নিউ ইয়র্ক শহর বর্তমানে অবৈধ অভিবাসীদের জন্য একটি বড় কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, শহরে প্রায় ৭ লাখ ৫৯ হাজার অবৈধ অভিবাসী বসবাস করছেন। এর মধ্যে অন্তত ৫৮ হাজার ৬২৬ জনের বিরুদ্ধে তাদের নিজ দেশে অথবা যুক্তরাষ্টে অপরাধমূলক কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিবাসীদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৫৩ জনকে কুখ্যাত গ্যাং সদস্য হিসেবে চিহ্নিত বা সন্দেহ করা হচ্ছে। নিউ ইয়র্ক সিটির স্যাংচুয়ারি নীতি, যার ফলে স্থানীয় প্রশাসন এবং ফেডারেল সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা সীমিত হয়ে পড়েছে, শহরের জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৬ লাখ ৭০ হাজার অবৈধ অভিবাসী রয়েছেন, যারা ইতোমধ্যে তাদের নিজ দেশে অথবা যুক্তরাষ্টে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন বা অপরাধমূলক অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছেন।
নিউ ইয়র্কে অপরাধমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি গোষ্ঠী হলো গ্যাং সদস্যরা। বেঙ্কার্ড ব্যারিও কিংসের মতো গ্যাংগুলো মাদক পাচার এবং সহিংস অপরাধে সরাসরি জড়িত। অপরাধীরা যারা একাধিকবার বহিষ্কৃত হয়েও পুনরায় দেশে প্রবেশ করে অপরাধে লিপ্ত হয়েছে। তাদের গ্রেফতার ও যুক্তরাষ্ট্র থাকে বহিষ্কারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যাং সদস্যদের এই কর্মকাণ্ড জননিরাপত্তার জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি সৃষ্টি করছে।
এমএস-১৩ (মারা স্যালভাত্রুচা) একটি সহিংস গ্যাং যা ১৮০-এর দশকে ক্যালিফোর্নিয়ায় সালভাদোরীয় অভিবাসীদের দ্বারা গঠিত হয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে যেমন নিউ ইয়র্কসহ যেখানে বেশি অভিবাসী জনসংখ্যা রয়েছে। এমএস-১৩ তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য পরিচিত, যার মধ্যে ড্রাগ ট্রাফিকিং, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করা এবং হত্যাকাণ্ডে মতো সহিংস অপরাধ অন্তর্ভুক্ত। নিউ ইয়র্কে এমএস-১৩ বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয়, তবে গ্যাংটির উপস্থিতি সবচেয়ে শক্তিশালী লং আইল্যান্ড এবং কুইন্সের কিছু অংশে। কর্তৃপক্ষ গ্যাংটির প্রভাব মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যার মধ্যে অনেক সদস্যদের গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)-এর তথ্য অনুযায়ী অনেক অভিবাসী যারা পূর্বে বহিষ্কৃত হয়েছিল, তারা পুনরায় অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করে অপরাধমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে মেয়র বিল ডি ব্লাসিও নিউ ইয়র্ক সিটির স্যাংচুয়ারি নীতিকে আরও শক্তিশালী করেন। এর ফলে এনওয়াইপিডি ফেডারেল কর্তৃপক্ষের সাথে অপরাধীদের তথ্য শেয়ার করতে পারে না। ২০১৮ সালে এই নীতিতে আরও কঠোরতা আনা হয়। এ ধরনের নীতি সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে বলে ইমিগ্র্যান্ট বিরোধীরা অভিযোগ করছেন। উদাহরণস্বরূপ, জর্জিয়ার নার্সিং ছাত্র লেকেন রাইলির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। হত্যাকারী একজন অবৈধ অভিবাসী, যাকে আগেই ফেডারেল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু স্থানীয় নীতির কারণে তা সম্ভব হয়নি।
নিউ ইয়র্ক সিটি ২০২২ সালের বসন্ত থেকে ২ লাখ ২৩ হাজার জন নতুন অভিবাসী গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে ৫৫ হাজার জন এখনও করদাতাদের অর্থে পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করছেন। এই ধরনের সুযোগ-সুবিধা শহরের বাজেটে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে। স্থানীয় করদাতারা মনে করছেন।
