৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:০৭:০২ অপরাহ্ন


বিচারে চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ
হাসিনার নির্দেশে গুলি ও হত্যা
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৮-২০২৫
হাসিনার নির্দেশে গুলি ও হত্যা শেখ হাসিনা


‘হাজার হাজার মানুষ মারার’ অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার চাইলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়া মাইক্রোবাসচালক খোকন চন্দ্র বর্মণ।

মামলার এই সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, ‘যারা হাজার হাজার মানুষকে মারলো সেই শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, কাউয়া কাদের (ওবায়দুল কাদের), পুলিশের সাবেক প্রধান চৌধুরী আবদুুল্লাহ আল মামুন ও শামীম ওসমানের বিচার চাই। তারা দায়ী, তাদের বিচার চাই।’

গত ৩ আগস্ট রোববার বেলা সোয়া ১১টায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে সকাল পৌনে ১১টায় ট্রাইব্যুনালে আসেন অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। মামলার শুনানির শুরুতেই বক্তব্য রাখেন তিনি।

অ্যাটর্নি জেনারেল তার বক্তব্যে বলেন, ‘এ স্বৈরাচার শুধু পালিয়ে যায়নি, তার কেবিনেট সদস্য, শপথবদ্ধ সংসদ সদস্য সবাই পালিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন স্বৈরাচারের জন্ম হয়নি।’ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ আইন কর্মকর্তা শেখ হাসিনাসহ এ মামলার তিন আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। পরে এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

তিনি বলেন, ‘এ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এর মধ্য দিয়ে আমরা প্রমাণ করবো যে, বাংলাদেশের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্পৃহা একটি জীবন্ত অঙ্গীকার। যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলমান থাকবে।’ ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘিরে নিহত ও আহতদের নিয়ে একটি ডকুমেন্টারিও প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া প্রথম সাক্ষীর গুলিবিদ্ধ অবস্থার একটি ভিডিও দেখানো হয় টেলিভিশনের মনিটরে। এ মামলার তিন আসামির মধ্যে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়েছে।

মামলার একমাত্র গ্রেফতার আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুুল্লাহ আল মামুনের উপস্থিতিতেই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের এজলাসে আসামির কাঠগড়ায় চেয়ারে বসে বিচারের সব কার্যক্রম দেখছিলেন তিনি। বরাবরের মতোই সাদা, লাল, কালো রঙের চেক শার্ট পরিহিত পুলিশের এই সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে শুনানির সময় কখনো চোখ বন্ধ অবস্থায় থাকেন; আবার কখনো তার সামনে থাকা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। চৌধুরী মামুন এ মামলায় অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেবেন বলে এর আগে ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছিলেন। এদিন এ মামলায় সাক্ষীর জবানবন্দি শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সব শুনানি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

এদিকে এই বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত দাবি করে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়েছে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ। রোববার এক বিবৃতিতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অন্যতম একজন মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন হিসেবেই মনে করছেন তারা।

‘পুলিশ আমার মাথা টার্গেট করে গুলি করে’

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোবাসচালক ২৩ বছর বয়সী খোকন চন্দ্র বর্মণ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন বলে তার জবানবন্দিতে জানান। নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ১৮ ও ১৯ জুলাই তিনি আন্দোলনে অংশ নেন। জবানবন্দিতে তিনি জানান, ৫ আগস্ট সেখানে আন্দোলনের একপর্যায়ে তারা ঢাকায় রওনা দেন। কিন্তু পুলিশ ও বিজিবি বাধা দেয়। পরে ছাত্র-জনতার ঢল বেড়ে গেলে বিজিবি তাদের যাওয়ার অনুমতি দেয়। যাত্রাবাড়ী পৌঁছে তারা ‘ভুয়া, স্বৈরাচার’ বলে সেøাগান দিলে পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করা হয় বলে জবানবন্দিতে জানান খোকন বর্মণ।

