বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, যোগাযোগ এবং যাতায়াত অবকাঠামো খাতে অনেক খরুচে মেগা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। অনেকগুলো বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। কিন্তু অধিকাংশ প্রকল্প গ্রহণ, প্রক্রিয়াকরণ এবং অনুমোদনকালে এগুলোর সুদূরপ্রসারি জনকল্যাণমূলক প্রভাব সঠিকভাবে পর্যালোচনা করে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জলকল্যাণের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত না করায় ইতিমধ্যেই কয়েকটি শ্বেত হস্তিতে পরিণত হয়েছে।
অধিকাংশ প্রকল্পের খরচ বাস্তবায়নকালে অস্বচ্ছভাবে বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এগুলোর অর্থনৈতিক উপযোগিতা হারিয়েছে। ফলশ্রুতিতে এগুলোর জন্য গৃহীত বৈদেশিক ঋত জাতির গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। যেসব প্রকল্প শেষ হয়েছে সেগুলোর উপকারিতা কীভাবে সর্বজনীন করা যায়, সেগুলোর পাশাপাশি বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে থাকা প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। অতি প্রয়োজনীয় বিবেচিত না হওয়ায় অন্তত ২০৩০ পর্যন্ত নতুন কোনো মেগা প্রকল্প গ্রহণ সংগত বলে মনে হচ্ছে না।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প
দক্ষিণ বঙ্গের বিশাল অঞ্চলকে দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সড়ক পথে সংযুক্ত করার জন্য পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী অর্জন। এই সেতুতে রেলসংযোগ, গ্যাস, ফাইবার অপটিকস সংযোগ এবং সেতু সমান্তরালে বিদ্যুৎ সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রমত্তা পদ্মা নদীর বুকে নির্মিত এই সেতুতে কেন এক লাইনের রেলসংযোগ করা হলো, কেন দুই লাইনের রেলসংযোগ করে বাণিজ্যিকভাবে রেলওয়ে যোগাযোগকে লাভজনক করার বিষয়টি মাথায় রাখা হলো না? সেতুটি থেকে কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক ফায়দা অর্জনের জন্য সেতুর দক্ষিণে ব্যাপক শিল্পায়নের সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকারের পরিকল্পনা না থাকায় বিপুল অর্থব্যয়ে স্থাপিত মেগা প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত জাতীয় উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। বিপুল ব্যয়ে নির্মিত রেলসংযোগ এখন শুধু যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত হওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয় সীমিত রয়েছে। মেগা প্রকল্পটির কাক্সিক্ষত আর্থিক ফায়দা অর্জনের জন্য দক্ষিণ বাংলায় পরিকল্পিত শিল্পায়ন করার আশু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে রেল যোগাযোগের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। তবুও বলবো পদ্মা বহুমুখী সেতু দক্ষিণ বাংলার মানুষকে রাজধানীসহ সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য ছিল। তবে বিপুল খরচে সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করে অর্থের অপচয় করা সংগত হয়নি।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশের সেতু
কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে শিল্পায়ন এবং সেখান থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়কপথ উন্নয়ন, শিল্পায়ন অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা না করে খরুচে নদী তলদেশের সড়ক পথ নির্মাণ এখন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা ছাড়া দক্ষিণ পতেঙ্গায় শিল্পায়ন হবে না। দক্ষিণ পতেঙ্গা থেকে কক্সবাজার করিডোরে পর্যটন শিপ্লের পরিকল্পিত বিকাশ না ঘটলে কখনোই মেগা প্রকল্পটি আর্থিকভাবে লাভজনক হবে না। তবে এটি যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে, বা যারা ব্যাবহার করছেন তাতে আয়ের চেয়ে ব্যয় প্রায় তিনগুণ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতিদিন আয় ১২ লাখের মতো। তবে খরচ প্রায় ৩৭ লাখ। তাহলে এমন প্রজেক্টের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু।
মেট্রোরেল এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে
ঢাকার অস্বস্তিকর যানজট, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য মেগা প্রকল্প দুটির উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে মহান। কিন্তু পরিকল্পনাকালে চ্যালেঞ্জসমূহ সঠিকভাবে পর্যালোচনা করা হলে এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে নিবিড় তদারকি নিশ্চিত থাকলে সময় এবং খরচ সাশ্রয় হতো। বর্তমানে চালু মেট্রো কমলাপুর স্টেশন পর্যন্ত বর্ধিত হওয়ার পর, বাস্তবায়নাধীন দ্বিতীয় মেট্রোর কাজ দ্রুত শেষ করা যেতে পারে। তবে উত্তরা দিয়াবাড়ী থেকে শুরুর স্থান না করে এটা যদি আব্দুল্লাহপুর বা টঙ্গী যদি সূচনাস্থল হতো তাহলে যাত্রীদের জন্য ব্যাপক উপকার হতো। কিন্তু দিয়াবাড়ী হওয়ায় উত্তরার অর্ধেক মানুষের এর প্রতি আগ্রহে ঘাটতি রয়েছে। কারণ ৪ বা ৬ নম্বর সেক্টর বা টঙ্গী ও তার আশপাশ, উত্তরখান দক্ষিণখান, এয়ারপোর্টের আশপাশের মানুষ দিয়াবাড়ী বা সংশ্লিষ্ট স্টেশনে গিয়ে মেট্রো ধরা অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং মনে করে অনেকেই ওই মুখী হতে নিরুৎসাহিত।
