ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকের আগে বাংলাদেশে গত কয়েক দিনে ঘটে যাওয়া হামলা, ভাংচুরের ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও চলছে নানান ধরনের হিসাব নিকাশ। সর্বত্রই আলোচনার পাশাপাশি বিশ্লেষণ হচ্ছে আসলেই কি হয়ে গেলো চলতি মাসের গত দু’দিনে? হিসাব কষা হচ্ছে কে কার ফাঁদা পাতে পা দিলো? পুরো ঘটনায় কে ক্যাশ করে নেবে? এধরনের ঘটনাকে দেখা হচ্ছে বৈশ্বিক মেরুকরণ হিসাবেও। এর পাশাপাশি আলোচিত হচ্ছে চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকেই-বা দিল্লী এসব ঘটনাকে পুঁজি করে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কি ম্যাসেজ দেবে মার্কিনীদের।
কি কি ঘটে গেল?
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে জীবন বাঁচিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয়ে নিয়েছেন। তার দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়ে তিনি তা-র কিছু একেবারে আপনজন আর বেশ কয়েকজন সুবিধাভোগিদের নিয়ে ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমানে এই শেখ হাসিনা ভারতে বসে গত ছয় মাসে বেশ কয়েকবার বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এবারও ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে জানান তিনি ৫ ফেব্রুয়ারিতে তার দলের ভাতৃপ্রতীম সংগঠন সম্প্রতি নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের উদ্দেশ্য কিছু বার্তা দেবেন। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের ছয় মাস পূর্তির দিনে বক্তব্যটি প্রচারের ঘোষণা দেওয়া হয় নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রসংগঠনের ওয়েব পেজে এবং তা ব্যাপকভাবে প্রচারও করা হয়। আর এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ফুসে উঠে। ভাষণের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে শুরু করে সারাদেশে আওয়ামী লীগের কার্যালয় তাদের নেতাসমর্থকদের অফিস বাড়িঘরে হামলা ভাংচুর হয়। দেশব্যাপী ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বলা যায় ৭ তারিখ পর্যন্ত এমন হামলা ভাংচুর হয়।
ভাংচুরের ঘটনায় কে কি বললো?
ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে শুরু করে সারাদেশে আওয়ামী লীগের কার্যালয় তাদের নেতাসমর্থকদের অফিস বাড়িঘরে হামলা ভাংচুর নিয়ে প্রথমে তেমন কেউ মুখ না খুললেও বিষয়টি নিয়ে সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উঁকিঝুকি দিচ্ছিল। ঠিক এমন সময়ে ৬ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতেও ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঘটনা প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধ সৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এ ঘটনা ঘটেছে।’ তবে এমন বিবৃতির মাঝে দেশব্যাপী সংঘটিত অস্বাভাবিক ভাঙচুর ও সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তারা বলেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক উত্তরণ, সুশাসন ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার নিন্দা জানিয়ে দেশের বিশিষ্ট ২৬ নাগরিকের দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে নির্মমতার সঙ্গে বাড়িটি ধ্বংস করা হয়েছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার নিন্দা জানিয়ে আরও বেশ কয়েকটি বিবৃতির ঝড় দেখে অন্তর্বর্তী সরকারের টনক নড়ে। এরপরই বলা যায় শেখ হাসিনার নাম ধরেই বিবৃতি দেয়া হয় অন্তর্বর্তী সরকারেরর প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে। সারাদেশে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ’গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাংচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাংক্ষিত বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অবিলম্বে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে দেশের সব নাগরিককে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শেখ হাসিনার পরিবারের সম্পত্তি ধ্বংস থেকে বিরত থাকা এবং ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ হওয়ার কারণে কিংবা অন্য কোনো অজুহাতে বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের ওপর আক্রমণ না করার আহ্বানও জানান প্রধান উপদেষ্টা। এর পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম যাকে কেউ কেউ তাত্ত্বিক নেতা বলে থাকেন। তিনিও পুরো ‘নৈরাজ্যকর’ পরিস্থিতির রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুদূর প্রতিক্রিয়া ঠিকই টের পান। মাহফুজ আলম এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ভাঙার প্রকল্প থেকে সরে এসে দিনকে দিন আমাদের গড়ার প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত বলে। ফেসবুকে এক পোস্টে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম লিখেন, গড়ার তাকত আছে আমাদের? আমরা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আধিপত্যবাদ মোকাবেলা করছি। নিছক কিছু মূর্তি বা দালান নয়। মূর্তি না ভেঙ্গে আমাদের উচিত আমাদের শত্রুদের শক্তির বিপরীতে পাল্টা চিন্তা, শক্তি ও হেজেমনি গড়ে তোলা।
ভাংচুরে বিএনপি না
এদিকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল সারা দেশে চলমান এধরনের ঘটনাকে ‘নৈরাজ্যকর’ পরিস্থিতি বলে অভিতি করেছে। তা সাফ জানিয়ে দেয় যে, একে সমর্থন করছে না বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করেন, দেশজুড়ে সংঘটিত ভাঙচুরের ঘটনাকে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে প্রলম্বিত করার ষড়যন্ত্র। একইসঙ্গে এ ঘটনাকে এক ধরনের ফাঁদ হিসাবেও মনে করছে। এর পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির কথা ইতোমধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষপর্যায়ে জানানো হয়েছে বলে বিএনপি’র নেতারা জানান। দলটির নেতাদের অভিমত, গণ-অভ্যুত্থানের ছয় মাস পরে এ ধরনের ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তার দায় অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরও বর্তায়। কারণ, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।
ভারতের প্রতিক্রিয়া ইঙ্গিতপূর্ণ
এদিকে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে ভাংচুরের নিন্দা জানিয়ে (৬ ফেব্রুয়ারি) এই কাজকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে ভারত। ভাংচুরের বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘দখলদারিত্ব ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাসভবনটি ২০২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ধ্বংস করা হয়েছে। এটি দুঃখজনক।’ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায় এতে আরো বলা হয় যে, বাঙালি পরিচয় ও গর্বকে লালনকারী স্বাধীনতাসংগ্রামকে যারা মূল্যায়ন করেন, তারা বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার জন্য এই বাসভবনের গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত আছেন। এই ভাংচুরের ঘটনাটির তীব্র নিন্দা জানানো উচিত।
কারা কাদের ফাঁদে?
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িসহ সারাদেশে ভাংচুরের ঘটনা নিয়ে যখন রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড় বইছে ঠিক তখনই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি মন্তব্য নিয়ে নানান ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শেখ হাসিনার পাতা ফাঁদে পা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রবীণ বিচক্ষণ বিএনপির এই মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হচ্ছে। অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর জন্য সম্পূর্ণভাবে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম (শাসনামল) দায়ী। একটা অন্ধকারকে আরেকটা অন্ধকার দিয়ে দূর করা যায় না। আলো দিয়ে দূর করতে হয়। সেই আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে সামনের দিকে যেতে হবে। ৯ ফেব্রুয়ারি রোববার বিকেলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মির্জা ফখরুল। এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে উৎখাতের জন্য একটা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সফলতা অর্জন করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়...আজকে হাসিনার পাতা ফাঁদে আমরা যেন পা না দিই।’
মোদি-ট্রাম্প বৈঠকের আগে এ ঘটনা’র নেপথ্যে কি?
ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাত থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ সারাদেশে যে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তার পেছনে এখন অনেক বড়ো ধরনের রহস্য কাজ করেছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন। এখন সবাইকে ভাবাচ্ছে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটকৈৗশলে বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার একটি অংশকে জড়িয়ে ফেলে একধরনের রাজনৈতিক বিজয় হাতিয়ে নেয়া হলো কি-না? কারো কারো অভিমত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর গুড়িয়ে দেয়াসহ সারাদেশে এভাবে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আওয়ামী লীগের প্রতি একধরনের সহানুভুতি-ও দেখা দিয়েছে জনগনের মধ্যে। একিই সঙ্গে এর রেশ বিশ্বেও লেগেছে বলে কারো কারো অভিমত। অপরদিকে বহির্বিশ্বেও এমন ঘটনার সুদূর প্রতিক্রিয়া ফেলেছে যখন ভারত নিন্দা জানিয়ে একে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করে। ভারতের এমন প্রতিক্রিয় একজায়গায় থেমে থাকেনি। ভারতের পক্ষ থেকে ওই মন্তব্যে আরো বলা হয় যে, এই ভাংচুরের ঘটনাটির তীব্র নিন্দা জানানো উচিত বলে সকলের কাছে একটা বার্তাও দিয়ে দেয় দেশটি।
যদিও কারো কারো আশঙ্কা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এত দিন পর এসব ভাংচুর-বিশৃঙ্খলার পেছনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দীর্ঘায়িত করার একটি অজুহাত বা চক্রান্ত। তবে এমন বক্তব্যকে অনেকে সমর্থন করেন না। তাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের কারো এমন খায়েশ হলে বা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায় মনে হলে ওই ঘটনাকে ‘নৈরাজ্যকর’ পরিস্থিতি বলে অভিহিত করতো না বিএনপি। তারা এধরনের ঘটনাকে সাফ জানিয়ে দিতো না যে একে তারা সমর্থন করতে অপারগ। বরং দলটির নেতারা এ ঘটনাকে নির্বাচন বানচাল নয়, অন্য ধরনের ফাঁদ হিসাবেও মনে করে সর্তক বিবৃতি দিয়েছে। আর একারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির কথা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষপর্যায়ে বার্তাও দিয়ে দেয়, যা ছিল সময়ের বাস্তবতায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন এটা আসলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ভারতে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’রই একটি বড়ো রাজনৈতিক কূট-চাল। অন্যদিকে এধরনের ঘটনা অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বানচাল করার কূট-চাল না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এমন কূট-চালের পেছনে অনেক বিষয় কাজ করছে। তা-র অন্যতম হলো ১২-১৩ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন সফর করতে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সে-ই বৈঠকে যেনো বাংলাদেশ প্রসঙ্গ চলে আসে তা-রই কূট-চালের একটি অংশ বলে কারো কারো ধারণা। কেননা তারা মনে করেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা বা যে-কোনো পরিবর্তনে আমেরিকার একট শক্ত হাত কাজ অতীতে করেছে, ভবিষ্যতেও তা বজায় থাকবে। এজন্যই মোদির ওই সফরের আগে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে কি-না সে প্রশ্ন চলে এসেছে। তাছাড়া মোদির ওই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠতে পারে বলে-ও আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। ফলে চলতি মাসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর মাটিতে মিসিয়ে দেয়ার পাশাপাশি দেশব্যাপী ভাংচুরের ঘটনা সংঘঠিত করতে এমন পরিস্থিতির অবতারণা কি-না সে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে অনেককে।
এখন দিল্লী কি বার্তা দিতে পারে মার্কিনীদের