তিনি জানান, এ সময় ‘গুলিতে একজনের মাথার পাশে দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। মনে হচ্ছে যেন একটা গরু জবাই করছে। এগুলো বের হয়ে আরেকজনের গায়ে লাগছে।’ খোকন বর্মণ বলেন, ‘একপর্যায়ে সেখানে সেনাবাহিনী আসে। পুলিশের ওপর সেনাবাহিনী গুলি করে।’ তবে এ বক্তব্যের একপর্যায়ে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম তা সংশোধন করে বুঝিয়ে বলেন বিষয়টি হবে, ‘সেনাবাহিনী ফাঁকা গুলি করে পুলিশকে চলে যেতে বললো।’

সাক্ষীর কথা সংশোধন করে দেওয়ার আগে অবশ্য প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে জানিয়েছিল, মুখমণ্ডল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সাক্ষীর অনেক কথা স্পষ্ট নয়। বক্তব্য সংশোধনের পর ঘটনার বর্ণনার ধারাবাহিকতায় সাক্ষী খোকন বর্মণ বলেন, একপর্যায়ে পুলিশ যাত্রাবাড়ী থানায় চলে যায়। কিছুক্ষণ পরই শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর এলে যাত্রাবাড়ী থানা থেকে পুলিশ বের হয়ে ছাত্র-জনতার ওপর পাখির মতো গুলি করতে থাকে। একপর্যায়ে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে পিলারের পেছনে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি এবং তার সঙ্গী আন্দোলনকারীরা।

এ পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে একজন পুলিশ আমার মাথা টার্গেট করে গুলি করে কিন্তু আমার মুখে লাগে। আমি ছটফট করতে থাকি। বাঁচার অবস্থা ছিল না।’ তিনি তার মুখের মাস্ক খুলে ট্রাইব্যুনালকে দেখান। গুলিতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মুখমণ্ডল। গুলিতে তার বাঁ চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, আরেক চোখে দূরের জিনিস দেখেন না। ক্ষতিগ্রস্ত নাক ও মুখও তিনি ট্রাইব্যুনালকে দেখান। হাত নাড়িয়ে ও তার চিৎকারে ছাত্ররা এগিয়ে এসে তাকে ধরে ওঠায় বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন তিনি। পরে তার পকেট থেকে ফোন বের করে পরিবারকে খবর দেওয়া হয়। তাকে মুগদা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তার অবস্থা খারাপ দেখে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে খোকনকে পাঠানো হয় মিরপুর ডেন্টাল হাসপাতালে।

খোকন বর্মণ বলেন, ১০ দিন পর তাকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি অনেকদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর মধ্যে ১০ দিন আইসিইউতে ছিলেন। তার চিকিৎসা শেষ হয়নি এবং এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন। গত ২১ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকার তাকে চিকিৎসার জন্য রাশিয়ায় পাঠায়। ৭ এপ্রিল দেশে ফেরেন তিনি। এছাড়াও ১২ আগস্ট আবার চিকিৎসার জন্য রাশিয়া যাবেন এবং ১৮ আগস্ট সেখানে তার আরেকটি অপারেশন হবে বলে ট্রাইব্যুনালকে জানান তিনি। জবানবন্দির শেষে তিনি শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সংশ্লিষ্ট সবার বিচার দাবি করেন। পরে তাকে জেরা করেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।

আইনজীবী তার জেরায় দাবি করেন পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করেনি। বরং আন্দোলনকারীদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র, দেশীয় অস্ত্রে ‘নিজেরা’ আহত এবং নিহত হয়েছেন। তখন সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘এটা সত্য নয়।’ একই সঙ্গে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানসহ অভিযুক্তরা দায়ী নন, তিনি সত্য গোপন করে অসত্য জবানবন্দি দিয়েছেন দাবি করলে সাক্ষী বলেন, ‘সত্য জবানবন্দি দিয়েছি।’

