৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:০৮:২৮ অপরাহ্ন


টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বার্ককে শক্তিশালী করা অপরিহার্য
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০৩-২০২৫
টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বার্ককে শক্তিশালী করা অপরিহার্য বিদ্যুৎ লাইন


বাংলাদেশের টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়াদি মনিটরিং করার জন্য বার্ক অ্যাক্ট ২০০৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন নামের স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে কর্মরত সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য সমতামূলক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা। একক যোগাযোগ কেন্দ্র হিসেবে বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, সরকারের সব অ্যাক্ট, পলিসি রেগুলেশন যেন সব প্রতিষ্ঠান মেনে চলে সেটি নিশ্চিত করা। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের উপস্থিতিতে গণশুনানি করে স্বচ্ছতার সঙ্গে বিদ্যুতের ট্যারিফ এবং জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের একক দায়িত্ব বার্কের ওপর অর্পিত হয়। বলাবাহুল্য, কর্তৃত্ববাদী সরকার শুরু থেকেই সংস্থাটিকে সহজভাবে মেনে নেয়নি। সরকারগুলোর দূরদৃষ্টির অভাবে প্রতিষ্ঠানটি অ্যাক্ট অনুযায়ী, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ সময়ে সরকার অনভিজ্ঞ আমলাদের নিয়োগ দিয়ে সরকারের আজ্ঞাবহ নতজানু প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। এর মধ্যেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বার্ক কিছু অর্জন করে। অনেকের মতে বার্ক অ্যাক্টের সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহের আলোকে প্রতিষ্ঠানটিকে সঠিক জনবল সংস্থান করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের বর্তমান লেজে গোবরে অবস্থার সৃষ্টি হত না। যাহোক জুলাই-আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সরকার পূর্ববর্তী সরকার আমলের শেষদিকে সরকার কর্তৃক প্রণীত বার্ক অ্যাক্ট সংশোধনী বাতিল করে জ্বালানি বিদ্যুৎ মূল্য নির্ধারণের একক দায়িত্ব সংস্থাটিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সংস্থার চেয়ারম্যান হিসাবে একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আমলাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নিজেদের কাজে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বার্ক। 

বার্ক সৃষ্টির পটভূমি

২০০০ থেকেই বাংলাদেশে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ শুরু হয়। সুলভ গ্যাস বিদ্যুৎ প্রাপ্তি এবং সুলভ শ্রমের সুবিধা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে অনেক শিল্প বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। জ্যামিতিক হরে বাড়তে থাকে জ্বালানি বিদ্যুৎ চাহিদা। বাংলাদেশে তখন সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি দেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। দাতা এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়ে আসছিল। এমনকি কয়েকটি দাতা প্রতিষ্ঠান জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে সহজশর্তে ঋত প্রদানের কোভেন্যান্ট হিসেবে বিষয়টি জুড়ে দিয়েছিল। ওই সময় সবেমাত্র জ্বালানি সরবরাহ সংকট মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা হিসেবে আমি তখন কর্মরত) হিসেবে কর্মরত জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের শীর্ষস্থানীয় দেশি-বিদেশি কোম্পানি, উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ইউএসএইড, জাইকা প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণ করি। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণ এবং মতামত প্রদানের সুযোগ হয়। নিজের অনুসন্ধিৎসু অভিলাষ থেকে বিভিন্ন দেশের জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের কার্যক্রম নিয়ে বিশ্লেষণ করি। উন্নয়ন সহযোগী বিশ্ব ব্যাঙ্ক, এডিবির আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিপাইনে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ইউএসএইডের আমন্ত্রণে নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতে সার্ক এনার্জি গ্রিড সৃষ্টির নানা আলোচনায় অংশ নিয়েছি। যে কোনো অন্য দেশের আদলে বাংলাদেশের জন্য এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন আমাকেও সংশ্লিষ্ট পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। মনে আছে ইউএসএইডের আমন্ত্রণে সরকারের চার সদস্যের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় সফর করার সুযোগ হয়েছিল। পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান সৈয়দ সাজেদুল করিম ছিলেন দলনেতা। ওপর দুই সদস্য ছিলেন আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শহিদুল হক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল ডক্টর সালেহ আহমেদ। সফরকালে আমরা ফেডারেল এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আইএফসি, ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স, কানাডিয়ান রেগুলেটর এনইবি, কানাডিয়ান এনার্জি রিসার্চ কাউন্সিল এবং শীর্ষ স্থানীয় জ্বালানি বিদ্যুৎ কোম্পানিসমূহের কিছু স্থাপনা পরিদর্শন করি। এসব সংস্থাসমূহের কাজ বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করি। আমাদের সুযোগ হয় পরবর্তী সময়ে বার্ক একটু প্রণয়নকালে অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর। যাই হোক পিএ কনসালটেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান বার্ক অ্যাক্টের খসড়া প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অধিকাংশ আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। মনে আছে ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে একবার এবং যমুনার পাড়ে একবার তৎকালীন জাতীয় সংসদের সর্বদলীয় সাংসদদের একটি দলের সামনেও বার্ক অ্যাক্টের চুম্বক অংশ ব্যাখ্যা করছিলাম। মুখ্য ভূমিকা ছিল শহীদুল হকের যিনি আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে চাকরি করার পর এখন অবসরে আছেন। ২০০৩ সালে অনেক সংশোধন এবং বিয়োজনের পর অ্যাক্টটি পাস হয়। অনেক বাধাবিপত্তি এবং চ্যালেঞ্জের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বার্ক এখন অনেকটাই পরিণত। 

