সমাজের সব স্তর থেকে বৈষম্য দূর করে শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য ১৯৭১-এ লাখো জনতা আত্মাহুতি দিয়েছে, ৯০ গণআন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটিয়েছে, সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার আত্মাহুতির বিনিময়ে পতন হয়েছে কর্তৃত্ববাদী শাসনের। সব আত্মত্যাগ এবং আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্যহীন সমঅধিকারভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। যেখানে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে। মেধার ভিত্তিতে শোষণবিহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে। বিভেদ নয়, ঐক্যের ভিত্তিতে সবার অবদানে গড়ে উঠবে এই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন বিশেষ সরকার। সরকারপ্রধান কিন্তু বারবার বলছেন, ঘুরে দাঁড়ানোর এমন ঐতিহাসিক সুযোগ আবার আসবে কি না সন্দেহ। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের তিন মাস পরও ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠছে না। কিছু গোষ্ঠীর অস্থিরতা এবং অসংলগ্ন কার্যক্রমের কারণে আরাধ্য লক্ষ্য এবং উদ্দেশ অর্জন বিষয়ে জাগছে সংশয়। যত দিন যাচ্ছে পরিষ্কার হচ্ছে দীর্ঘদিন কর্তৃত্ববাদী শাসন-শোষণের কারণে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মৌলিক অবকাঠামো নড়বড়ে হয়ে গেছে। এগুলোকে জনকল্যাণমূলক করে পুনর্গঠিত করার জন্য ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সেই কাজ করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য। বর্তমান সরকার সীমিত সময়ে হয়তো সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সংস্কারের পথনকশা রচনা করতে পারবে না। কিন্তু সেই অনুযায়ী, সংস্কারকাজ করার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন হবে। বর্তমান সরকার অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা করে ন্যূনতম সংস্কার করে যত শিগগিরই সম্ভব একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করে বিজয়ী দলের কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্পণ করে ততই মঙ্গল। কোনো দল নিষিদ্ধ হবে, কারা টিকে থাকবে সেটি নির্ধারণের দায়িত্ব জনগণের। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, জাতীয় দিবস, সংবিধান সংশোধন, পরিবর্তন এবং অন্যান্য মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে নির্বাচিত সরকার। বর্তমান সংকট মুহূর্তে এসব সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে বিতর্ক করে রাজনৈতিক বিরোধ সৃষ্টি সরকারের কাজকেই বিলম্বিত করবে।
সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, নির্বাচন কমিশন বিষয়ে সার্চ কমিটি হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনকেও ঢেলে সাজানোর কার্যক্রম চলছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এবং পরবর্তীতে হত্যা, লুণ্ঠন এবং ধ্বংসযজ্ঞ বিষয়গুলোর বিচার প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছে, ধসেপড়া পুলিশ বাহিনী, স্থানীয় সরকার এবং বেসামরিক প্রশাসন পুনর্গঠনের কাজ চলছে। বিপুল পরিমাণ বা সব কাজ করা সংগত কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেশপ্রেমিক নাগরিকদের উচিত বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে একতাবদ্ধ হয়ে সরকারকে সৎ পরামর্শ দেওয়া। অযথা এ মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে জিগির তুলে বিভেদ সৃষ্টি না করা। কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করতে হলে আইনানুগ পদ্ধতি আছে। জনগণ এ বিষয়ে শ্রেষ্ঠ বিচারক। এমনিতেই সরকার আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে গলদঘর্ম এমতাবস্থায় বিতর্কিত বিষয় নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি সরকারের কাজ সংকটময় করে তুলবে।
দেশের বর্তমান সংকট মুহূর্তে প্রথম প্রয়োজন ধ্বংসের পথে থাকা অর্থনীতি সংস্কার। সেই পথে সরকার সীমিত সময়ে কিছু ব্যতিক্রমধর্মী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। অতি ধীরে হলেও স্বস্তি ফিরে আসছে আর্থিক খাতে। মুদ্রাস্ফীতি অতি ধীরে হলেও কমছে, বাজার ব্যবস্থাপনায় উন্নতি হচ্ছে। সরকার আইন এবং বিচার বিভাগের সংস্কার শুরু করেছে। আগেই বলেছি কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। সার্চ কমিটি সুপারিশ করলে সরকার অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ করে নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। শুরু হবে নির্বাচনের পথযাত্রা।
সরকারের কাজ সরকার করবে। কিন্তু কোনো দল বা সংগঠন সরকারের ওপর কারণ-অকারণে চাপ সৃষ্টি করে সরকারের কাজে প্রভাব সৃষ্টি করা সংগত হবে না। ইচ্ছা করলে যেন কোনো গোষ্ঠী স্বাধীন দেশে সংগঠিত হয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করে জনতার সামনে তাদের আদর্শ উদ্দেশ তুলে ধরতে পারে। কিন্তু কোনো অবস্থায় কোনো সংগঠনের কার্যক্রম জাতীয় ঐক্যের পরিবেশ নষ্ট করুক, সেটি কাম্য হতে পারে না। সেনাবাহিনী এখনো রাজপথে। দীর্ঘদিন সেনাবাহিনী রাজপথে থাকুক এটি কাম্য হতে পারে না। নির্দিষ্ট সময় শেষে ওদের ব্যারাকে ফেরত যাওয়া উচিত। পূর্ববর্তী সরকার নিজেদের স্বার্থে সেনাবাহিনীকে অনেকটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছিল। দেশের উন্নয়নে সেনাবাহিনীর সহায়তা প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেনাবাহিনীকে সব কাজে সম্পৃক্ত করলে সামাজিক জীবনে বৈষম্য সৃষ্টি হয়, সেটিও জাতিকে বুঝতে হবে।
শেষকথা, জাতীয় স্বার্থে যে কোনো মূল্যে একতা বজায় রাখা অপরিহার্য। না হলে কিন্তু ১৯৭১, ১৯৯০-এর মতো ২০২৪ সে সূচিত সংস্কার সুযোগ নষ্ট হবে, যার কথা বারবার বলছেন প্রধান উপদেষ্টা।