এছাড়া সাক্ষী যে তিনদিন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন সেদিন বন্ধের দিন ছিল না-এমন প্রশ্ন করলে খোকন বর্মণ জানান, তখন আন্দোলনের সময় গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রাশিয়ার চিকিৎসাসংক্রান্ত ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে কিছু কাগজ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, রাশিয়ার চিকিৎসকরা তার মুখ থেকে চারটি গুলি বের করে। পরে জেরা শেষ হলে সোমবার পর্যন্ত শুনানি মুলতুবি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

সর্বোচ্চ শাস্তি চাইলেন অ্যাটর্নি জেনারেল

শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল তার দেওয়া বক্তব্যে আজকের দিনটিকে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘ন্যায়বিচারের ধারণা এমন না যে শুধু রাষ্ট্রপক্ষ ন্যায়বিচার পাবে তা না, বাংলাদেশের সব মানুষ ন্যায় বিচার পাবে এটাই ন্যায়বিচারের ধারণা।’ হিটলারসহ ইতিহাসের বিভিন্ন স্বৈরাচারের নাম তুলে ধরে তিনি শেখ হাসিনাকে তাদের সঙ্গে তুলনা করেন। ১৬৪৯ সালে অলিভার ক্রমওয়েলের ঘটনা তুলে ধরে রাষ্ট্রের এ আইন কর্মকর্তা বলেন, কবর থেকে তার পচা গলা লাশ তুলে এনে জনসমক্ষে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে তার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা হয়েছিল। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মৃত্যুদণ্ডের বিধান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ‘আমরা হয়তো অলিভার ক্রমওয়েলের মতো মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো নির্মম আমরা নই। তবে আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি আইনি কাঠামোতে চাই।’ কোনো স্বৈরাচারকে মিথ্যার ওপর পিএইচডি করতে হলে তাকে শেখ হাসিনার কাছে শিখতে হবে বলে তার বক্তব্যে তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে চব্বিশের মানবতাবিরোধী অপরাধের ন্যায়বিচার দাবি করেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ কর্মকর্তা।

‘আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার মানেই ন্যায়বিচার বঞ্চিত হওয়া নয়’

পরে সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম দাবি করেন, আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার মানেই ন্যায়বিচার বঞ্চিত হওয়া নয়। তিনি শেখ হাসিনাকে সব অপরাধের ‘নিউক্লিয়াস’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এই ট্রাইব্যুনালের কার্যধারায় দুইজন আসামির অনুপস্থিতিতে এ বিচার কোনোভাবেই অপরাধীর জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য বাধা হতে পারে না এবং হবে না। এই ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী রায় প্রদানের পূর্ণ ক্ষমতা রাখে।’ দুইজন আসামি আদালতের ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ না করে বারবার অনুপস্থিত আছেন বলে উল্লেখ করেন মি. ইসলাম। ‘স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন আসামিদের ইচ্ছাকৃত পলায়ন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা এ ট্রাইব্যুনালের সত্য অনুসন্ধান এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতের গুরু দায়িত্বকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। ন্যায়বিচারের হাত দীর্ঘ অনুপস্থিতি বা উদাসীনতা তাকে আটকাতে পারবে না’-বলেন তাজুল ইসলাম।

তিনি শেখ হাসিনার কথোপকথনের বক্তব্য তুলে ধরেন। যাতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে। এ বিচার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেনে পরিচালিত হবে বলে জানান তিনি। শুনানির সময় রোববার ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন চিফ প্রসিকিউটরের বিশেষ উপদেষ্টা টবি ক্যাডম্যানও। এর আগে গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগে চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

পারভীন বলেন পুলিশ এমনভাবে 

গুলি করে যেন খই ফুটছিল

সাক্ষী গ্রহণের দ্বিতীয় দিনে পারভীন নামের এক নারী সাক্ষ্য দেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় জুলাইয়ের একদিন রাজধানীতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একটা ছেলেকে পড়ে থাকতে দেখেন পারভীন। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যেতে চান তিনি। আহত ওই ছেলেটাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতেই থাকে পুলিশ। সেসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে বাম চোখ হারানো ওই নারী সেদিনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। আন্দোলনের ওই সময়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বসবাসরত পারভীনের ভাষ্য, ‘পুলিশ ছেলেটাকে এমনভাবে গুলি করছিল, মনে হচ্ছিল খই ফুটছিল। টুস টুস শব্দ হচ্ছিল।’

