৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৭:২২:৪৬ অপরাহ্ন


তিতাস গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা মহাসংকটে
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-১০-২০২৪
তিতাস গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা মহাসংকটে তিতাস গ্যাস ভবন


বাংলাদেশের জ্বালানি বিতরণ এবং বিপণনব্যবস্থার সবচেয়ে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। বৃহত্তর ঢাকা এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার বাংলাদেশের গ্যাস সরবরাহের ৬০ শতাংশ চাহিদা মেটায় তিতাস গ্যাস। ষাট দশকের শেষ থেকে ৬৪ বছর যাবৎ নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে কোম্পানিটি গ্যাস বিতরণ কাজে নিন্দিত এবং নন্দিত হয়েছে। এই কোম্পানির দক্ষ অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেম লিমিটেড, জিটিসিএল কোম্পানি গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ইদানীং গ্যাসের উৎপাদন এবং সরবরাহের কারণে দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সংকট সৃষ্টি হওয়ায় সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় আছে তিতাস গ্যাস।

এমনিতেই পরিস্থিতির চাপে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এলাকার সেই ৭০ দশকে নির্মিত শতসহস্র ছিদ্র যুক্ত বিতরণ পাইপলাইনসমূহ পরিবর্তন না করায় ছিদ্র পথে অবিরত গ্যাস উদ্গীরণ হচ্ছে। বিতরণব্যবস্থা অনিরাপদ হয়ে পড়ে প্রায়শই গ্যাস দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। তদুপরি সরকারের গৃহস্থালি গ্যাস ব্যবহার নিষিদ্ধ করার প্রতিক্রিয়ায় একশ্রেণির অশুভ সিন্ডিকেট লাখ লাখ অবৈধ গ্যাসসংযোগ নিয়ে এবং অবৈধ গ্যাস ব্যবহার করে বিতরণ ব্যবস্থাকে অনিরাপদ এবং অরক্ষিত করে ফেলেছে।

এমনিতেই ২ হাজার এমএমসিএফডি চাহিদার তুলনায় প্রায়শই ১৪০০-১৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। তদুপরি শতছিন্ন বিতরণ ব্যবস্থায় ডিজাইন চাপে গ্যাস সরবরাহ করা বা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ওডারেন্ট প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিবেদক নিজেও ১৯৭৮-১৯৮১ তিতাস গ্যাসে কর্মরত থাকা অবস্থায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর এলাকায় বিতরণ পাইপলাইন নির্মাণ কাজে সম্পৃক্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে জিটিসিএলের পরিচালক (অপারেশন ) থাকা অবস্থায় জাতীয় গ্যাস গ্রিড থেকে জিটিসিএল বিতরণ ব্যবস্থায় গ্যাস সরবরাহ করেছি। সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুর, আশুলিয়া এবং নারায়ণগঞ্জ এলাকায় গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে তিতাস গ্যাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার শিল্পমালিকদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জানা গেছে, তাতে সার্বিক বিবেচনায় তিতাস গ্যাসের সম্পূর্ণ বিতরণ এলাকা মহাসংকটে আছে। সরকার (পেট্রোবাংলা, বিইআরসি, জ্বালানি মন্ত্রণালয়) সংকটের স্বরূপ অনুধাবনপূর্বক দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ২০২৫-২০২৬ সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এমতাবস্তায় নিম্ন বর্ণিত সুপারিশ করবো।

বিতরণ এলাকার বিশালত্ব বিবেচনায় নিয়ে তিতাস গ্যাসকোম্পানির গ্যাস বিতরণ কার্যক্রম জোনভিত্তিক বিভাজন হতে পারে নিম্নরূপে- 

ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা। 

মানিকগঞ্জ-গাজীপুর এলাকা।

নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ এলাকা। 

বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং নরসিংদী এলাকা।

উপরোক্ত এলাকাসমূহের গ্যাস বিতরণব্যবস্থা জোনালভিত্তিতে পৃথক করা সম্ভব হলে গ্যাস ইনটেক এবং ব্যবহার অধিকতর নিবিড়ভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। ঢাকা সদর দফতর থেকে বিস্তীর্ণ এলাকার গ্যাস ব্যবহার বিশেষত অবৈধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এখন প্রায় অসম্ভব।

সবাই জানে সঠিক এস বিল্ট নকশা সংরক্ষণ না করায় এবং ডিজিটাল ম্যাপিং ব্যবস্থা শুরু করেও একসময় শেষ না করায় বর্তমানে গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক চিহ্নিত করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। অনেক পূর্ণ গ্যাস পাইপলাইন ১৫-২০ ফুট মাটির নিচে চাপা পড়ে গেছে। ইদানীং জাইকার সহায়তায় কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ডিজিটাল ম্যাপিং কার্যক্রম শুরু হলেও বিস্তীর্ণ এলাকায় সব পুরোনো পাইপলাইন চিহ্নিত করা অসম্ভব। শুনলাম, নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা-গাজীপুর এলাকায় পাইপলাইন প্রতিস্থাপনের দুটি প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন না করে পুনরায় বিবেচনার জন্য ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন গ্যাস বিতরণে এমডিপিই এবং এইচডিপিই লাইন পাইপ এবং ফিটিংস ব্যাবহৃত হয়, বিতরণ লাইনের সঙ্গে ফাইবার অপটিক্স সংযুক্ত করে স্মার্ট সেন্সিং ব্যবস্থা করা হয়, স্থাপনাসমূহ জিআইএস সংযুক্ত করে ডিজিটালি গ্যাস বিতরণ কার্যক্রম স্কাডা বা টেলেমেত্রি নিয়ন্ত্রণ করা করা হয়।

আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিতরণ ব্যবস্থা চালু করতে করতে হলে বিদ্যমান বিতরণ ব্যবস্থাকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে পূরণে এবং সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাসের সমস্যা, সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে একটি পেশাদার কোম্পানি পরিচালকম-লীর তত্ত্বাবধানে স্বনির্ভর প্রসাধন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

বিদ্যমান অবস্থার জন্য পেট্রোবাংলা এবং মন্ত্রণালয়ের দায় এড়ানোর কোনো উপায় নেই, অনেক দিন যাবৎ তিতাস পরিচালকমণ্ডলীর সভাপতি জ্বালানি সচিব, সদস্য পেট্রোবাংলা, বিপিডিবি চেয়ারম্যান। কেন তারা কোম্পানির সংকট নিরসনে কাজ করেননি। দেখা গেছে, সংকটে পাশে না দাঁড়িয়ে পেট্রোবাংলা এবং মন্ত্রণালয় অন্যান্য স্থান থেকে প্রধান নির্বাহী তিতাস গ্যাসে চাপিয়ে দিয়েছে, দীর্ঘদিন কোম্পানির অর্গানোগ্রাম অনুমোদন না করে কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে।

আশা করি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে তিতাস গ্যাস প্রশাসনকে আমলা ও দুর্নীতি মুক্ত করে সৎ, নিবেদিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বিঘ্নে কাজ করার সুযোগ করে দেবে। ফিরে আসবে তিতাস গ্যাসের ঐতিহ্য।

শেয়ার করুন