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওই বৈঠকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে ধরেই নেয়া যায়। কেননা যুক্তরাষ্ট্র-ভারত এই দেশ দু’টি সামরিক জোট না করেও তারা সামরিক মিত্র। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তিও রয়েছে। এতে করে সহজেই বোধগম্য যে, যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা অংশীদারির গভীরতার বিষয়টি। কারো কারো অভিমত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এভাবে একসাথে পথচলা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বাধীন চীন সরকারের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও নীতিও কাজ করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আগের চেয়ে এখন বেশি চীনকে তার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখছে। আর সেকারণে চীনের প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে এ অঞ্চলে মিত্র খুঁজছে। আর সেক্ষেত্রে তারা ভারতকেই শক্ত ও কৌশলগত মিত্র বলে মনে করছে। আর সে-ই কৌশলগত মিত্রের বাংলাদেশও একটি বড়ো ফ্যাক্টর। এছাড়া মোদি-ট্রাম্প্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও এক্ষেত্রে আরো একটি বড়ো ফ্যাক্টর। ডোনাল্ড ট্রাম্প-ও বলে থাকেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার বন্ধু। মোদীও দাবি করেন যে ট্রাম্প তার বন্ধু। নির্বাচনের আগেই গত গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর মিশিগানের ফ্লিন্টের টাউনহলে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্প বলেছিলেন, “আগামী সপ্তাহে মোদী আমেরিকা আসছেন এবং তার সঙ্গে আমার দেখা হবে, যদিও ব্যস্ততার কারণে সে-টা হয়নি। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে এত্তোসব বিষয়গুলো মাথায় রেখেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন ১২-১৩ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একদম চুপ চাপ বসে থাকবেন? এমনটা তারা কেউ-ই মনে করেন না। তাদের বিশ্লেষণ বাংলাদেশের জনগণ বাদ দিয়ে তাদের একমাত্র মিত্র আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানকর্তা শেখ হাসিনার এমন পলায়ন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য একটি রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বিরাট পরাজয়। এ-নিয়ে নরেন্দ্র মোদির তার দেশেই বেশ নাজুক অবস্থাতেও আছেন, এবং ধারণা করছেন আগামীতে ভারতের নির্বাচনেও এর প্রভাব ফেলবে। তা-ই এমন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরাজয়কে নিরবে হজম করার পাত্র যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নন তা তার অনেক ঘনিষ্ঠজনরাই জানেন ও বোঝেন। সেক্ষেত্রে সম্প্রতি ৩২ নম্বরে ভাংচুরের ঘটনায় ভারতের প্রতিক্রিয়া ও ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি করতে পারেন বা করবেন তা সহজেই অনুমেয়। কারো কারো মতে, সম্প্রতি ৩২ নম্বরে ভাংচুরের ঘটনাসহ সারাদেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিকে পুঁজি করে মোদি খুব সহজেই একটি বার্তা ভারতকে দিয়ে দেবে যে বাংলাদেশে মৌলবাদিরাই এবং স্বাধীনতা বিরোধীরাই এটি ঘটিয়েছে, এবং তারা সক্রিয়। কেননা সম্প্রতি ৩২ নম্বরে ভাংচুরসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার ঘটনায় ভারতীয় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম বেশ নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে ডকুমেন্টারি করে দেখানো হয় যে সম্প্রতি ৩২ নম্বরসহ সারাদেশে ভাংচুরের ঘটনায় জড়িতরা দাড়ি টুপিওয়ালা পরা জনগণ। এর পাশাপাশি ইঙ্গিতেও জানিয়ে দেয় যে এর পেছনের কোন কোন দেশ জড়িত। আর এতে করে ধরেই নেয়া যায় যে, আসন্ন মোদি ট্রাম্প বৈঠকের প্রাক্কালে ৩২ নম্বরসহ সারাদেশে ভাংচুরের ঘটনা আসলে কোন দিকে মোড় নেবে, একিই সঙ্গে এর পেছনে আসলে কা-র বা কাদের ফাদা ফাঁদ ছিল। তবে ৩২ নম্বরে ভাংচুরের ঘটনাকে পুঁজি করে দিল্লী মার্কিনীদের বুঝিয়ে দেবে যে বাংলাদেশ একটি মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে চলে যাচ্ছে তা কিন্তু পরিস্কার। এর পাশাপাশি বার্তা দেয়ার ক্ষেত্রও যে তৈরি হরো তা পরিষ্কার। এখন সহজেই দিল্লী বুঝিয়ে দিয়ে পরিস্কার বার্তা দেবে‘ এধরনের উগ্র নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো পরিবেশই পরিস্থিতি নেই, সেটিও স্পষ্ট।’