পরে ঘটনাস্থলে ওই নারীও গুলিবিদ্ধ হন। এতে তার বাম চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ডান চোখও। ৪ আগস্ট সোমবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং ঘটনাস্থলে দেখা দৃশ্যের বর্ণনা তুলে ধরেন। আন্দোলন দমনে ১ হাজার ৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে। এছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এ মামলার আসামি।

এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ৩ আগস্ট। দ্বিতীয় দিন সোমবার পারভীনের আগে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ইমরান সাক্ষ্য দেন। এদিন সাক্ষ্য দিতে স্বামীকে নিয়ে আদালতে হাজির হন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা পারভীন।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, আন্দোলনের আগে থেকে স্বামীকে নিয়ে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীর বউবাজার এলাকায় বাস করতেন। তাদের দুটি পুত্রসন্তান আছে। তিনি দিনমজুরের কাজ করতেন। রোজগারের মতো বাসার কাজ শেষ করে ১৮ জুলাই সকালে লেগুনাতে করে জুরাইন কাজে যান। ৫টায় কাজ শেষ করে লেগুনা স্ট্যান্ডে আসেন। এসে লেগুনা না পেয়ে পেয়ে হেঁটে রওনা দেন বাসার উদ্দেশে। যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত এসে দেখতে পান, অনেক মানুষ আহত হয়ে পড়ে আছে।

ওই সময়ের বর্ণনায় তার ভাষ্য, ‘রক্ত দেখে মনে হয়েছে গরু জবাই হয়েছে। কারো হাত নাই, কারো পা নেই, কারো মাথায় রক্ত। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে ১৮/১৯ বছরের একটা ছেলে আহত হয়ে পড়ে আছে। সে বাঁচার জন্য চিৎকার করছে। সাদা শার্ট, প্যান্ট পরিহিত ছেলেটি রক্তে ভেজা। চোখ দিয়েও রক্ত বের হচ্ছিল।’ তাকে দেখে পারভীনের মায়া হয়, দৌড়ে যান। ওকে যখন ধরেন তখন সে বাঁচার আকুতি জানান। তিনি তাকে টেনে তোলেন। ছেলেটি তার মাথা পারভীনের ঘাড়ে রাখে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেন কোথাও কিছু (যানবাহন) আছে কি না।

তিনি বলেন, ‘তখন ১৪-১৫ জন সশস্ত্র পুলিশ মারমুখী হয়ে ছেলেটাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি ছেলেটার পিঠে লাগে। পুলিশ ছেলেটাকে এমনভাবে গুলি করছিল, মনে হচ্ছি খই ফুটছিল, টুস টুস শব্দ হচ্ছিল। বাম হাত তুলে পুলিশকে বলি আর গুলি কইরেন না। একটা পুলিশ সাইড হয়ে চোখ বরাবর গুলি করে। গুলি বাম চোখে এসে লাগে।’ এ সময় মাঝবয়সী ওই নারী কান্নায় ভেঙে পড়েন। ধরা গলায় ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘২-৩ জন মিলে আরো গুলি করে। তলপেটসহ আরো কয়েক জায়গায় গুলি লাগে। চোখ থেকে এমনভাবে রক্ত বের হচ্ছিল যেন ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল।’

ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় পারভীন বলেন, তিনি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে তিনি দুর্বল হয়ে যান। পরে ছেলেটিসহ তিনি মাটিতে পড়ে যান। ছেলেটা জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে এমনভাবে হাত চেপে ধরে। পরে শরীর থেকে হাত ছেড়ে দেয়। তার মনে হয়েছে ছেলেটা তখনি মারা গেছে। এদিকে ব্যথার যন্ত্রণায় বাঁচাও বাঁচাও করে চিৎকার করে ছটফট করছিলেন তিনি।

