৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:১২:২৯ অপরাহ্ন


অভিযোগ তদন্ত সংস্থার
শেখ হাসিনা প্রধান মাস্টারমাইন্ড ও হুকুমদাতা
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৫-২০২৫
শেখ হাসিনা প্রধান মাস্টারমাইন্ড ও হুকুমদাতা শেখ হাসিনা


জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ এনেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। তিনি মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করেছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন। তদন্ত সংস্থা ১১ মে রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সংবাদ সম্মেলন করেন তাজুল ইসলাম। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই প্রথম কোনো মামলায় তদন্ত শেষ হলো।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এই মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়েছে। তাজুল ইসলাম জানান, তদন্ত প্রতিবেদনে আসা তথ্য ও অভিযোগ যাচাই - বাছাই করে চূড়ান্ত করার পর আনুষ্ঠানিকভাবে তা দাখিল করা হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এর পরে শুরু হবে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম।

সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। জুলাইয়ে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের উস্কানিদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এক নম্বর অভিযোগ আনা হয়েছে। তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) এই মানবতাবিরোধী অপরাধের উস্কানি ও প্ররোচনা দিয়েছিলেন। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতি- পুতি, রাজাকার এসব বলেছিলেন।

শেখ হাসিনার এভাবে রাজাকার বলার মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন বাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তাজুল ইসলাম। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগ, এসব সংগঠন সহযোগী বাহিনী অর্থাৎ অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর পাশাপাশি অস্ত্র- সস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদেরকে হত্যা করে, আহত করে এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। তিনি এ-ও উল্লেখ করেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্ররোচনা, উস্কানি দেওয়া, ষড়যন্ত্র ও সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়েছে।

সরাসরি নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ

সংবাদ সম্মেলনে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, জুলাই - অগাস্টে যত মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন, প্রত্যেকটি ঘটনা ধরে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সরাসরি নির্দেশ দেওয়ার বিষয়ে দ্বিতীয় অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে দুটি অভিযোগের বিষয় জানালেও বাকি তিনটি অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তাজুল ইসলাম। তবে তিনি বলেন, বাকি তিনটি অভিযোগে সুনির্দিষ্ট তিনটি ঘটনায় শেখ হাসিনার নির্দেশে কিভাবে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেই অভিযোগ আনা হয়েছে বলে জানান চিফ প্রসিউটর তাজুল ইসলাম।

তদন্ত প্রতিবেদনে দ্বিতীয় অভিযোগে সরাসরি নির্দেশের যে কথা বলা হয়েছে, সে ব্যাপারে তাজুল ইসলাম জানান, তদন্ত সংস্থার কাছে এসব নির্দেশের অনেকগুলো টেলিফোনিক কনভারসেশন রয়েছে।এসব কথোপকথনের রেকর্ড জব্দ করা হয়েছে বলে জানান তাজুল ইসলাম। তিনি আরো বলেন, এসব কনভারসেশনে তিনি বারবার সুষ্পষ্টভাবে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি রাষ্ট্রীয় সকল বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন হেলিকপ্টার, এপিসি, ড্রোনসহ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র, নিরীহ আন্দোলনকারীদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন বা নির্মূল করার জন্য। এসব নির্দেশের সরাসরি প্রমাণপত্র হাতে পাওয়ার প্রেক্ষিতেই এই অভিযোগ তদন্ত সংস্থা দাখিল করেছে বলে জানান তাজুল ইসলাম।

