দেশের প্রমাণিত গ্যাস মজুত আশঙ্কাজনকভাবে দ্রুত নিঃশেষ হতে চলেছে। ভুল পরিকল্পনা এবং ভ্রান্ত ব্যবস্থাপনার কারণে এলএনজি আমদানি কৌশল ব্যর্থ। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের উল্লেখজনক অংশ নতুন অনুসন্ধান কাজে এবং এলএনজি আমদানিতে ব্যয় করায় সে খাতেও এখন যথেষ্ট সঞ্চিত অর্থ নেই চলমান গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে বরাদ্দ করার জন্য। জানা গেছে, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জমা হওয়া ১৭ হাজার ৭০৮ কোটি টাকার ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যয় করা হলেও প্রমাণিত গ্যাসসম্পদ খুব একটা বৃদ্ধি পায়নি। ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে এলএনজি আমদানিতে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা জমা আছে। এ অর্থ পেট্রোবাংলা বাস্তবায়নাধীন গ্যাসকূপ খননের জন্য অপ্রতুল। আবার এলএনজি আমদানির জন্য অর্থ প্রয়োজন। পেট্রোবাংলার বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে দৃশ্যমান ভোক্তাদের কাছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ বিল বকেয়া আছে. ১০ শতাংশ গ্যাস সিস্টেম লস আছে, যার বিশাল অংশ চুরি এবং অবৈধ ব্যবহার।
অন্তর্বর্তী সরকার চলেছে গতানুগতিক ধারায়। অনেকের ধারণা পেট্রোবাংলার শীর্ষ পর্যায়ে বিগত সময়ের ব্যর্থ কর্মকর্তারা শীর্ষ পর্যায়ে নিয়োজিত থেকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। জানা মতে, ৮ টিসিএফের কম প্রমাণিত মজুত অবশিষ্ট আছে। গত দেড় দশক ধরে গ্যাসের প্রমাণিত মজুত উন্নত কারিগরি প্রযুক্তি ব্যবহার করে নবায়ন করা হয়নি। ১.২-১.৫ টিসিএফ গ্যাস সঞ্চিত আছে গ্রিড বিচ্ছিন্ন ভোলা দ্বীপ অঞ্চলে। বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা কমবেশি ৪ হাজার এমএমসিএফডি। দেশীয় উৎপাদন এখন ১ হাজার ৮০০ এমএমসিএফডি। প্রতিদিন উৎপাদন কমছে। দুটি ভাসমান এফেসারু দিয়ে ১০০০-১০৫০ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করা সম্ভব। সাগর উত্তাল থাকলে অথবা অর্থের জোগানে ভাটা পড়লে সেটিও অনিশ্চিত হয়ে পরে। এখন দৈনিক গ্যাসের ঘাটতি কমবেশি ১ হাজার এমএমসিএফডি। সংকট বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার, শিল্প সব ক্ষেত্রে। সম্প্রতি পেট্রোবাংলা প্রকাশিত তথ্যে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সিস্টেম লস এবং অ্যাকাউন্টস রিসিভেবল স্বীকার করা হয়েছে। পেট্রোবাংলার ৫০ এবং ১০০ গ্যাস খনন প্রকল্প চলছে গতানুগতিক ধারায়। বর্তমান অবস্থায় ২০২৬ জুন অথবা ২০২৮ ডিসেম্বরে প্রকল্প দুটি শেষ হওয়ার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। গ্যাস সরবরাহ চেনের বর্তমান পরিস্থিতিতে বর্তমান চালু শিল্পগুলো যখন গভীর সংকটে তখন ২০৩০ পর্যন্ত শিল্প উদ্যোক্তারা কোনো কোন নতুন গ্যাসভিত্তিক শিল্প স্থাপনের ঝুঁকি নেবে না।
কেন অন্তর্বর্তী সরকার ১০ শতাংশ সিস্টেম লস কমানোর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলো? সিস্টেম লসের প্রধান অংশ চুরি, অবৈধ ব্যবহার। গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তা কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এতো বিপুল পরিমাণ গ্যাস চুরি অসম্ভব। ২০১০-২০২৪ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি সেক্টরে কর্মরত মন্ত্রী, সচিব, পেট্রোবাংলার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা সিস্টেম লসের দায় ভার এড়াতে পারবে না। অন্তর্বর্তী সরকার কোনো ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে কেন ব্যর্থ হলেন?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার হাল ছেড়ে দিয়েছে। বর্তমান উদ্যোগসমূহ বাস্তবায়িত হলেও ২০৩০ নাগাদ গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি বর্তমান অবস্থা থেকে যে উন্নত হবে না তার প্রমাণ আছে পেট্রোবাংলার সদ্য প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের বরাদ্দ থেকে নতুন গ্যাসকূপ উন্নয়নের খরচ মেটানো সম্ভব হবে না। আবার এলএনজি আমদানি বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। নতুন এফেসারও বর্তমান অবস্থায় ২০২৯-এর আগে চালু হবে না। মাতারবাড়ীতে ভূমিভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল বর্তমান অবস্থায় ২০৩১-এর আগে চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সরকার ভোলার গ্যাস গ্রিড সংযুক্তির কাজেও দ্বিধান্বিত। ছাতক টেংরাটিলা অনুসন্ধান বা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অনুসদ্ধান নিয়েও চলছে ধরি মাছ না ছুঁই পানি কৌশল।
সার্বিক বিচারে ২০২৭ থেকে ২০৩০ গ্যাস সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকবে। দেশের বিশেষজ্ঞরা গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সতর্ক করে আসছে। এনার্জি মাফিয়া সিন্ডিকেট প্রভাবিত সরকার উপেক্ষা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার সময় পার করলো গতানুগতিক ধারায়।
নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার দায়িত্ব নিয়ে জ্বালানি খাত উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। পেট্রোবাংলার কার্যক্রমে নির্মোহভাবে যোগ্য দক্ষ সৎ কর্মকর্তাদের পদায়ন করে যথাযথ প্রণোদনা দিয়ে কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে। গ্যাস সরবরাহ চেন থেকে চুরি অপব্যবহার চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে নির্মূল করতে হবে। গ্যাসনিরাপত্তা তথা জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে শিল্পখাত মুখ থুবড়ে পড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।