এ বর্ণনা দেওয়ার সময় আরেক দফা কাঁদতে শুরু করেন ওই নারী। বলেন, তখন অনেক মানুষ আসে। অনেকে বলে ছেলেটা মারা গেছে। তাকে জীবিত দেখে সিএনজিতে করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর তার চোখের ওষুধের জন্য ২৫০ টাকার একটি ড্রপের প্রয়োজন ছিল। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ঠিকমতো চিকিৎসা দেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তখন হাসপাতালে একজন নারী এসে তাকে ড্রপ কিনে দেন। চোখে ড্রপ দেওয়া হলে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন পারভীন। ওইদিন হাসপাতালের বারান্দায় পড়েছিলেন তিনি। বমি করতে থাকেন। এমন অবস্থা দেখে সেখানকার একজন ফোন নম্বর নিয়ে তার স্বামীকে ফোন করেন, যিনি তখন বরিশালে ছিলেন। পরদিন সকাল ১০টায় হাসপাতালে এসে পৌঁছান।

চিকিৎসক পারভীনের চিকিৎসার জন্য কিছু জিনিসপত্র কিনে আনতে বলেন। তবে পারভীনের স্বামীর কাছে টাকা ছিল না। তিনি যাত্রাবাড়ীর বাসায় গিয়ে পারভীনের কানের দুল বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার সময় তাকে মারধর করে কয়েকজন। এতে তার তিনটা সেলাই লাগে।

পারভীন বলেন, তার চোখে অপারেশন হয়। চোখ থেকে তিনটা গুলি বের করা হয়। চিকিৎসকরা বলেন, চোখে আরো গুলি আছে। তারা ৩-৪ দিন রেখে তাকে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। তারা কয়েকটা পরীক্ষা দেন। সিটিস্ক্যানে দেখা যায়, তার চোখে আরো গুলি আছে। পরদিন সকালে চিকিৎসক তাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা বলেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রোপচার হয়নি। ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অপারেশন হয়। অপারেশন করে চোখ থেকে একটি গুলি বের হয়।’ তলপেটের গুলির বিষয়ে আদালত জানতে চাইলে তিনি বলেন, তলপেটের গুলি অস্ত্রোপচার করা হয়নি।

পারভীন আদালতকে বলেন, তিনি ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এ অবস্থায় আদালতে এসেছেন ন্যায়বিচারের জন্য। চিকিৎসার অভাবে বাম চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ডান চোখে আবছায়া দেখেন। তার অন্ধ হওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করেন তিনি। বলেন, তার দুই সন্তানের কাছে জীবনভর অন্ধ হয়ে গেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা পুলিশের বাপ-মা। তার নির্দেশ ছাড়া পুলিশ গুলি করে না। তার নির্দেশে পুলিশ গুলি করে হাজার হাজার মানুষকে আহত ও নিহত করেছে। দুই সন্তানও মায়ের অন্ধত্বের বিচার চায়। এ সরকার থাকাকালে যেন শেখ হাসিনার বিচার হয়। বিচার না হলে সন্ত্রাস বেড়ে যাবে। সঠিক বিচার যদি না হয় তাহলে ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে তারাও একইভাবে মানুষ হত্যা করতে দ্বিধা করবে না। ভাববে হত্যা করলে বিচার তো হয় না।

এরপর আসামিদের পক্ষে তাকে জেরা করেন তাদের আইনজীবী আমির হোসেন। তার সাক্ষ্য শেষে বুধবার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলি গাজী এম এইচ তামিম। এর আগে এদিন ঢাকা কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ইমরান সাক্ষ্য দেন। রোববার সাক্ষ্য দেন খোকন চন্দ্র বর্মণ।

মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে পলাতক দেখানো হয়েছে। গ্রেফতার সাবেক আইজিপি মামুন রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছেন। মামলায় সাক্ষী রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা ও জাতীয় দৈনিকের এক সম্পাদকসহ ৮১ জন। এর মধ্যে তিনজনের সাক্ষ্য শেষ হলো।