হত্যা, গুলি করে আহত করা, অঙ্গহানি করার ক্ষেত্রে নির্দেশ দেওয়াসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে জুলাই-অগাস্টে প্রায় দেড় হাজার আন্দোলনকারীকে হত্যা এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে আহত করার তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই তদন্ত প্রতিবেদনে নারীদের ওপরে বিশেষভাবে সহিংসতা, টার্গেট করে শিশুদের হত্যা, লাশ পুড়িয়ে দেওয়া ও আহতদের চিকিৎসায় বাধা দেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হত্যাকান্ডের পর মৃতদেহ ও জীবিত মানুষ একসাথে পুড়িয়ে দেওয়া, নিহতদের ময়না তদন্তে বাধা দেওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে। এমনকি, শেখ হাসিনা নিজে হাসপাতালে গিয়ে আহতদের চিকিৎসা না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাজুল ইসলাম বলেন, অনেক রোগী যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যেতে চাইলেও তাদের পালিয়ে যেতে সুযোগ দেওয়া হয়নি। যাতে করে তাদের ক্ষতস্থান পঁচে গ্যাংগ্রিন হয়, কেটে ফেলতে হয় সেরকম ব্যবস্থা করার সরাসরি নির্দেশ দেওয়ার প্রমাণ তদন্ত সংস্থা আমাদের কাছে দাখিল করেছে। এ মামলার শুনানিতে ব্যাপক পরিমাণে ডিজিটাল সাক্ষ্য-প্রমাণ দেওয়া হবে বলে জানান চিফ প্রনিকিউটর তাজুল ইসলাম।

আন্দোলনকারীদের ওপর দায় চাপাতে নির্দেশ

আন্দোলনকারীদের উপর দায় চাপানোর জন্য শেখ হাসিনার নির্দেশ দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় নিজেদের লোকদেরকে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সেটার দায় চাপানোর বিষয়ে নির্দেশ দেওয়ার প্রধান আসামি শেখ হাসিনার টেলিফোনের বক্তব্য, ও নির্দেশ তদন্ত সংস্থার হস্তগত হয়েছে। সেগুলো প্রমাণের জন্য তারা দাখিল করেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কল রেকর্ড, ভিডিও ফুটেজ, উদ্ধারকৃত বুলেট, হেলিকপ্টারের ফ্লাইট শিডিউলসহ বিভিন্ন আলামত জমা দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের ডেথ সার্টিফিকেট, তাদের যেসব ডাক্তাররা চিকিৎসা দিয়েছেন বা অ্যাটেন্ড করেছেন তারা সাক্ষী হিসেবে আসবেন। যারা সরাসরি আহত হয়েছেন তারাও সাক্ষী হিসেবে আসবেন। পাশাপাশি নিহতদের পরিবারের স্বজন যারা মরদেহ গ্রহণ করেছেন, দাফন করেছেন, তারাও সাক্ষী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসবেন।

এছাড়া আলামত হিসেবে বিভিন্ন কল রেকর্ড, অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ, অডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপিং এবং বুলেট- যেগুলো নিহত বা আহতদের শরীর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলো আদালতে শুনানির সময় দাখিল করা হবে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। একইসাথে অভ্যুত্থান চলাকালে যে সব হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর ফ্লাইট শিডিউল, সেখানে কারা যাত্রী ছিলেন ও কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো তদন্ত সংস্থা প্রসিকিউশনের কাছে দাখিল করেছে বলেও জানান তাজুল ইসলাম। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যারা সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন এবং অনেক আসামি যারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন- সামগ্রিকভাবে এই অপরাধ প্রমাণের সেই ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণ তদন্ত সংস্থা দাখিল করেছে।

রাজপথের চাপে বিচার সম্ভব নয় 

রাজপথের চাপের ভিত্তিতে বিচার করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিচার এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কোন সাধারণ বিচার নয়। রাজপথের চাপের প্রেক্ষিতে কোন বিচার করা সম্ভব নয়। সেটা করতে গেলে বিচার সঠিকভাবে করা কখনোই সম্ভব নয়। সঠিক বিচার যাতে হয় সেজন্য জনগণকে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের ওপর আস্থা রাখতে আহ্বান জানান তিনি। বিচার যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় তা নিশ্চিত করতে যতটুকু সময় প্রয়োজন, তা দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শেয়ার করুন