৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৭:২৮:১২ অপরাহ্ন


জামায়াতকে বিএনপির চূড়ান্ত নোটিশ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৯-২০২৫
জামায়াতকে বিএনপির চূড়ান্ত নোটিশ বিএনপি ও জামায়াতের লগো


বিএনপি কোনোভাবেই জামায়াতে ইসলামের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে না। দলটির সাথে কোনো ধররে আসন ভাগাভাগিতে সমঝোতা থাকছে না। পাশাপাশি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচিত হলে সরকার গঠনেও এই দলটিকে সঙ্গে রাখবে না। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের উদার গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল, ইসলামী সবদল-মতসহ বিশিষ্টজনদের নিয়ে আগামীতে দেশ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত এখন চূড়ান্ত। একই সাথে জামায়াতের সাথে সব ধরনের যোগাযোগের ব্যাপারেও বিএনপি এখন থেকে আরও কঠোর হবে। এটা বিএনপি’র একেবারে সর্বচ্চো পর্যায়ের সর্বশেষ অবস্থান ও সিদ্ধান্ত । সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে এসব তথ্য মিলেছে। 

বিশ্বাস ভঙ্গ করবেন না তারেক রহমান

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নানা নির্যাতন সহ্য করেছি। লোভ-লালসা ত্যাগ করে বিএনপির সঙ্গে ছিলাম। আমরা জয় পেয়েছি। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে সরকার। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অতীতের মতো আগামী দিনেও আমাদের নিয়ে চলতে চান। কাজ করতে চান। বিগত সময়ে যুগপৎ আন্দোলনের দল ও জোট হিসেবে আমাদের তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার বিন্দুমাত্রও ভঙ্গ করবেন না বলে জানিয়েছেন- এমন ধারণা ও বিশ্বাস হচ্ছে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের। বিভিন্ন গণমাধ্যমের পাশাপাশি একান্তে আলাপেও এরা এটা বিশ্বাস করেন দেশ প্রতিনিধিও তা জানিয়েছেন।

জানা গেছে, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনার পর বিএনপি’র একেবারে হাই কমান্ড জামায়াতকে সাফ বুঝিয়ে দিয়েছে দলটির সাথে আর কোনো ধরনের আলোচনা বা ঐক্যের পথে হাঁটবে না। বিএনপি’র পক্ষ থেকে এব্যাপারে বেশ কয়েকটি যুক্তি দেখিয়েছে। বিএনপি মনে করে তারা আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। এটা করতে গিয়ে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বিভিন্ন উদার প্রগতিশীল দলগুলিকে নিয়ে একটি যুগপৎ আন্দোলনের একটা প্লাটফরম তৈরি করেছিল। এজন্য বিএনপি’র অনেক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়। কেননা একমাত্র জামায়াতের ইসলামের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন ও ক্ষমতায় যাওয়ার কারণে দেশ বিদেশে বিএনপি’কে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলের কাতারে ফেলা হয়। 

বলা যায় বিএনপি একঘরে হয়ে পড়ে। কেননা একসময়ে জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার পায় বিএনপি একটি মৌলবাদী দল। দলটি সাম্প্রদায়িক দলের সাথে জোট করে ক্ষমতায় যেতে চায়। সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের এসব দলমত কেউই বিএনপির সাথে একসাথে আন্দোলন বা যুগপৎ কর্মসূচিতেও রাজি হতো না। এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ওইসব দল কঠোর শর্ত দিয়েছিল। সেই শর্তের পরে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদের আশ্বস্ত করা হয়। বলা চলে বিএনপির একেবারে শীর্ষ পর্যায় থেকে আশ্বস্ত করা হয় যে, দলটি জামায়াতের সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগই রাখবে না। বিএনপির পক্ষ থেকে ওই আশ্বাসে আস্থা এনেছিল যে দলটি কোনোভাবেই কোনো পর্যায়েই জামায়াতের সাথে আর আলাপ- আলোচনা বা সর্ম্পক রাখবে না। জানা গেছে, বিএনপির সেই দুঃসময়ে যিনি দল পরিচালনা করেছিল সেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজ মুখে আশ্বস্ত করেন যে, ‘জামায়াতকে তারা আর সাথে নিচ্ছে না।’ তখন এনিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আরও আশ্বস্ত করা হয় যে আন্দোলন ও দেশ পরিচালনায় তাদের সঙ্গে চলা যুগপৎ এর শরিকরা সব সময় থাকবে। একারণে বিএনপির পক্ষ থেকে এখন যুক্তি দেখানো হচ্ছে যে, তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চান না মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের উদার প্রগতিশীলদের সাথে কোনোভাবেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হউক। বিএনপি মনে করে এটা করা হলে তার আর কখনোই এই শক্তিকে তারা আর সঙ্গে পাবে না। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের কোনো পক্ষই আর কখনোই তারেক রহমানকে আস্থায় নেবে না । 