অন্যদিকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে কাজের অবশিষ্ট অংশ এবং আশুলিয়া থেকে টাঙ্গাইল রোড পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করলে শুভ প্রভাব পড়বে। আমি মনে করি গাজীপুর থেকে মদনপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন ঢাকা বাইপাস নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঢাকার যানজট নিরসন সম্ভব হবে না। এ কাজগুলো সমন্বিতভাবে করা জরুরি। গাজীপুর থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণাধীন বাস রেপিড ট্রানজিট প্রকল্পটির উপযোগিতা নিয়ে আমি আশাবাদী নই।
মাতারবাড়ি জ্বালানি বিদ্যুৎ হাব, গভীর সমুদ্রবন্দর
মেগা প্রকল্পটির উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারি ছিল। কিন্তু সুসমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে এবং সরকারের দোদুল্যমানতার কারণে প্রকল্পের বিভিন্ন কম্পোন্যান্ট বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যেই মাতারবাড়ি, মহেষখালীতে পরিকল্পিত অনেকগুলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে, এমনকি জাপান সরকারের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা বিদ্যুৎ প্লান্টের দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভূমিভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল কবে শেষ হবে নিশ্চয়তা নেই. কোল ট্রান্সফার টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়ে কিছু জানা যাচ্ছে না। ভূরাজনীতির প্রভাবে গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে বাংলাদেশ কতটুকু অর্জন করবে সেটি নিশ্চিত নয়।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
১২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচে রাশিয়ার আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তায় নির্মাণাধীন ২ ইনটু ১২০০=২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২৫ শেষ নাগাদ উৎপাদনে আসার কথা। একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ সরবরাহের সঙ্গে সংগতি রেখে অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশনের জন্য জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ কাজ চলমান আছে। ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক মাধ্যমে দুর্নীতির একটি অভিযোগ করা হয়েছে, যার যথার্থতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যাহোক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে বেজ লোড হিসেবে অনেক স্বস্তি দেবে।
রেল এবং বিমান যোগাযোগের মেগা প্রকল্প
ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর চালু হলে শুভ প্রভাব পড়বে সন্দেহ নেই। তবে এই ধরনের একটি প্রল্পের কারিগরি অনেক কাজ শেষ না করে সফ্ট উদ্বোধন ছিল নিতান্তই বালখিল্যতা। আশা করি পেশাদার অপারেটর নিয়োগ দিয়ে বিমানবন্দর পরিচালনা কাজে দক্ষতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। এই সঙ্গে বিমান বন্দরের সঙ্গে সড়ক, মেট্রো যোগাযোগের অবশিষ্ট কাজ দ্রুত সমাপ্ত করা হবে। তবে ঢাকার বাইরে অন্য কোথাও আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর স্থাপন অধিকতর উপযোগী হতো।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন আমার কাছে সুসমন্বিত মনে হয় নি। ঢাকা-টঙ্গী চারলেনের রেলপথ পথ নির্মাণ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা জরুরি ছিল। ঢাকা-লাকসাম কর্ড রেল যোগাযোগ প্রকল্প জরুরি ছিল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল যোগাযোগ টেকনাফ হয়ে মায়মানমার-কুংমিং পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলে পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে।
পরবর্তী কোনো সময় রেলপথ, বিমান যোগাযোগ নিয়ে বিস্তারিত লিখবো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সীমিত সময়ে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পগুলোর খরচ নিয়ন্ত্রণ করে সমাপ্ত করতে হবে। এগুলো চালু হলে যেন দেশের অর্থনীতিতে কার্যকরি অবদান রাখতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে কোনো মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে অংশীজনদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে আলোচনা করে প্রকল্পগুলো অনুমোদন করতে হবে। বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।