১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০৪:৪৪:৪৮ পূর্বাহ্ন


পারবে তো ছাত্র-জনতা সৈনিক
সব ষড়যন্ত্র রুখে ‘দেশ সংস্কার’
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৮-২০২৪
সব ষড়যন্ত্র রুখে ‘দেশ সংস্কার’ নতুন প্রজন্মের দেশ সাজানো


রাজধানী ঢাকার দেওয়ালজুড়ে নতুনত্বের ছাপ! কিছু একটা নজরে আসবেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অনেক দাবি ও অভিযোগ দেওয়ালে শোভা পেয়েছে এতোদিন। এবার সেগুলো মুছে দেওয়া হয়েছে। সেখানে শোভা পাচ্ছে চমৎকার সব স্লোগান-‘স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও করবো।’ ‘এসো আমার ঢাকায়।’ ‘দিনবদলের গল্প।’ ‘আওয়াজ উডা’ বা চমৎকার সব ক্যালিওগ্রাফি। ছাত্র মানেই ছেলে ও মেয়ে। কেউ পিছিয়ে নেই। এখানে সবাই একাকার। কে স্কুলে, কে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত। সবারই হাতে রং ও তুলি বা লাঠি। কয়দিন আগেও যে ঢাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, সেগুলো নিজেরাই ধুয়ে মুছে ঝকঝকে তকতকে করে তুলেছে। সহপাঠীরা রাস্তার শৃঙ্খলার কঠিন দায়িত্বে-মুখে বাঁশি, হাতে লাঠি। ট্রাফিক পুলিশসহ সব পুলিশ যখন কর্মবিরতিতে। তখন কঠিনহস্তে ট্রাফিক সামলাচ্ছেন। দুটি উদাহরণ-বর যাচ্ছে বিয়ে করতে। সেজেগুজে পাগড়ি মাথায়। গাড়ি আটকানো হলো কাগজ নেই। বরকে ছাড় দেওয়ার শর্ত ওই দুলহান সাজা অবস্থায় ৩০ মিনিট ট্রাফিক সামলানোর।

গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন নিয়ম ভঙ্গ করেছেন, দাঁড়ান, গাড়ি সাইট করেন। এবার ট্রাফিক সামলান শিক্ষার্থীর সঙ্গে, যতক্ষণ না আরেকজন নিয়মভঙ্গকারী না পাওয়া যাবে। গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে সামনের গ্লাসে আপনি ডাক্তার, আইনজীবী বা রাষ্ট্রের লোগো খচিত স্টিকার। খুলে ফেলতে হবে সব। রাস্তায় সবাই সমান। আপনার কর্মস্থলে আপনার পরিচয়। সন্দেহ হলেই গাড়ি তল্লাশি। এতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা কখনো লাখ লাখ, কখনো এর চেয়ে কম টাকার বস্তা বা ব্যাগও উদ্ধার করছেন নতুন ট্রাফিকরা। লোকাল গাড়িকে কোয়ার্টার কিলো ধরে লম্বা লাইন ধরিয়ে চলাতে বাধ্য করছেন। নিয়ম ভাঙছেন তো রক্ষা নেই। মৌমাছির মতো দৌড়ে আপনাকে ধরবে অপদস্ত করবে। তরুণদের কাছে সম্মানটা তো বড়। তাই অনেকটাই সোজা এখন অনিয়মে অভ্যস্ত ঢাকার মানুষ। তাদের পেছনেই একঝাঁক দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। মোবাইলের বোতামটা টিপতে যা দেরি, উড়ে আসছেন সেনাসদস্যরা মুহূর্তেই। যাবেন কই! ছাত্রদের মনবল বেড়ে গেছে বহুগুণে। কয়দিন গেছে ডাকাত ডাকাত। রাত জেগে এরা মহল্লা মহল্লায় পাহারা দিয়ে এলাকাবাসীকে স্বস্তিতে রেখেছেন। সেখানেও ব্যাক সাইডে দাঁড়িয়ে সেনা সদস্যরা। 

আর দাঁড়াবেনই না কেন। মাঠে ছাত্র-জনতা উৎখাত করেছে শেখ হাসিনা সরকারকে। কিন্তু চরম মুহূর্তে ঠান্ডা মাথায় ছাত্রদের পক্ষে ভূমিকা নিয়ে সেনাবাহিনী মূলত ছাত্রদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিল। নতুবা সেনাদের গুলি ছুড়তে হলে কী ভয়ানক রক্তপাত ঘটতো, সেটা তো আর লিখে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। ফলে এমন আন্দোলনে সেনাদের ভূমিকাও কম নয়। 