পশ্চিমাদের চাপ

একটি সূত্র জানায়, জামায়াতের সাথে যতোই প্রকাশ্যে কিংবা অন্দরমহলেও পশ্চিমারা বৈঠক কিংবা সৌজন্য সাক্ষাৎ করুক না এটা শুধু একটি বোঝাপড়ার পর্বই। কেননা বাংলাদেশে তারা এই দলটিকে সাথে নিয়ে কোনো দল ক্ষমতায় যাওয়াকে শেষ-মেষ ভালোভাবে নেয় না। সম্প্রতি পশ্চিমাদের অন্যতম রক্ষক সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ও হঠাৎ বেঁকে বসতে দেখা গেছে একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে। একটি খবরে বলা হয় যে, মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে আসা তথ্যপ্রমাণ অনুসারে জঙ্গি নেতাদের কয়েকজন জেলের বাইরে বেরিয়ে নতুন নতুন উগ্রপন্থী সংগঠন গড়ে তুলছে। সেই খবর অনুয়ায়ী বলা হয় যে, একটি সংগঠন বাংলাদেশের বারিধারায় বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে প্রাণঘাতী হামলা করে দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের পরিকল্পনা করেছে। এর পরেই বারিধারার কূটনৈতিক এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে বিশেষ দল মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের বিশেষ বাহিনী তল্লাশি চালিয়ে দু’জন জঙ্গি নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। একটি সূত্র জানায়, এই ধরনের খবরে বিএনপি’র শীর্ষ পর্যায় বিচলিত হয়ে পড়ে। তাই এই ধরনের ঘটনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সম্প্রতি দলের একটি মতবিনিময়ে বাংলাদেশ যেন চরমপন্থা বা মৌলবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে না পারে, সেটিই বিএনপির লক্ষ্য বলে জানাতে হয়েছিল দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। 

‘না’ এর পেছনে আরো কয়েকটি কারণ

কারো কারো মতে আরো কয়েকটি কারণে বিএনপি জামায়াতের ওপর ভীষণ ক্ষ্যাপা। দলটির হাই কমান্ড মনে করে ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের পতনের পর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি জামায়াতের অনুকূলে নিতে দলটি হেন কূটকৌশল নেই যে অবলম্বন করেনি। বিএনপির মতে, শুধু শুধু সংস্কারের কিংবা জাতীয় সরকার গঠনের দাবির পেছনে জামায়াতের খারাপ উদ্দেশ্য আছে এবং ছিল। তারা যে জাতীয় সরকারের ধুয়া তুলেছিল তাতে বিএনপি গভীর সন্দেহ ছিল। বিএনপি হাই কমান্ড মনে করেন, জাতীয় সরকার হলে জামায়াত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বাগিয়ে তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মাঠ তৈরি করে ফেলতো, ঠিক যে-টি আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সতে বছর ধরে করেছিল। অথচ সুষ্ঠু ভোট হলে জামায়াত কোনোভাবে একটি বিরোধী দলের আসনে বসার মতো অবস্থানও তৈরি করতে পারবে না বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতিতে। বিএনপি আরও মনে করে বর্তমানে ‘নির্বাচন’কে এতো দূরে নিয়ে যাওয়ার পেছনে জামায়াত একটি প্রতিবেশী দেশের কলকাঠির গুটি হিসাবে কাজ করেছে। বিএনপি নেতারা মনে করেন পরিস্থিতি দিনের পর দিন আরও খারাপের প্রেক্ষাপটও তৈরি করছে জামায়াত। বিএনপি মনে করে জামায়াতের কারণেই দেশ এখন একটি ভীতিকর পরিস্থিতির দিকে। একারণে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেশ কয়েকবার বলেছেন, গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। আর গণতন্ত্রে যাওয়ার প্রধান ফটক হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচন হচ্ছে না বলেই দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দুর্নীতি বাড়ছে, দুর্বৃত্তরা সুযোগ নিচ্ছে।

