৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:১৬:৪৫ অপরাহ্ন


ফিলিস্তিনি-আমেরিকান শিক্ষার্থীর প্রতি বৈষম্যের অভিযোগে মামলা
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৮-২০২৫
ফিলিস্তিনি-আমেরিকান শিক্ষার্থীর প্রতি বৈষম্যের অভিযোগে মামলা এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়


যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়াভিত্তিক খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ এনে এক প্যালেস্টিনীয়-আমেরিকান শিক্ষার্থী গত ৪ আগস্ট সোমবার ইন দ্য ইউনাইটেড স্টেটস ডিস্ট্রিক্ট কোর্টফর দ্য নর্দার্ন ডিসট্রিক্ট অব জর্জিয়া আটলান্টা ডিভিশনে মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি করেছেন এমোরি ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের এমডি/পিএইচডি শিক্ষার্থী উমায়মা মোহাম্মদ, যিনি গাজায় চলমান মানবিক সংকট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার সমালোচনা করেছিলেন। তার বক্তব্যের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করে এবং ২০২৯ সালের সম্ভাব্য স্নাতক হওয়ার সময় পর্যন্ত তাকে পর্যবেক্ষণে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। মামলার বিবাদীরা হলেন, ইমোরি ইউনিভার্সিটি, ইমোরি ইউনিভার্সিটি বোর্ড অব ট্রাস্টিস, এবং জন উইলিয়াম ইলে।

শিক্ষার্থী উমায়মা মোহাম্মদের আইনজীবীদের দাবি, এ সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নীতির পরিপন্থী এবং ১৯৬৪ সালের সিভিল রাইটস অ্যাক্টের টাইটেল সিক্স ধারা অনুযায়ী অবৈধ বৈষম্যের শামিল। এই আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি অর্থায়নের অধীনে পরিচালিত হলে তা জাতিগত, ধর্মীয় কিংবা জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য করতে পারে না। মামলায় বলা হয়, মোহাম্মদ তার প্যালেস্টিনীয় পরিচয় এবং গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে এমোরি তার প্রতি একতরফাভাবে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।

মামলার পটভূমিতে দেখা যায়, ২০২৪ সালের এক সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের সমালোচনা করেন যিনি ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সে (আইডিএফ) স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, এই শিক্ষক গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধ্বংস এবং চিকিৎসকদের হত্যার সঙ্গে জড়িত বাহিনীতে কাজ করেছেন এবং এখন এমোরিতে চিকিৎসা শিক্ষাদান করছেন। এরপর ওই অধ্যাপক একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন, যাতে উল্লেখ করা হয় যে মোহাম্মদের বক্তব্য তার ও তার পরিবারের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

বাদী শিক্ষার্থী উমায়মা মোহাম্মদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমে অভিযোগ ছিল এক ধরনের, পরে তা বদলানো হয়, আবার এক পর্যায়ে তাকে বলা হয় হয় দোষ স্বীকার করতে হবে, নয়তো শুনানির মুখোমুখি হতে হবে। তিনি শুনানির পথ বেছে নিলে আবার অভিযোগ পরিবর্তন করা হয় বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ১২ নভেম্বর একটি শৃঙ্খলা কমিটি মোহাম্মদকে পেশাগত আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং অন্যের অধিকারের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে। এরই ফল হিসেবে তাকে এক বছরের বহিষ্কারাদেশ এবং প্রবেশযোগ্য পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। মোহাম্মদ বলেন, গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে মুখ খুলে আমি যে শাস্তি পেলাম, তা শুধুই অন্যায়ের নয়, এটি এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক ব্যর্থতা। চিকিৎসা পেশায় যুক্ত সবাইকে গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় ন্যায়বিচারের পরিবর্তে নীরবতা, শাস্তি এবং নিশ্চিহ্নকরণকে বেছে নিয়েছে।

এ মামলায় মোহাম্মদের পক্ষে আইনি সহায়তা দিচ্ছে কেয়ার জর্জিয়া এবং মানবাধিকার সংস্থা প্যালেস্টাইন লিগ্যাল। তারা দাবি করছে, মোহাম্মদের মতামত প্রকাশের অধিকার হরণ করা হয়েছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি করেছে। তারা আরো অভিযোগ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে চাপ প্রয়োগ করে দোষ স্বীকার করতে বাধ্য করতে চেয়েছিল এবং প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতি ও স্বচ্ছতার অভাব ছিল।

উল্লেখ্য, এই ঘটনার আগে ২০২৪ সালে কেয়ার এবং প্যালেস্টাইন লিগ্যাল একটি পৃথক অভিযোগ দায়ের করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগের অফিস ফর সিভিল রাইটসের (ওসিআর) কাছে, যেখানে এমোরি ক্যাম্পাসে মুসলিম ও প্যালেস্টিনীয় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক পরিবেশ থাকার অভিযোগ আনা হয়। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ওসিআর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছায়। সমঝোতা অনুযায়ী, এমোরিকে তাদের প্রতিবাদ নীতি, বৈষম্য নীতি এবং অভিযোগ গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওসিআর একটি চিঠিতে উল্লেখ করে, এমোরির ক্যাম্পাসে কিছু ঘটনার কারণে প্যালেস্টিনীয়, আরব এবং মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। চিঠিতে আরো বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা ঘটিত সহিংসতা অপ্রয়োজনীয় এবং তা একটি ভয়ভীতি ও বৈষম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে পারে।

কেয়ার-জর্জিয়ার আইনজীবী কেয়ন গ্র্যান্ট বলেন, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয় যে ধারাবাহিকভাবে প্রো-প্যালেস্টাইন ছাত্রদের কণ্ঠরোধ করছে, এই মামলাটি তারই প্রমাণ। তারা একদিকে বাইরের ন্যায়ের আবেদন অগ্রাহ্য করছে, অন্যদিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ নীতিও ভঙ্গ করছে। এই মামলা কেবল মোহাম্মদের জন্য নয়, বরং সব ছাত্রছাত্রীর মতো প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

মামলায় বাদী মোহাম্মদের পক্ষ থেকে জুরি ট্রায়ালের আবেদন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া বহিষ্কারাদেশ বাতিল করে তার শিক্ষাজীবন পুনর্বহালের আবেদন জানানো হয়েছে। এমোরি বিশ্ববিদ্যালয় এই বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে শিক্ষার্থীদের একাংশ ও কয়েকজন শিক্ষক মোহাম্মদের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন এবং বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের মতে, মোহাম্মদের বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার পরিপন্থী নয়, বরং সেটি একটি নৈতিক অবস্থান, যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজে স্বীকৃত হওয়া উচিত।

এই মামলাটি যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য, এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি প্রতিষ্ঠানের সহিষ্ণুতার প্রশ্নগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। মামলাটি কেবল উমায়মা মোহাম্মদের শিক্ষাজীবনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না, বরং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে মানবাধিকার ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি নজির স্থাপন করতে পারে।

শেয়ার করুন