রাস্তার ট্রাফিকের পর মাঠে যারা রংতুলিতে এক্সপার্ট তারা দেওয়ালে মনোযোগী। যে পারছেন না, সে পুরোনো দেওয়ালটা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এরাই কী ছাত্র? হ্যাঁ এরা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ। কয়দিন আগে স্বৈরাচারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়ে বলেছেন-‘গুলি কর। কিন্তু দাবি অধিকার আদায় করবোই।’ করেছেও। গুলি খেয়েছে। জীবন দিয়েছে। আহত হয়েছে। রক্ত ঝরিয়েছে। স্বৈরাচারকে ইতিহাস সৃষ্টি করে পালাতে বাধ্য করেছে। আবার রাষ্ট্র সংস্কারেও হাত দিয়েছে। অথচ এ ছাত্ররা বাসায় এতোদিন কী করতো জানা আছে কি? 

এদের মা-বাবার হাজারো অভিযোগ। এক গ্লাস পানি ঢেলেও খায়নি এরা কোনোদিন। খাবারটা কবে ডাইনিং টেবিলে বসে খেয়েছে মা-বাবা বলতে পারবেন না। সকালের নাশতা হাতে পায়ে ধরে খাওয়াতে হয়। রাতের খাবারের জন্য কত অভিমান, তবেই মুখে দিলে দিয়েছে নতুবা না। এতো অনিয়মের মধ্যে বেড়ে উঠেছে তারা হাতে এনড্রয়েড বা আইফোন মোবাইল, সারাক্ষণ বোতামে আঙুল!

বিশ্বের প্রায় সব দেশে প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেন হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা। কী জাদুমন্ত্রে এবং কখন সব ভুলিয়ে জাগিয়ে তুললেন, সেটা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কেউ। এদের মধ্যে এতো দেশপ্রেম? কল্পনাতীত। নিজের বাচ্চাদের দিকে তাকালে তাদের ব্যস্ততা ও কর্মচাঞ্চল্য দেখলে বুকটা ভরে যায়। দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য তোদের এতো মায়া কোথায় ছিল। কীভাবে জন্মালো-অনেকের মুখ থেকে বের হচ্ছে। বাচ্চার জন্য খাবার নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন অনেক গার্ডিয়ান। একটু পানি খেয়ে নে। একটু নাশতা খেয়ে নাও সবাই মিলে। কেউ হুন্ডা দিয়ে যাচ্ছেন, চকোলেট বিলাচ্ছেন বা কোমল পানীয় দিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো মায়া-মমতা। মন থেকে সমর্থন ছাত্রসমাজের প্রতি। 

বাবা বা মা করেন আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বা অন্য কোনো দল। কিন্তু ছেলেমেয়েরা ওগুলো নিয়ে থোরাই কেয়ার। ওরা হ্যামেলিনের বাঁশির সুরে দেশ সংস্কারে নেমেছে এখন। বিস্ময় দৃষ্টিতে দেখছে বাংলাদেশের মানুষ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এরা পারবে তো! হ্যাঁ পারবে। কারণ যারা বুক পেতে দিয়ে গুলি খেয়ে বিন্দুমাত্র দমেনি। তারা জিতবেই। তাদের সঙ্গে আছেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা। ফলে তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছবেই এ দৃঢ়তা এখন মানুষের মধ্যে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

হত্যা, খুন, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, বাজার সিন্ডিকেট, কারসাজি, ঘুষ, সুদ, অর্থপাচার, গণতন্ত্র হরণ, ক্ষমতার দাপট। রাষ্ট্রযন্ত্র অবৈধভাবে ব্যবহার, কি না ছিল। যুগ যুগ ধরে আমরা বড়রা এগুলো করে এসেছি লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ বাংলাদেশটাতে। আমরা বাধা দিতে না পেরে ওই অপকর্মের ভাগিদারও। কোমলমতি শিশু-তরুণরা এগুলো দেখেছে। অনুধাবন করেছে আমাদের অসহায়ত্বকে। এর পরই তাদের প্রতিজ্ঞা-দেশ গড়ার, দেশ সংস্কারের। 

গোটা বিশ্ব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালাকে তারা আগে থেকেই জানেন। এবার তার অন্য এক ক্যারিশমা দেখছেন অবাক দৃষ্টিতে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুরক্ষিত ভোল্ট হ্যাক করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুট করে নিয়ে যাওয়া, প্রতিটি বছরে লাখ লাখ কোটি ডলার পাচার হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ যখন পথে বসার উপক্রম, ঠিক তখনই তরুণদের বজ্র হুংকার। মুখ ফুটে বলেনি শুধু-তোমরা (বাবা-মা বা সিনিয়র সিটিজেনরা) যা পারোনি দাঁড়াও আমরা সেটা করে দেখাচ্ছি। করছেও।

