৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:৩৬:০৮ পূর্বাহ্ন


বাংলাদেশে নির্বাচনের প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনের খেলা
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৯-২০২৫
বাংলাদেশে নির্বাচনের প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনের খেলা প্রতীকী ছবি


বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ এখনো ঘোষণা করা হয়নি। সময় বাকি আছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। কিন্তু রোড ম্যাপের সন্ধান প্রকাশিত হলেও অনুসন্ধান অবিরত রয়েছে। এর মধ্যে যেসব ঘটনা চক্ষুকে চড়কগাছে তুলেছে, তাহলো ক্রমাগত নৃশংসতা, শিশু-কিশোর থেকে রাজনৈতিক কর্মী হত্যা, নির্যাতন ও ধৈর্যহীন সময়। বাংলাদেশে সংস্কারের নামে এক অর্ধমুর্খের হাতে দায়িত্বভার দিয়ে সময়ক্ষেপণ, প্রধান উপদেষ্টার ওপর নির্ভরতা ও রাজনীতি নিয়ে সম্যক ধারণার কমতি, সংস্কারে বসে যারা সময়ক্ষেপণ করছেন তাদের বোধহীন উক্তি ইত্যাদি। এর মধ্যে দেখা গেছে, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বিরুদ্ধে নিউইয়র্কে সরাসরি বিক্ষোভ, অনেককে লক্ষ্য করে ডিম মারা হয়েছে, লাথি মেরে ভাঙা হয়েছে কনস্যুলেট জেনারেলের দরজা। যেসব অতিথিদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে, তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ কনসাল জেনারেল। আর ২৪ আগস্ট রোববারের অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনের কোনো প্রতিনিধি না থাকা এবং কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসে শেখ হাসিনাপন্থীদের মধ্যমণি করে বসার সুযোগ দান ইত্যাদি। তারপর দেখা গেছে, ২৪ আগস্টের অনুষ্ঠানে কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। সেদিন ছিল রোববার। পুলিশ এসেছে কনস্যুলেটের দরজা ভেঙে ফেলার পর। বয়স দেখে মনে হয় কনসাল জেনারেল তার অভিজ্ঞতা এখনো সঞ্চয় করতে পারেননি। অবশ্য সংঘটিত ঘটনা তার অভিজ্ঞতাকে বাড়াবে তাতে সন্দেহ নেই। ওয়াশিংটন থেকে এসেছিলেন প্রেস সেক্রেটারি। তিনি তার বক্তৃতায় উপস্থিত ঘটনা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। পরে অবশ্য ঘটনা নিয়ে যে বিবৃতি তিনি দিয়েছেন, তা নেহায়েত গা-বাঁচানোর বিবৃতি বলে মনে হয়।