ইসলামী দল যারা থাকছে বিএনপি সাথে

এদিকে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ও বাংলাদেশে অধিকাংশ আলেমদের আস্থাভাজন ইমান আকিদা নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মুসলমানসহ অন্য ধর্মের মানুষের কাছে বির্তকিত নয় এমন ইসলামী দল-মতকে সাথে নিবে বিএনপি। এই তালিকায় রয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশসহ কয়েকটি দল। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ একটি কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন যা ২০১৩ সালে গঠিত হয়। এটি বাংলাদেশের বেশিরভাগ ধর্মীয় শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়ে গঠিত। একটি সূত্র জানায়, বিএনপি মনে করেন, জামায়াতের সাথে বাংলাদেশের বড়ো ইসলামী দলগুলি মতের চিন্তার পার্থক্য আছে। মাওলানা মওদুদীর যে চিন্তাধারা, তার সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবেই তাদের চিন্তাধারার পার্থক্যকে বিএনপি-ও বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। বিএনপির নেতারা মনে করেন দিনে দিনে এই পার্থক্য এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিস্কার হয়ে উঠছে। এদিকে ইসলামী দলগুলির একটি বড়ো অংশের অভিযোগ রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলাপাড়। বলা হচ্ছে ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর থেকে জামায়াতের নেতৃত্বে দেশের অধিকাংশ মসজিদ মাদ্রাসা কাদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। এখন সেসব প্রতিষ্ঠানে মাওলানা মওদুদীর চিন্তাধারা কৌশল ও কার্যক্রম প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। এসব ঠেকাতে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনগুলিকে কোনোভাবেই পেরে উঠছে না। তাদের অভিযোগ প্রশাসনের একটি বড়ো অংশ জামায়াতকে এসব দখলে রাখতে সহায়তা করে যাচ্ছে।

তাই তারা-ও এখন জামায়াতকে সাথে নিয়ে ভোটযুদ্ধে যেতে ভরসা পাচ্ছে না। কেননা ইমান আকিদা সংক্রান্ত ছাড়াও জামায়াতের সঙ্গে তাদের বৃহত্তর ইসলামিক উম্মাহর চিন্তার জায়গায় পার্থক্য আছে। এছাড়াও বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের পাশাপাশি ইসলামের ইমান আকিদা নিয়েও এত্তোসব পার্থক্যের কারণে দলটির কাছে থাকাকে কেউ নিরাপদ মনে করছে না। এসব কারণে মূলধারার আলেমসমাজ জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন এবং সাথে রাখতে চাইছে না তারা। তারা এক্ষেত্রে বিএনপিকে ইসলামী দল মনে না করলেও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের উদার গণতান্ত্রিক দল হিসাবে তাদের পাশে রাখতে চায়। 

শেষ কথা

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতা বিএনপির সাথে দরকষাকষি করেই যাচ্ছে যেনো দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে তাদের আস্থায় নেয়া যায়। কিন্তু কোনোভাবেই তারা পথ খুঁজে পাচ্ছে না। একটি সূত্র জানায়, বিএনপি তাদের সাথে দীর্ঘসময় ধরে চলা সেইসব যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের ক্ষমতার নির্বাচনী জোট কিংবা আসন সমঝোতায় যাবে। এর পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দালনের ইমেজে গড়ে উঠা দল এনসিপি’র বেশ কয়েকজন প্রথম সারির নেতাদের-ও ভোটযুদ্ধে ছাড় দেবে।

শেয়ার করুন