জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন মহা ইমেজ সঙ্কটে আছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের খবরে দলটি নিয়ে দেয়া নতুন নতুন তথ্যে এর নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ সমর্থকও বিভ্রান্ত হচ্ছে। কারো কারো মতে, দল-টি আত্মপ্রকাশ হতে না হতে এমন ধরনের খবর ২০২৪ জুলাই বিপ্লবের চেতনা ধারণকারীদের জন্য অনেক মন-বেদনার কারণ।
কি শোনানো হচ্ছে এনসিপি নিয়ে
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজকে ধারণ করে প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সে-ই বীর সেনা সাবেক ছাত্রশক্তি নেতা নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক করে ২০২৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ছাত্র-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল। তবে এর জন্ম নিয়ে নানান ধরনের নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হয়। বলা হয় এই দলটির পেছনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীতাকারী দল জামায়াতের ইসলামীর ছাত্র সংগঠন শিবিরের বিভিন্ন ধরনের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিক হয়েছে।
এনসিপি নিয়ে কে কি বলছেন
সম্প্রতি ‘শিবির নেতা সাদিক কায়েম সম্প্রতি একটা টক শোতে বলেছেন, ছাত্রশক্তির গঠনপ্রক্রিয়ায় শিবির যুক্ত ছিল, শিবিরের ইনস্ট্রাকশনে আমরা কাজ করতাম। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের এক ফেসবুক একটি বিষয়ের ব্যাখা দিতে গিয়ে তার দেওয়া পোস্টে ইসলামী শিবির প্রসঙ্গে কিছু কথা বলেছেন। ওই পোস্টে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তাঁর এই ফেসবুক পোস্টে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা মো. আবু সাদিক কায়েমের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন ‘শিবির নেতা সাদিক কায়েম সম্প্রতি একটা টকশোতে বলেছেন, ছাত্রশক্তির গঠনপ্রক্রিয়ায় শিবির যুক্ত ছিল, শিবিরের ইনস্ট্রাকশনে আমরা কাজ করতাম। এটা মিথ্যাচার।’ নাহিদের ভাষ্য, ‘গুরুবার আড্ডা’ পাঠচক্রের সঙ্গে জড়িত একটা অংশ এবং ঢাবি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে পদত্যাগ করা একটা অংশ মিলে ছাত্রশক্তি গঠিত হয়। সঙ্গে জাবির (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) একটা স্টাডি সার্কেলও যুক্ত হয়। একটা নতুন ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুবার আড্ডা পাঠচক্রে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা হয়েছে। এরপর নাহিদ লেখেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসে আট বছর রাজনীতি করেছি। ফলে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব সংগঠন ও নেতৃত্বকে আমরা চিনতাম এবং সব পক্ষের সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল। সেই কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। যোগাযোগ, সম্পর্ক বা কখনো সহযোগিতা করা মানে এই নয় যে তারা আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল।’
নাহিদ তাঁর ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ‘সাদিক কায়েম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিলেন না। কিন্তু ৫ আগস্ট (২০২৪) থেকে এই পরিচয় ব্যবহার করেছেন সাদিক কায়েম। অভ্যুত্থানে ছাত্রশিবিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে সাদিক কায়েমকে সংবাদ সম্মেলনে বসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সাদিক কায়েমরা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ঢালাও প্রচার করেছেন যে এই অভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরই নেতৃত্ব দিয়েছে; আমরা সামনে শুধু পোস্টার ছিলাম। অভ্যুত্থানে শিবিরের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করেনি, কিন্তু এই অভ্যুত্থান শিবিরের একক নয়, শিবিরের ইনস্ট্রাকশন বা ডিরেকশনেও হয়নি। আমরা সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেই সিদ্ধান্ত নিতাম।’
সাদিক কায়েম যা বললেন
এদিকে নাহিদের এমন বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে শিবিরের নেতা সাদিক কায়েম একটি বহৃল প্রচারিত দৈনিকে বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নীতিনির্ধারণ, মাঠপর্যায়ে সমন্বয়সহ বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মাহফুজ আলম (বর্তমান অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টা), নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদদের (সরকারের উপদেষ্টা) সঙ্গে আমাদের আলাপ হতো। সমন্বয়ক তালিকা যখন তৈরি করা হয়, তখন এটা নিয়েও মাহফুজের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়। এরপর ১৯ জুলাই থেকে ১ আগস্ট (২০২৪) পর্যন্ত প্রথম সারির সমন্বয়কদের অনুপস্থিতিতে কর্মসূচি প্রণয়ন, তা গণমাধ্যমে পৌঁছানো, সমন্বয়কদের সেইফ হোমে রাখার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছি।’ সাদিক কায়েম দাবি করেন, সে সময় সম্ভাব্য সব অংশীজন, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি যোগাযোগ রেখেছিলেন। তাঁর মতে, নাহিদ ইসলাম এসব কথাবার্তা বলে নিজেই নিজের ক্ষতি করছেন।