সিনিয়র সিটিজেনদের লজ্জায় মাথা হেট হওয়ার উপক্রম। কীভাবে? তার এক নমুনা- 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে দুই তরুণও রয়েছেন। নামটা নাই বললাম। এদের নিয়ে সচিবালয়ে গুঞ্জন। অসহ্যভাব। কিন্তু মানতে তো হবেই। পিচ্চি ছেলে। তাকে এখন মন্ত্রণালয়ের সবকিছুর বয়ান দিতে হবে। স্যার স্যার করতে হবে, এটা মানা যায় কি? ছেলেতুল্য মানুষকে স্যার বলে তোষামোদ করার রীতি তো বাংলাদেশে নেই।

এক মন্ত্রণালয়ে দেখা গেল পরিচিতির জন্য আয়োজিত গোলটেবিলে স্যার স্যার বলতে বলতে গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। কারণ, উনি তো একা নন। উনি জাস্ট একটা ট্যাক্স করবেন। গোটা সচিবালয় ঘেরাও হবে মুহূর্তে। কোথায় পালাবেন? 

এর পরও দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের লজ্জাজনক অধ্যায়ের রচনা। ১০ আগস্টেরই কথা। খবর এসেছে কিছু একটা করতে চলেছেন প্রধান বিচারপতি। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস তখন রংপুরে এক শহিদের (সাঈদ) বাড়িতে সান্ত¦না দিতে গিয়েছেন তার বাবা-মাকে। 

এরই ফাঁকে ঘটে যাচ্ছিল এক জুডিশিয়াল ক্যু। অনলাইনে মুহূর্তে মিটিং কল করে প্রধান বিচারপতি যদি ঘোষণা দিতে পারতেন যে, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবৈধ-এমন কত কি। তাহলে ওই মুহূর্ত থেকে গোটা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বনাম ছাত্রসমাজ রক্তগঙ্গা বয়ে যেত। যোগ দিলে অবাক হতো না পুলিশের একশ্রেণির কর্মকর্তা, যারা তখনো কর্মবিরতিতে বিভিন্ন দাবিতে। 

কিন্তু ৫ আগস্টের পর ১০ আগস্ট গিয়ে সেই ছাত্র জনতাকে ঘেরাও করতে হয়েছে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করে তার স্থানে নতুন একজনকে দায়িত্ব দিয়ে তবেই তারা ফিরেছেন নিজ কর্মে। 

আমরা সিনিয়র সিটিজেনরা কতটা ভালো? আবারও এমন কোনো স্থানে এরকম কিছু ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে। গুজব প্রোপাগান্ডা এটা তো বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকেই। নতুবা বিবিসি বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট করেছে যে, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পোড়ানো বা মূর্তি ভাঙার যেসব ঘটনা এগুলো গুজব। এর বেশির ভাগ পার্শ্ববর্তী কোনো এক দেশ থেকে প্রচারিত হচ্ছে। অথচ দেশে এ ইস্যুতে তোলপাড়। 

গোপালগঞ্জে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে রাখা শুরু করেছিল। সেনাবাহিনী যান চলাচল স্বাভাবিক করতে গিয়ে তাদের ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে রক্তাক্ত করেছে। অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে। সেনাবাহিনীর গাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। 

তবু সেনারা ধৈর্যের সঙ্গে এগুলো মোকাবিলা করে বুঝিয়ে জনতাকে বিরত রেখেছেন। এসব ভালো কিছু নয়। সম্ভবত চলবে অনবরত। ফলে যে শ্রদ্ধাবোধ এখনো তরুণরা সিনিয়র সিটিজেনের ওপর দেখাচ্ছে এটা ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে!

তবে এটা ঠিক, যারা বুক পেতে গুলি খেলে ১৬ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে প্রশাসনের সব নিজস্ব কর্তৃত্বের মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, সে দাম্ভিক সরকার পতনের মতো অসাধ্য সাধনে সক্ষম হয়েছে, তারা দেশটাকে গড়ার জন্য সংস্কারও করে দেখাতে পারবে, এটা এখন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তবে ষড়যন্ত্র থেমে নেই। সেটা ছাত্র-জনতাও টের পাচ্ছে। কিন্তু দেশের অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে ওঠা ছাত্রসমাজ ও সৈনিক সেদিকে রাখছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। প্রস্তুত তারা সব ষড়যন্ত্র রুখে দিতে।

শেয়ার করুন