রাম্পকে একজন ভারতীয় সাংবাদিক বললেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইস্যুতে আপনার বলার কী আছে? কারণ আমরা দেখেছি, আমেরিকার ডিপ স্টেট বাইডেন আমলে দেশটির সরকার পরিবর্তনে জড়িত ছিল- এটি স্পষ্ট। এরপর মুহাম্মদ ইউনূস জুনিয়র সোরোসের সঙ্গেও দেখা করেন। বাংলাদেশ নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?’
জবাবে ট্রাম্প যা বললেন, তার মানে দাঁড়ায় ‘না, আমাদের ডিপ স্টেটের কোনো ভূমিকা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) এ নিয়ে বহু বছর কাজ করেছেন। আমার যা পড়াশোনা তাতে জেনেছি, এটা নিয়ে শত শত বছর ধরে (ভারতের দিক থেকে) কাজ করা হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ (ইস্যুতে কথা বলার ভার) আমি প্রধানমন্ত্রীর (মোদির) ওপর ছেড়ে দিচ্ছি।’
এই বলে ট্রাম্প পাশে বসা নরেন্দ্র মোদির দিকে ইঙ্গিত করলেন। মোদি ট্রাম্পের এই কথার মানে বুঝতে পেরেছিলেন কি না, তা বোঝা গেল না। তবে তার চেহারায় যে বিষণ্ণতা ও বিরক্তির ছাপ ছিল, তা যে কারো কাছে স্পষ্ট হবে।
যা হোক, মোদি বাংলাদেশ নিয়ে একটি শব্দও বললেন না। তিনি প্রসঙ্গটিকে সোজা ইউক্রেনে নিয়ে ফেললেন এবং যুদ্ধ যে কোনো সমাধান আনতে পারে না-সেই চিরায়ত বাণীটি ঋষি বাক্যের মতো করে সাংবাদিকদের কাছে পরিবেশন করলেন।
বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের এমন জবাব এবং মোদির এমন পাশ কাটানো কায়দা ভারতের মোদি সমর্থকদের কতটা হতাশ করেছে, তা বোঝা না গেলেও ‘মোদিজি! মোদিজি!’ বলে গগনবিদারী আর্তনাদ করা আমার সেই বন্ধুরা যে মুষড়ে পড়েছেন, তা বুঝতে পারছি।
মোদির ডাউন পারফরম্যান্সে যতই তাদের হতাশ হতে দেখছি, ততই লজ্জা পাচ্ছি। অবাক বিস্ময়ে ভাবছি, আওয়ামী লীগের রাজনীতি কোন পর্যায়ে নামলে দলটির কর্মী-সমর্থকরা ভিন্ন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আরেকটি দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এভাবে ‘উই সাপোর! উই সাপোর! মোদিজি মোদিজি!’ বলে স্লোগান দেন।
বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ এখন তার সবচেয়ে বড় ত্রাতা মনে করছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। তারা হয়তো ভেবেছিলেন, মোদি ট্রাম্পকে কিছু একটা বুঝিয়ে সুজিয়ে বাংলাদেশের ‘সব উল্টে’ দেবেন। কিন্তু ট্রাম্প তাদের আশার বাটি উল্টেই দিলেন। অনুশোচনাহীনতা ও লজ্জার ঘাটতিই সম্ভবত আওয়ামী লীগের বন্ধুদের এ অপরিপক্ব আশার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। রাজনীতিতে নাকি সব চলে। তাই বলে রাজনীতি ব্যক্তির নিম্নতম ব্যক্তিত্ববোধও কেড়ে নেবে? হয়তো নেয়।
মানুষের নৈতিক বোধের অন্যতম পরিচয় তার লজ্জা। এই লজ্জা বেপরোয়াকে সংযত করে। আর লজ্জাবোধ হারিয়ে গেলে মানুষ হয়ে ওঠে নির্লজ্জ। নির্লজ্জতার সঙ্গে অনুশোচনাহীনতার যোগ ব্যক্তিত্ববোধকে হত্যাই করে ফেলে।
অন্যদিকে ভারতীয় সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ি আর ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমেরিকায় গিয়েছেন। তাকে স্বাগত জানাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখা ‘ওয়েলকাম নরেন্দ্র মোদি’ লেখা ব্যানার নিয়ে জমায়েত করেছে। আওয়ামী ছাত্রলীগের অফিসিয়াল পেজ এই ভিডিও শেয়ার করেছে। বিজেপি এবং আওয়ামী লীগ এখন আর আলাদা দুটি দল নয়। আওয়ামী লীগ বর্তমানে বিজেপির বাংলাদেশি শাখা। সে কারণেই মোদিকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার হাতে আমেরিকায় জমায়েত করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতা ভারতে আছেন। আওয়ামী লীগের আইটি সেলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ভারতে এসে আরএসএসের শীর্ষনেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করে গিয়েছেন। করতেই পারেন। এগুলো তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
প্রশ্ন হলো, বিজেপির সিস্টার কনসার্ন হিসেবে ক্রিয়াশীল আওয়ামী লীগ কি আদৌ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কামব্যাক করতে পারবে? সম্ভবত নয়। ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছে, ক্ষোভ আরো বাড়বে। কিন্তু তার সুফল আওয়ামী লীগ ঘরে তুলবে না, তুলবে অন্য রাজনৈতিক শক্তি।
জুলাই-আগস্টের সহিংসতা নিয়ে শেখ হাসিনাকে দায়ী করে রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের বিপদ আরো বেড়েছে। এই দুরবস্থায়, খোলাখুলি নরেন্দ্র মোদির পক্ষে ব্যানার নিয়ে মিছিল করে আদৌ বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছে আওয়ামী লীগ?