ট্রেন ভাড়া করা নিয়েও প্রশ্ন
এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে, ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে সারা দেশ থেকে ছাত্র-জনতা আনতে আট জোড়া ট্রেন ভাড়া করেছে সরকার। এসব ট্রেনে করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ছাত্র-জনতাকে আগামী মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) দুপুরের মধ্যে ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। আবার কর্মসূচি শেষে এসব ট্রেনে করে তাঁদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হবে। ৮ জোড়া ট্রেনের জন্য প্রায় ৩০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। ৫ আগস্ট রাজধানীর জাতীয় সংসদের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ৫ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণাপত্র পাঠ করতে পারেন। এই অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা উপস্থিত থাকবেন। এর আগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলটির ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সমাবেশগুলোয় মানুষ আনতে ট্রেন ভাড়া করত। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল তাদের কর্মসূচিতে লোক আনতে নির্ধারিত টাকা দিয়ে ট্রেন ভাড়া করে। তবে এবারের ট্রেন ভাড়া করে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে সারা দেশ থেকে ছাত্র-জনতা আনার প্রক্রিয়া অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছেন।
টিআইবি’র মন্তব্য
জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে সারা দেশ থেকে এভাবে ট্রেনে করে ছাত্র-জনতাকে এভাবে নিয়ে আনার বিষয়ের সাথে এনসিপি কতটা জড়িত আছে তা হয়তবা জানা যাবে। তবে এনসিপি ‘কিংস পার্টি’, তাদের দুজন সরকারে: টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের এমন মন্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় বইছে। গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায় যে, টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল বা কিংস পার্টি গঠন করা হয়েছে। এই কিংস পার্টি কারা-এ প্রশ্ন করেন একজন সাংবাদিক। জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা গোপন করার কিছুই নেই। এটি জাতীয় নাগরিক পার্টি, তার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে কিংস পার্টি। কারণ, এর সঙ্গে সহযোদ্ধা বা সহযাত্রী হিসেবে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে দুজন সরকারে এখন আছেন। সে হিসেবে কিংস পার্টি।’
পিটার হাসের সাথে বৈঠকের গুজব
এদিকে এনসিপি কিংস পার্টি? এমন খবরের বিষয়টি সুরাহা হতে না হতে কক্সবাজারে একটি হোটেলে ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে আরেক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও একে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। ‘পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক’ ইস্যুতে গণমাধ্যকে তিনি জানিয়েছেন, তারা কক্সবাজারে এসেছেন ঘুরতে। তিনি বলেন, ‘পিটার হাসের সঙ্গে আমাদের কোনো মিটিং হয়নি। পুরোটাই গুজব ও প্রোপাগান্ড। আমরা ঘুরতে এসেছি। হোটেলে চেক-ইন করে এমন নিউজ দেখলাম। এটা গুজব।’ তবে এরপরেও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। পুরো বিষয়গুলো আসলে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিকে নানান সন্দেহের জালে আবদ্ধ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপি’কেই এখন প্রমাণ করতে হবে তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক দল। এদের পেছনে কোনো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি নেই। এর পাশাপাশি বুঝিয়ে দিতে হবে তারা কিংস পার্টিও না। তা নাহলে তাদের রাজনৈতিক ইমেজ বিশেষ করে বলা হয়ে থাকে যে বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্বেই হয়েছিল সেই গণঅভ্যুত্থান। আর সেই প্ল্যাটফর্মের শীর্ষ সমন্বয়কারীদের নিয়েই গঠিত যে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তার ইমেজ বা সুনাম প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে। আর তা করা গেলে সামনের দিনগুলিতে আরও খারাপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে-এমনটাই মনে করে বিশ্লেষকরা।