পরবর্তীকালে বাংলাদেশে নুরুল হক নুরের জাতীয় পার্টির অফিসের দিকে ‘জয়যাত্রা এবং পরে সেনা সদস্যদের হাতে কিংবা পুলিশের হাতে বেদম মার খেয়ে হাসপাতালে ভ্রমণ ইত্যাদির কারণে কপালে ওঠা চোখ নামাতে পারিনি অদ্যাবধি। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে কে বা কারা যেন সবকিছু তালগোল পাকিয়ে দিতে ব্যস্ত। আর মাহফুজ আলমের ওপর হামলা যেন এ গোল পাকানোর প্রাথমিক টেস্ট কেস। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। কারণ কতগুলো বিষয় নিশ্চিত হওয়া চাই-(১) রোববারে সাধারণত নিউইয়র্কে যে কোন গণজমায়েতে লোক বেশি হয় আর তা কনস্যুলেটের দীর্ঘদিনের কর্মকর্তাদের অজানার বিষয় নয়। তাহলে রোববার সেখানে আগে থেকেই কেন পুলিশ মোতায়েন করা হলো না। কেন বিক্ষোভকারীদের কনস্যুলেটের দরজায় বিক্ষোভ করতে দেওয়া হলো? কনস্যুলেটের কোন কর্মকর্তার ইন্ধন ছিল? বিক্ষোভকারীদের দরজায় দেখে কেন তিনি পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বললেন না? (২) কেন স্থায়ী মিশনের কোনো লোক সেখানে উপস্থিত ছিল না। (৩) কেন হাসিনাপন্থী লোককে আমন্ত্রণ জানানো হলো। যেখানে আন্দোলনে যোগ দেওয়া অনেক গণ্যমান্য লোক বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল নয়। (৪) কনস্যুলেট জেনারেল অফিসের কাজ কি সুষ্ঠুভাবে চলছে? (৫) মাহফুজ আলমকে সরাসরি মারতে পারেনি বলে ওয়াশিংটনের প্রেস কর্মকর্তার বাহবা নেওয়া কি আসলে কোন প্রয়োজনীয় বিষয় ছিল? জানি এ লেখা সবার অগোচরে চলে যাবে। কোনো প্রতিকার হবে না। কোনো ব্যবস্থা হবে না। কিন্তু এর পরপর বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা যদি বিশ্লেষণ করি দেখা যায় ড. কামাল হোসেনের নাম ভাঙিয়ে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর সংবাদ সম্মেলন আহ্বান। সেখান থেকে লতিফ সিদ্দিকীসহ ১৬ জনকে আটক ও বিচারের সম্মুখীন করা। কামাল হোসেনের সংগঠন গণফোরাম এ সংবাদ সম্মেলনে কামাল হোসেনের নাম তাদের না জানিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। আর এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে দেখা গেছে, নুরের জাতীয় পার্টিকে আক্রমণ করে বক্তৃতা। আর মিছিল যাত্রা-মার খাওয়া। বলা হচ্ছে, তাকে মারার পেছনে সব নির্দেশনা গিয়েছে সেনাবাহিনী থেকে। নুর সাম্প্রতিক সময়ে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন। চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে অনেক কিছুতে তাকে জড়িয়ে খবর বেরিয়েছে। সেসবের তিনি কোনো প্রতিবাদ করেননি। সর্বোপরি তার সঙ্গে ইসরাইলের গোয়েন্দা মোসাদের যোগাযোগ হয়েছে বলে তিনি নিজেই একসময় স্বীকার করেছেন। আসলে ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের সময় নুরের ভূমিকা আর ২০২৪ সালে তার ভূমিকা সম্পুর্ণ ভিন্ন। ২০২৪ সালে তিনি বস্তুত কারাগারে ছিলেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি চুপ হয়ে যান। এখন নতুন করে আবার শুরু করছিলেন। জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলে তিনি কাকরাইলে মিছিল করলেও অদ্যাবধি নুরুল হক নুর কিন্তু আওয়ামী লীগের কর্মতৎপরতা নিষিদ্ধ করার বিষয়ে কিছু বলেননি। অনেকে মনে করেন তার রাজনীতিতে কিছুটা অস্বচ্ছতা রয়েছে। আর যে কারণে এক্ষনে তার ‘অ্যাকাউন্ট’ কিছুটা শিথিল হয়ে পড়েছে। আইএসপিআর তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সেনাসদস্যদের আহত হওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু নুরুল হক নুরের ব্যাপারে বিশেষ কিছু উল্লেখ করেননি। তাহলে বলতে হয় নুরের ওপর হামলার বিষয়টি কোন ‘ডিপ স্টেট’ গোষ্ঠীর কাণ্ডকারখানা। যারা একসময় নির্বাচনের পক্ষে থাকলেও এখন নির্বাচনের বিরুদ্ধে। 

সেনাবাহিনী থেকে এক সময় জোরালোভাবে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচনের ধুয়া তুলেছিল। কিন্তু তিনি এখানে সে ধুয়া পরিহার করেছে। তিনি চীন সফর করে আসার পর তার কথা সংযত হয়েছে। তবে তার সেনা মহল থেকে চলছে বিভিন্ন ব্যবস্থা, যা কি না প্রশ্নের উদ্রেক করে। তাহলে তিনি এখন নির্বাচনের জন্য তেমন উদ্বেগ পোষণ করেন না? নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায় যেন তার নেই। নির্বাচন যেন সেকেন্ডারি বিষয়। না হলেইবা ক্ষতি কি? বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকলে লাভ বা ক্ষতি কার। আওয়ামী লীগ ভারতের তল্পিবাহক হয়ে নির্বাচনকে কুক্ষিগত করে রেখে গণতন্ত্রের যে উলঙ্গ নীতির চর্চা করেছে, তা তো সবাই দেখেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র কি, তাহলে ফ্যাসিবাদের ভিন্নরূপ বাংলাদেশে? এ ‘গণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের’ প্রয়োজন আছে কি?

