৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:২৯:৫৮ অপরাহ্ন


মতবিনিময় সভায় নেতৃবৃন্দ
দেশে নারীবান্ধব আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-১২-২০২৪
দেশে নারীবান্ধব আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই মতবিনিময় সভায় নেতৃবৃন্দ


দেশে অনেক নারীবান্ধব আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। সম্পত্তিতে, শিক্ষায়, কাজে সকল ক্ষেত্রে নারীদের সমান অধিকার প্রয়োজন। গত ২ ডিসেম্বর সোমবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা উঠে আসে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে বহুমূখী কর্মসূচির অংশ হিসেবে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ে অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম।

মতবিনিময় সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশ এর অতিরিক্ত ডিআইজি (ফরেনসিক শাখা, সিআইডি, ঢাকা) শম্পা ইয়াসমীন; মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাবিনা ফেরদৌস; আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সহকারী পরিচালক (সিনিয়র সহকারী জজ) ফারিন ফারজানা; সালমা সৈয়দ পলি, উপ-পুলিশ কমিশনার, উইমেন সাপোর্ট এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এসএমএ সবুর, জাতীয় ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির ল্যাবরেটরি প্রধান মো. জাবেদুল আলম খন্দকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড.মো. তৌহিদুল হক, ইউএন উইমেন, বাংলাদেশ-এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর শ্রবণা দত্ত, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপপরিচালক সুস্মিতা পাইক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. মো. আমিনুল ইসলাম, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও নারী অধিকারকর্মীগণ।

শম্পা ইয়াসমীন বলেন, নারীর অধিকার রক্ষায় সংবিধান সবচেয়ে বড় দলিল। সংবিধানের ২৭, ২৮ এবং ২৯ নং অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে বলেন সংবিধানের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখলে নারীর প্রতি বৈষম্য করার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি নারীবান্ধব বিভিন্ন আইনের উল্লেখ করে তিনি সাইবার অপরাধ দমনে বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করছে। তিনি এসময় নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে অনলাইন পরিসেবার কথা উল্লেখ করেন।

ফারিন ফারজানা বলেন, বর্তমানে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার ঘটনা প্রকাশের সংখ্যা খুবই নগন্য। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে ও ঘটছে বিভিন্ন অনাকাঙ্খিত ঘটনা। পারিবারিক সহিংসতার ঘটনার উপস্থিতি জনপরিসরে ও মিডিয়াতে কম। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিটি জেলাতে আইনগত সহায়তা প্রদান করে চলেছে।

ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারী নির্যাতন অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ’৮০ দশকের পর, তবে এর সামাজিক অভিঘাত ও নিষ্ঠুরতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির কারণে উন্নয়নের সুফল কেউ পাচ্ছে না। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তিনি সকল স্টেকহোল্ডারদের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধের জায়গায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। পরিবার হচ্ছে প্রাথমিক ইউনিট-এখানে সর্বপ্রথম সমতা প্রতিষ্ঠা জরুরি, পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন ও উত্তরাধিকার আইনে সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলমান রাখার উপর তিনি এসময় গুরুত্বারোপ করেন।

এস এম এ সবুর বলেন, আমাদের দেশে অনেক নারীবান্ধব আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। সম্পত্তিতে, শিক্ষায়, কাজে সকল ক্ষেত্রে নারীদের সমান অধিকার প্রয়োজন।

মো. জাবেদুল আলম খন্দকার বলেন, ডিএনএ টেস্ট এর মাধ্যমে নির্ভূলভাবে প্রকৃত অপরাধীকে দ্রুত সনাক্ত করা যায়, তিনি বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা দূর করতে এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য ডিএনএ টেস্ট এর জন্য, ল্যাবরেটরীর সংখ্যা বৃদ্ধি করাসহ সকলের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, জাতীয় ডিএনএ ডাটাবেজ তৈরি এবং গবেষণার উপর গুরুত্ব দেন।

সালমা সৈয়দ পলি বলেন, জেলা পর্যায়ে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কার্যক্রম বিস্তৃত করা যেতে পারে। যৌতুক ও পরকীয়া, সাইবার অপরাধসহ বিভিন্ন নতুন ধরনের সহিংসতার ঘটনার সুষ্ঠু বিচারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নতুন ধারা সংযুক্ত করা যেতে পারে, তৃণমূলে আইনী সহায়তা প্রতানকারী সংস্থাসহ সকলকে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।

মো: তৌহিদুল হক বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সবাই সবার কাছে নিরাপদ না ততক্ষণ কেউ নিরাপদ না। সকল প্রকার পারিবারিক বৈষম্য দূর করতে নারী আন্দোলনকে কর্মসূচি চলমান রাখতে হবে, আর্থিকভাবে ক্ষমতাশীল ব্যক্তিদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, আইন প্রয়োগে বিলম্ব নীতি দূর করতে হবে

শ্রবণা দত্ত বলেন, ২০২৩ সালে ৮৫ হাজারের মতো নারীকে বৈশিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ও সামাজিক রীতিনীতি পরিবর্তনে সামাজিক আন্দোলন হওয়ার পাশাপাশি পারিবারিক ক্ষেত্রে ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন প্রয়োজন, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আইনের সংস্কার হতে পারে। সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য শেল্টার হোম এর সাপোর্ট বৃদ্ধি করতে হবে, প্রতিকারের জন্য কমিউনিটি ভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ, দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ বৃদ্ধির উপর এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাবিনা ফেরদৌস কাজের অভিজ্ঞতায় বলেন অনেক আইন থাকলেও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ক্যাম্পেইন প্রয়োজন। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষদের মাঝে বড় পরিসরে প্রচারাভিযান কর্মসূচি পরিচালনা করার পাশাপাশি সম্পদ-সম্পত্তিতে সমানাধিকার ইস্যুতে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। সবার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, প্রত্যেকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা থাকতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। সকলের সহযোগিতায় তিনি নারীর প্রতি সহিংসতা মুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যাশা করেন। 

স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, নারী ও কন্যারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে বিশ্বের কোথাও নিরাপদ নয়, ফলে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের আন্দোলন সমগ্র বিশ্বজুড়ে চলমান। পরিসংখ্যান অনুসারে নারী হত্যা বাড়ছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি ও প্রযুক্তিকে অগ্রসর করতে নারী অবদান রাখছে কিন্তু অংশীদার হতে পারছে না। তিনি নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নারী আন্দোলন সহ সকল অংশীজনদের প্রতি সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করেন।

সভায় অ্যাড. মাসুদা রেহানা কর্তৃক উপস্থাপিত ধারণাপত্রে বলা হয়, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের প্রচার-প্রচারণামূলক কর্মকান্ডের মূল উদ্দেশ্য হলো- ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার, নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন’ এ দাবিটি বিশ্বজুড়ে সকল মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়া। এ প্রচার অভিযানে ধর্ম, বর্ণ, পেশা, রাজনৈতিক পরিচিতি, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে রাষ্ট্রসহ সমাজের সকল মানুষের নারী ও কন্যা নির্যাতন বন্ধে ভূমিকা রাখার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী ও কন্যার বিরুদ্ধে সহিংসতার মূল কারণ হিসেবে- পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কর্তৃত্ব, জোর করে বিয়ে দেয়া, নারীর প্রতি প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংবেদনশীলতার অভাব, অসম ক্ষমতার সম্পর্কসহ বিভিন্ন কারণ অসম পারিবারিক আইন ও প্রথা, বেকারত্ব, দারিদ্র ও বঞ্চনাকে উল্লেখ করে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ২১ দফা সুপারিশসমূহ উপস্থাপন করা হয়।

শেয়ার করুন