৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৭:১৪:০৯ পূর্বাহ্ন


প্রধান উপদেষ্টার দৃঢ়তা : যথাসময়েই নির্বাচন
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৯-২০২৫
প্রধান উপদেষ্টার দৃঢ়তা : যথাসময়েই নির্বাচন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি নেতৃবৃন্দ


প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি নির্বাচনের কোনো বিকল্প ভাবে, সেটা হবে এ জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক।’

গত ৩১ আগস্ট তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর এ কথা জানিয়েছেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে নির্বাচনের যে তারিখ ঘোষণা করেছেন, সে সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে। জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার বিষয়ে অগ্রগতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ প্রধান উপদেষ্টাকে আজ অবহিত করেছেন বলে জানিয়েছেন প্রেস সচিব।

সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য আসন্ন দুর্গাপূজাকে ঘিরে কেউ যেন কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, সে বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পিআর পদ্ধতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম জানান, ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা হচ্ছে সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে। 

বিএনপি মহাসচিব 

সঠিক সময়েই নির্বাচন হবে এবং এ বিষয়ে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই, তা আশ্বস্ত করতেই প্রধান উপদেষ্টা ডেকেছেন বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

গত ১ সেপ্টেম্বর রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে যমুনার সামনে তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচন সঠিক সময়েই হবে। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। আমরা আমাদের মতামত পরিষ্কার করে বলেছি।

এদিকে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান বিএনপির এই নেতা। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে কোনোভাবে বিলম্বিত করার লক্ষ্যেই এই হামলা করা হয়েছে বলে মনে করেন মির্জা ফখরুল।

তিনি বলেন, সেটার বিষয়ে আমরা বলেছি যে এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে এবং এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি যে এটাকে খুব ভালোভাবে, গভীরভাবে তদন্ত হওয়া দরকার। আমাদের আশঙ্কা নির্বাচনকে যে কোনোভাবে বিলম্বিত করার লক্ষ্যে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপিকে আশ্বস্ত করেছেন বলে জানান তিনি। নির্ধারিত শিডিউলেই নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি।

এছাড়া লন্ডনে একটি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় তার নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে করে জামায়াতে ইসলামী, এমন প্রশ্নে তিনি জানান এটা একেবারেই অমূলক। তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টার অধিকার রয়েছে দেখা করার। তার নিজস্ব এখতিয়ারেই দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন। সেই বৈঠক ফলপ্রসু হওয়ায় নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। 

গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান 

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বর্তমান পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের অবদান অব্যাহত রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সেনাবাহিনীর এ ভূমিকা আরো সুসংগঠিত করা জরুরি। এর মধ্যে স্পষ্ট কমান্ড কাঠামো ও সব বাহিনীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় নিশ্চিত করার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জাতির প্রতি অঙ্গীকার করেছি-এমন একটি নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য যা ভোটার উপস্থিতি, নতুন ও নারী ভোটারের অংশগ্রহণ, নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে বৈশ্বিক আস্থা এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের উৎসবমুখর পরিবেশের দিক থেকে আলাদা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।’

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রধান উপদেষ্টাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে তিনি গুজবের প্রতি মনোযোগ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘পুরো সেনাবাহিনী সরকারের সব উদ্যোগ ও কর্মসূচি সফল করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

সিইসি যা বললেন 

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছেন এবং এ পর্যন্ত কমিশনের কাজে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা চাপ প্রয়োগ করেননি। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন যাতে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে, সে লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কমিশনও জনগণকে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে।

১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সিইসি এসব কথা বলেন।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা এ পর্যন্ত আমাদের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করেননি, কোনো সিদ্ধান্তে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি। একবারও বলেননি এটা এভাবে করুন, ওটা ওভাবে করুন। তার দফতর থেকেও কোনো প্রকার প্রভাব আমরা পাইনি। বরং তিনি নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আমি নিজেই তাকে (ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন) বলেছি, আমরা শতভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করছি।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা অপরিহার্য। নির্বাচন কমিশন একা কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবে না। আমাদের দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা লাগবে। রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার-সবাই সরকারি কর্মকর্তা। অর্থায়নের ব্যবস্থাও সরকার করে থাকে। তাই সরকারকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তাই সরকারের সহযোগিতা নিয়েই নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। আশার কথা হলো, সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।’

নির্বাচন কমিশন এমনভাবে একটি নির্বাচন আয়োজন করতে চাইছে, যাতে কমিশনের প্রস্তুতির অভাব নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, আমরা চাই না, কেউ বলুক নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত ছিল না। তাই আমরা পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছি। সরকারের পক্ষ থেকে তারিখ ঘোষণা করা হলে, আমরা যে কোনো সময় নির্বাচন আয়োজন করতে প্রস্তুত থাকব। বড় বড় কাজগুলোর অনেকটা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তিনি জানান, জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে দেওয়া ঘোষণার পরদিনই আমরা চিঠি পেয়েছি। সে চিঠিতে আগামী বছরের রমজানের আগেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের অনুরোধ জানানো হয়েছে। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিকল্পনা সাজিয়েছি। কাজ দ্রুততর করা হচ্ছে, যাতে যথাসময়ে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ‘এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে নানা মত আছে, এটা স্বাভাবিক। তবে আমি বিশ্বাস করি, দেশের স্বার্থে শেষ পর্যন্ত তারা ঐকমত্যে পৌঁছাবে। দেশের স্বার্থই সর্বাগ্রে বিবেচনা করবেন নেতারা। প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন। আগে ঐকমত্য কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, এখন তিনি নিজেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একপর্যায়ে সবাই একটা সমঝোতায় পৌঁছবে।’

বৈঠকে মার্কিন কূটনীতিক ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন মব কালচার প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুললে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের দিন একসঙ্গে ৩০০ আসনে ভোট হবে। তখন এতো বিপুলসংখ্যক লোক এক জায়গায় জড়ো হওয়ার সুযোগ নেই। লোকজন ছড়িয়ে পড়বে, ঢাকাসহ বড় শহর খালি হয়ে যাবে। অভিজ্ঞতাও বলছে, নির্বাচনের দিনে মব কালচার কার্যত ভেঙে যায়। তাই এই বিষয়ে খুব একটা উদ্বেগের কারণ দেখি না।’

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সব সময় সচেষ্ট থাকবে যাতে ভোটাররা নিশ্চিন্তে ভোট দিতে পারে। সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা-ব্যবস্থা জোরদার করা হবে এবং প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হবে। 

সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, নির্বাচন কমিশনের এ কার্যক্রম শুধু দেশের জনগণ নয়, আন্তর্জাতিক মহলও ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তাই কমিশন শুরু থেকেই জোর দিচ্ছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই দেশে ও বিদেশে যেন এমন আস্থা সৃষ্টি হয় যে, বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এজন্য প্রতিটি ধাপে আমরা অত্যন্ত সতর্কভাবে এগোচ্ছি।’

সিইসি আরো বলেন, সর্বশক্তি দিয়ে একটা সুন্দর নির্বাচন করার চেষ্টা আমাদের থাকবে। আমাদের চেষ্টার কোনো ঘাটতি থাকবে না। 

তিনি বলেন, আমি উনাকে (ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন) বলেছি, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব। উনি জাতির কাছে একটা ওয়াদা করেছেন। আমি চাই ওনার (প্রধান উপদেষ্টা) ডিগনিটি, ইজ্জত, ওনার যে কমিটমেন্ট বা ওয়াদা যেন সুরক্ষিত থাকে। আমার ওয়াদাও যাতে রক্ষিত হয়। আমিও জাতির কাছে ওয়াদা দিয়েছি।

শেয়ার করুন