বার্ক অ্যাক্টের মূল ধারাসমূহ

প্রথমেই বলে রাখি বার্ক কিন্তু অ্যাক্ট অনুযায়ী একটি স্বায়ত্তশাসিত স্বাধীন-নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। অ্যাক্টের ধারা অনুযায়ী জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতের সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান দেশে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বার্কের কাছে (লাইসেন্স নিয়ে) দায়বদ্ধ, প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে বিদ্যমান সব অ্যাক্ট, পলিসি, রেগুলেশন সঠিকভাবে মেনে চলছে কি না, সেটি মনিটরিং করার অধিকার এককভাবে বার্কের ওপর অর্পিত। এছাড়া বার্ক নির্দিষ্ট বিরতিতে বিদ্যুতের ট্যারিফ এবং সব জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করার জন্য এককভাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত। অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সব কোম্পানির দক্ষতা এবং স্বচ্ছ কার্যক্রম নির্ধারণ। বার্ক এনার্জি এবং ম্যানেজমেন্ট অডিংয়ের মাধ্যমে জ্বালানি বিদ্যুতের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। 

বলা বাহুল্য, ২০০৩ থেকে ২০২৪ কোনো সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়নি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ আমলাদের পদায়ন করে প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারের আজ্ঞাবহ নতজানু প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়। সবকিছু ছাড়িয়ে যায় পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। দ্রুত জ্বালানি বিদ্যুৎ সরবরাহ অ্যাক্ট ২০১০-এর অধীনে অস্বচ্ছ এবং জবাদিহিহীনভাবে কোটি কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করে সরকারি সংস্থাগুলোকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করা হয়। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে বার্কের মতামত প্রদানের অধিকার সংরক্ষিত থাকলেও উপেক্ষা করা হয়। সর্বশেষ অ্যাক্ট সংশোধন করে এক পর্যায়ে মূল্য নির্ধারণের বিষয়টিতেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ভাগ বসায়। অথচ বিদ্যুৎ, জ্বালানি সেক্টরের মেগা প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা পর্যায়ে বার্ক সম্পৃক্ত থাকলে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ ছিল না। বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে কিন্তু জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই, বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহ অলস রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানের পরিস্থিতি অনেকটাই এড়ানো যেত।

যা হোক নতুন ব্যাবস্থাপনার অধীনে নতুনভাবে শুরু করা বার্ক নিয়ে আশাবাদী হওয়ার অনেক কারণ আছে। চেয়ারম্যান জ্বালানি সেক্টরে দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন, পেট্রোবাংলার অন্যতম সফল চেয়ারম্যান ছিলেন, বিচারকাজ করেছেন, প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। প্রখর ব্যক্তিসম্পন্ন চেয়ারম্যানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হলে এবং সংস্থাটিকে প্রয়োজনীয় জনবল দেওয়া হলে ৩ বছরের মধ্যে সংস্থাটি বর্তমান চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি থেকে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরকে ঘুরে দাঁড়াতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে বলে আস্থা রাখা যায়।

যা করতে হবে

জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে নতুন যে কোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পটভূমি, প্রেক্ষাপট, কারিগরি এবং আর্থিক উপযোগিতা বার্কের কাছে পেশ করে অনুমোদন বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি কোম্পানিকে সরকারের বিদ্যমান সব অ্যাক্ট, পলিসি, রেগুলেশন মেনে চলতে হবে এবং এই বিষয়ে বার্ক নির্ধারিত ফর্মে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রদান করতে হবে। বার্ক অডিটরদের মাধ্যমে নিয়মিত এনার্জি এফিসিয়েন্সি এবং ব্যাবস্থাপনা দক্ষতা পরীক্ষা করে নিশ্চিত করবে। 

বিদ্যুৎ ট্যারিফ এবং সব জ্বালানির সঠিক বাস্তব সম্মত মূল্য অংশীজনের সঙ্গে গণশুনানির মাধ্যমে বার্ক নির্ধারণ করবে। তবে বার্ক সরকারি এবং বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করলে ব্যয় সংকোচন নিশ্চিত হলে অকারণে মূল্য বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না।

বার্ক জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের কোম্পানিসমূহের অপচয়, সিস্টেম লস কঠোর অনুশাসনের মাধ্যমে জবাবদিহির আওতায় আনলে সব পক্ষ উপকৃত হবে। দেশের নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ আহরণ, উত্তোলন বিষয়ে বার্কের সৃষ্ট গ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের সুষ্ঠু ব্যবহার তদারকি করা প্রয়োজন। তহবিলটি যথেচ্ছ অপব্যাবহার হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

অস্ট্রেলিয়ান এনার্জি রেগুলেটর, ভারতের পিজিআরবি কার্যক্রম দেখার এবং জানার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি দেশগুলোতে কিভাবে সংস্থাগুলো বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে অবদান রাখছে। বাংলাদেশের সুযোগ আছে নিজস্ব পরিবেশ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী এগিয়ে যাবার। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি গতিশীল বার্ক গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। 

আশা করি, বর্তমান সরকারের কার্যকালে বার্ক প্রয়োজনীয় সঠিক যোগ্য জনবল নিয়োগ করে দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাঙ্খিত ভূমিকা রাখতে শুরু করতে পারবে।

শেয়ার করুন