আবার যারা নির্বাচনকে কলঙ্কিত করতে চায়, তাদের একটা মত আছে। মতটা হলো আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনা। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। তার ছেলে জয় বাংলাদেশে আসলে অর্থ পাচারের জন্য গ্রেফতার হবে। আমেরিকার সিটিজেন হলেও জয় আমেরিকায় খুব শান্তিতে নেই। আওয়ামী লীগকে প্রথমদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার দেওয়ার জন্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দাবি ছিল। কিন্তু দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের কর্মতৎপরতা নিষিদ্ধ করলে বিএনপি তাকে সাধুবাদ জানায়। অথচ বিএনপি এখন জনগণের কাছে এক অচেনা দল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন ৬ বছর যাবৎ বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ভারতে কি করেছেন তার কোনো তথ্য জনগণের কাছে নেই। শুধু তাই নয়, ভারত তাকে কি শিক্ষা দিয়ে পাঠিয়েছেন তা-ও কেউ জানে না। বিএনপি কিংবা বর্তমান সরকার তার কাছে কোনো তথ্য চাননি। এ লোকের তদন্ত হওয়ার প্রয়োজন ছিল; কিন্তু হয়নি। এর মধ্যে হঠাৎ করে সব জায়গা থেকে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর ছবি নামানো হয়। হঠাৎ এক বছর পর তা কেন করা হলো তার কোনো হদিস নেই। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বিদেশের মিশন থেকে ছবি নামানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তৌহিদ হোসেন এর কোনো ব্যাখ্যা দেননি। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর নিশ্চিত এখন দোদুল্যমান। কারণ অনেকে চায় না আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে। তার মধ্যে বিএনপি এক নম্বরে রয়েছে। চুপ্পুর ছবি নামানোর পেছনে এক রহস্য কাজ করছে। অনেকে মনে করেন চুপ্পুকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে তাকে দিয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্জাগরণের এক একটা কৌশল ছিল। কিন্তু ছবি নামিয়ে চাপ দিলেও চুপ্পু আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনে হাত দিতে রাজি নয়। ইতোপূর্বে কেউ কেউ আবদুল হামিদ সাহেবকে দিয়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি এখন অসুস্থ। এরপর চেষ্টা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের আইভীকে দিয়ে আওয়ামী লীগ গঠন করা। তিনি রাজি নন। সর্বশেষ শোনা গেছে সাবের হোসেন চৌধুরীকে দিয়ে আওয়ামী লীগ করে তার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার। বিষয়টি এখনো অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনে তার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তিনি বরিশালের ছেলে, তিনি যদি আওয়ামী লীগের হাল ধরেন, তাহলে তাকে ঠেকানো সহজ হবে না। তবে তার বিষয়টি গৌণ। এ কথা বলে তিনি নিশ্চুপ। এখন নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নামে কোনো দল থাকবে কি থাকবে না? বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত। 

এদিকে অনেকের মন্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশে নির্বাচন না হলে লাভ কার। একসময় ভারত নির্বাচন চেয়েছিল। এখনো চাচ্ছে। কিন্তু ভারতের নির্বাচন চাওয়া এখন শ্লথ হয়ে পড়েছে। কারণ বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা না হলে তা ভারতেরই লাভ। এখন তারা বোধহয় নতুন করে চিন্তা করছে। চীনের কাছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ধার রয়েছে। তবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকলো কি থাকলো না তাতে চীনের কিছু যায় আসে না। এরপর আছে আমেরিকা, আমেরিকা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে তার সব কাক্সিক্ষত কাজ উদ্ধার হয়েছে কি না। এরপর দেখা গেছে, আঞ্চলিক রাজনীতির পাটাতন পরিবর্তিত হয়েছে। এখন চীন, রশিয়া ও ভারতের মাধ্যমে নতুন মোর্চা হচ্ছে। এতোদিন চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নিয়ে কথা ছিল, যা ছিল চীন, পাকিস্তান ও রাশিয়ার সমঝোতায়। বিপরীতার্থ মেরুকরণ। কাজেই বাংলাদেশে নির্বাচনের প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনের খেলা এখনই জমে উঠছে। সমাধানও হয়নি। 

বাংলাদেশে দেখা গেছে, নির্বাচিত সরকারের চেয়ে একমাত্র ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ছাড়া অনির্বাচিত সরকারই ছিল সবচেয়ে সহনীয় সরকার। কাজেই নির্বাচন নিয়ে ভাবার এখনো সময় আছে। বিষয়টি নিয়ে আরেকদিন লেখা হবে।

শেয়ার করুন