আহতদের ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডার দিয়েছিলেন হাসিনা, সাক্ষ্যে বললেন ইমরান

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে ঢাকার বিজয়নগরে পায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর চিকিৎসা নিতে গিয়ে কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সে বর্ণনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরলেন আন্দোলনে অংশ নেওয়া ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ইমরান।

সাক্ষ্য গ্রহণের দ্বিতীয় দিন ৪ আগস্ট সোমবার আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে ইমরান বলেছেন, তিনি হাসপাতালে থাকার সময় তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দেখতে যান। কথাবার্তা বলে আন্দোলনকারী বুঝতে পেরে তিনি হাসপাতালের কর্মীদের ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডার দিয়ে যান। জুলাই অভ্যুত্থান দমাতে দমন-পীড়নের ঘটনায় দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে সোমবার জবানবন্দি দেন ঢাকা কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ইমরান।

স্বাভাবিক হাঁটার ক্ষমতা হারানোয় হুইল চেয়ারে করে এসে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের সামনে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি। ইমরান বলেন, গত বছর জুলাই মাসে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে প্রথম থেকেই তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯ জুলাই বিকালে বিজয়নগর পানির ট্যাংকি এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে তার হাঁটুর নিচে গুলি লাগে।

ওই সময় দুই সহযোদ্ধাকে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যেতে দেখার কথা জবানবন্দিতে তুলে ধরেন ইমরান। তিনি বলেন, অন্যরা তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে গেলেও কেউ ভর্তি নিচ্ছিল না। পরে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসরা পা কেটে ফেলার কথা বলেন।

এ শিক্ষার্থী বলেন, ওই সময় তার পা হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত চামড়ার সঙ্গে ঝুলছিল, মনে হচ্ছিল ভেতরে হাড় আর নেই। সে কারণে তারও মনে হচ্ছিল, পা কেটে ফেলার কোনো বিকল্প বোধহয় নেই।

তবে তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা পা কাটার অনুমতি দিচ্ছিলেন না। তখন দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তাকে পঙ্গু হাসপাতালে (জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান) নিয়ে যেতে বলেন।

ইমরান বলেন, অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়ার সময় ধানমন্ডিতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসার সামনে যৌথবাহিনী অ্যাম্বুলেন্স আটকায়। সেখানে তাদের প্রায় এক ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। তাদের মনে হচ্ছিল, হতয় ‘গুলি করে’ মেরেও ফেলতে পারে। ওই অ্যাম্বুলেন্সে ইমরানের সঙ্গে ছিলেন দুজন রক্তদাতা এবং তার দুই বন্ধু ছিল। তাদের একজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তিনি মুক্তি পান।

ইমরান বলেন, ১৯ জুলাই রাতে কারফিউ ছিল। রাত ১১টার সময় তিনি পঙ্গু হাসপাতালে পৌঁছান। সেখানে তার একটি অস্ত্রোপচার হয়। চিকিৎসকরা বুঝতে পারছিলেন না, তার পা রক্ষা করার কোনো উপায় আছে কি না। এরপর চিকিৎসকরা তাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠান। সেখানে তারা তার স্নায়ু পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন, পা-টা বাঁচানো সম্ভব। তখন তাকে আবার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। ওই রাতে তার আরেকটি অস্ত্রোপচার হয়। এভাবে চলতে থাকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত।

যারা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, ২৭ জুলাই তাদের দেখতে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আসা উপলক্ষে আগের দিন থেকে হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, দেওয়ালে রং করা, ফ্যান মোছাসহ বিভিন্ন কাজ করা হয়। তাতে ‘হয়রানির’ মধ্যে পড়তে হয় অভিযোগ করে ইমরান বলেন, ২৬ তারিখ রাতে তাদের ‘ঘুমোতে দেওয়া হয়নি’।

সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে হাসপাতালে গিয়ে আহতদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। ইমরান বলছেন, ওই সময় তার সঙ্গেও কথা বলেন তখনকার সরকারপ্রধান। ইমরানের ভাষ্য, কথা বলার সময় শেখ হাসিনাকে ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করেছিলেন তিনি। শেখ হাসিনা তখন তাকে ‘আপা’ ডাকতে বলেন।

সাক্ষ্যে ইমরান বলেন, তিনি কোথায় পড়াশোনা করেন, হলে থাকেন কি না এবং কেন হলে থাকেন না এসব বিষয়ে শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন তাকে। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, ইমরানও আন্দোলনকারী। ইমরানের কাছে শেখ হাসিনা জানতে চান, তাকে গুলি পুলিশ করেছে কি না। ইমরান তাকে বলেন, পুলিশ তাকে সরাসরি গুলি করে। পুলিশের পোশাকে অন্য কেউ ছিল কি না, সেটা তিনি জানেন না।

এই তরুণ আদালতকে বলেন, সেদিন হাসপাতালে আহত আরো ৪-৫ জনের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। পরে চলে যাওয়ার সময় হেল্প ডেস্কের কাছে গিয়ে ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডার দিয়ে যান।

ইমরান বলেন, বিষয়টি শুনতে পেলেও সে সময় বুঝতে পারেননি ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ বলতে শেখ হাসিনা কী বুঝিয়েছেন। পরে তার ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট ‘হচ্ছিল না’। তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সকাল ৮টায়। সেজন্য আগের রাত ১২টা থেকে তাকে পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি। কিন্তু ৮টার অপারেশনের কথা বলে তাকে থিয়েটারে নেওয়া হয় দুপুর আড়াইটার দিকে।

তিনি বলেন, তার পা পচে বিকট দুর্গন্ধ ছড়িয়েছিল। আশপাশের লোকজন গন্ধে থাকতে পারতো না। সরকারি যে অ্যান্টিবায়োটিক, তা তার শরীরে কাজ করছিল না। তার পা থেকে পুঁজ নিয়ে আইসিডিডিআরবিতে পরীক্ষা করানো হয়। তখন তারা বলে, তাকে দামি অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে। কিন্তু বাইরে থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে হাসপাতালে আনার অনুমতি ছিল না।

ইমরান বলেন, তার বাবা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে রিলিজ দেওয়া হয়নি। তখন বুঝতে পারেন, তাকে রিলিজ বা ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে না। তার ‘পা কেটে জেলে নিয়ে যাবে’। ৫ আগস্টের পর ইমরানকে সাধারণ ওয়ার্ড থেকে কেবিনে নেওয়া হয়। এখন যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে বলে আদালতকে জানান তিনি।

জীবনের এ পরিস্থিতির জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দায়ী করেন ইমরান। এদিন বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। ১১টা ৩৭ মিনিটে জবানবন্দি দেওয়া শুরু করেন ইমরান। ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে তার জবানবন্দি শেষ হয়। এরপর আসামিদের পক্ষে তাকে জেরা শুরু করেন আইনজীবী আমির হোসেন। প্রায় ৪৫ মিনিট জেরা করেন তিনি। এরপর পারভীন নামে ২৭ বছরের এক নারী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। তিনি জুলাই আন্দোলনে চোখ হারিয়েছেন।

তার সাক্ষ্য শেষে বুধবার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে বলে জানান ট্রাইব্যুনালের কৌসুলি গাজী এম এইচ তামিম। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রোববার এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম দিন সাক্ষ্য দেন জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ খোকন চন্দ্র বর্মণ।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এ মামলার আসামি। আন্দোলন দমনে ১ হাজার ৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ মামলায় কারাগারে থাকা একমাত্র আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে এদিন আদালতে হাজির করা হয়। সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করার শর্তে তিনি ‘রাজসাক্ষী’ হয়েছেন। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে এ মামলার বিচার শুরুর আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা ও জাতীয় দৈনিকের এক সম্পাদকসহ ৮১ জনকে এ মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে।

শেয়ার করুন