নিউ ইয়র্ক সিটির অপরাধী অপরাধী অভিবাসীদের কার্যকলাপ শহরের নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। অপরাধী অভিবাসীদের পুনরায় অপরাধে জড়ানো, গ্যাং সদস্যদের কার্যকলাপ এবং স্যাংচুয়ারি নীতির কারণে আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগে অসুবিধা শহরকে ক্রমাগত অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একদিকে, অভিবাসীদের জন্য সামাজিক সেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে সিটির বাজেটে চাপ পড়ছে, অন্যদিকে নাগরিকদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। এই সংকট মোকাবেলা করতে হলে, অভিবাসন নীতিতে বাস্তবসম্মত সংস্কার, ফেডারেল এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি, এবং অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। জননিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারলে, নিউ ইয়র্ক সিটির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ভবিষ্যতে আরও বড় সংকটে পড়তে পারে।
অভিবাসী এবং অপরাধের মিথ ভ্রান্ত
অভিবাসী অধিকার গ্রুপগুলো বলছে, অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ একটি মিথ্যা গল্প। চাইনিজ, আয়ারিশ, ইতালীয়, মুসলিম, মেক্সিকান- এই জাতির মানুষদের উপর যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধ ছড়ানোর মিথ্যা অভিযোগ অনেক বার করা হয়েছে, বিশেষ করে যখন অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। আজকালও কিছু রাজনীতিবিদ এই একই পুরনো মিথকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, এবারে তারা বলছেন, নতুনভাবে আসা অভিবাসীদের মধ্যে অপরাধের হার বেড়ে গেছে। ইমিগ্রান্ট-বিরোধী মিডিয়া বলছে, “মাইগ্র্যান্ট ক্রাইম সার্জ” বা অভিবাসীদের মধ্যে যারা সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন, তাদের কাছ থেকে অপরাধের উত্থান হচ্ছে।
তবে, আমেরিকান ইমিগ্রেশন ফেডারেশন একটি শক্তিশালী গবেষণার ভিত্তি প্রমাণ করে যে, অভিবাসীদের আমেরিকান সম্প্রদায়ে গ্রহণ করা কেবল অপরাধ বাড়ায় না, বরং এটি জনসুরক্ষা শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে। আসলে, অভিবাসীরা- অবৈধ অভিবাসীসহ যুক্তরাষ্ট্রের জন্মসূত্রে মানুষদের তুলনায় অপরাধ কম করে। এটি জাতীয়, রাজ্য, জেলা এবং কাউন্টি স্তরে সত্য এবং এটি সহিংস এবং অসহিংস উভয় ধরনের অপরাধের জন্যও প্রযোজ্য।
আমেরিকান ইমিগ্রেশন ফেডারেশন ১৯৮০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অপরাধের তথ্য এবং জনসংখ্যার তথ্য তুলনা করেছে, যা সর্বশেষ উপলব্ধ তথ্য। এই তথ্য দেখিয়েছে যে, যত বেশি অভিবাসী জনসংখ্যার অংশ হয়ে উঠেছে, অপরাধের হার তত কমেছে। ১৯৮০ সালে অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার ৬.২ শতাংশ ছিল এবং মোট অপরাধের হার ছিল প্রতি এক লাখ জনে ৫ হাজার ৯০০ অপরাধ। ২০২২ সালে অভিবাসীদের অংশ ১৩.৯ শতাংশে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে এবং মোট অপরাধের হার ৬০.৪ শতাংশ কমে প্রতি এক লাখ জনে ২ হাজার ৩৩৫ অপরাধে নেমে এসেছে। বিশেষভাবে, সহিংস অপরাধের হার ৩৪.৫ শতাংশ এবং অপরাধের হার ৬৩.৩ শতাংশ কমেছে।
ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এর ইউনিফর্ম ক্রাইম রিপোর্টিং ডেটা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারি থেকে জনসংখ্যার তথ্য ব্যবহার করে জানা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রাজ্য স্তরে মোট অপরাধের হার এবং অভিবাসী জনসংখ্যার অংশের সম্পর্কও অনুসন্ধান করা হয়েছে। বেটা রিগ্রেশন বিশ্লেষণ এবং ৫০টি রাজ্যের তথ্য ব্যবহার করে, ফলাফল দেখায় যে, কোনও রাজ্যে অভিবাসী জনসংখ্যার অংশ এবং মোট অপরাধের হারের মধ্যে কোনো পরিসংখ্যানগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই। এর মানে হল যে, উচ্চতর অভিবাসী জনসংখ্যার অংশ অপরাধের হারের সাথে সম্পর্কিত নয়, যা এই বিষয়ে পূর্ববর্তী গবেষণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।অভিবাসী সমাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আসল সত্য হলো যে তারা শুধু অপরাধ বাড়ায় না, বরং কমিয়ে আনে।