৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:৩২:৩৩ পূর্বাহ্ন


নিজ দেশের দিকে নজর দিন, কাচের ঘরে বসে ঢিল ছুড়বেন না দিদি!
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-১২-২০২৪
নিজ দেশের দিকে নজর দিন, কাচের ঘরে বসে ঢিল ছুড়বেন না দিদি! মমতা ব্যানার্জি


সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে সম্প্রতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারত বাংলাদেশ সৎ প্রতিবেশীসুলভ সুসম্পর্কে ভাটা পড়েছে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক ঘটনা বলে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উদ্দেশমূলকভাবে প্রচার করেছে ভারতের পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া। শেষ ঘটনা দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটানোর অভিযোগে বিতর্কিত সংগঠন ইসকনের বহিষ্কৃত নেতাকে (চিন্ময়) গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে দিনদুপুরে আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। 

ভারতের মিডিয়া, উগ্রবাদী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বাংলাদেশবিরোধী নানা ঘটনায় বাংলাদেশ বয়কট ঘোষণা দিয়েছে। ত্রিপুরা আগরতলায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন মিশনে আক্রমণ, কলকাতা ডেপুটি হাইকমিশন মিশনের সামনে ক্রমাগত বিক্ষোভ, ভারতের হোটেল-মোটেল থেকে বাংলাদেশিদের বের করে দেওয়া, বাংলাদেশি রোগীদের ভারতে চিকিৎসা দেওয়া থেকে বাধা প্রদান, সীমান্তবাণিজ্য বন্ধ করা সবই করা হচ্ছে একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বিদ্যমান স্বাভাবিক সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টির জন্য ভারতের রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর আত্মধ্বংসী কার্জকলাপের অশুভ প্রভাব ইতিমধ্যে অনুধাবন করছে পশ্চিমবাংলা এবং বাংলাদেশের সীমান্ত-সংলগ্ন ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলো।

পেছনে ফিরে তাকালে দেখবো ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ প্রায় তিন দিক-পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর দিক থেকে ভারতবেষ্টিত। প্রায় সব নদনদী ভারত, নেপাল থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদীবাহিত পলিমাটির দেশ। ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত অন্ন, অর্থ, আশ্রয়, অস্ত্রসহ সামরিক সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সেই সুবাদে বাংলাদেশ কম প্রতিদান দেয়নি। অথচ আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুনের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়ে ভারত বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনের ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত করে রেখেছে। শুষ্ক মৌসুমে একতরফাভাবে উজানে পানি অপসারণের জন্য বাংলাদেশের বিশাল অংশ মরুকরণ হচ্ছে। 

অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত জল ছেড়ে দিয়ে প্লাবিত করছে বাংলাদেশকে। নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনায় রাজি হয়নি ভারত। সীমান্তে মাঝেমধ্যে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে বাংলাদেশিদের। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের পূর্ব থেকে পশ্চিমে সড়ক, রেল, জলপথে যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশ দরজা-জানালা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশকে নেপাল, ভুটানের সঙ্গে চিকেন নেক ব্যবহার করে বাণিজ্য. বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে চলছে গড়িমসি। অসংখ্য ভারতীয় বাংলাদেশে চাকরি এবং বাণিজ্য করলেও বাংলাদেশিদের ভারতে সেই সুযোগ নিতান্তই সীমিত। এসব নানা কারণে ভারত সরকারের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ জনসাধারণের তীব্র ক্ষোভ সংগত ভাবে দানা বেঁধেছে।

ভারত-বাংলাদেশ বৈরী মনোভাবের আরো একটি কারণ সম্প্রতি গণবিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারকে একতরফাভাবে ভারতীয় সমর্থন। জনতার আন্দোলনের পর পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে শেখ হাসিনা। তার বিরুদ্ধে দেশে গণহত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই সাধারণ মানুষ ভারতের ভূমিকাকে সহজভাবে নেয়নি, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই ভারতের মিডিয়ায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পকাহিনি প্রচার করে বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করছে ভারতীয় মিডিয়ার একটি অংশ।

ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করবে না এটি যদি সরকারের সিদ্ধান্ত হয় ভালো কথা। সীমিত সময়ের জন্য বাংলাদেশের কিছু সমস্যা হবে, মানিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের সহজ বাজার হারিয়ে ভারতের কি সমস্যা হবে না? বাংলাদেশে ভারতীয়রা কাজ না করলে রেমিট্যান্স হারাবে। পশ্চিম বাংলা বিশেষ করে কলকাতার অনেক মানুষের ব্যবসাবাণিজ্য সংকীর্ণ হবে, যার আলামত সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কলকাতা-ত্রিপুরা-মেঘালয় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হলে ভারতীয় অর্থনীতি কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? সেভেন সিস্টার কি আরো বিক্ষুব্ধ হবে না?

ভারত বিশাল অর্থনীতির দেশ, কিন্তু বাংলাদেশ নিজস্ব সম্পদের ওপর ভিত্তি করে একটি সচেতন আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। ভারত এই সহজ সত্য মেনে না নিলে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশে দাবি উঠছে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত সব চুক্তি প্রকাশ করার। আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি, মীরসরাই অঞ্চলে ভারতের জন্য বরাদ্দ করা এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন চুক্তি বাতিল বা একতরফা ধারাগুলো পরিহার করার যৌক্তিক দাবিগুলো এখন জোরালোভাবে প্রকাশিত হবে। মোদ্দাকথা, ভারতের স্বার্থহানি হবে অনেক বেশি।

শেষ কথা, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনুকরণীয়। হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান, পাহাড়ি, সমতল ভূমির মানুষ মিলে মিশে বাস করছে শান্তিতে। এখানে সাম্প্রদায়িক ঘটনা নিয়ে ক্রমাগত অপপ্রচার করে বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করার কোনো অবকাশ নেই। দেখে হতবাক গতে হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর সুপারিশ করেন। অথচ ভারতের কাশ্মীর, গুজরাট এমনকি মাঝে মাঝে পচিম বঙ্গের দাঙ্গা বিক্ষোভ দমনে পশুশক্তি ব্যবহার হচ্ছে অহরহ। ফলে কাচের ঘরে বসে ঢিল ছুড়বেন না দিদি।

শেয়ার করুন