প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রায় সব দফতরের তথ্যভান্ডার একীভূত হয়ে যাচ্ছে এআই সফটওয়্যার প্যালান্টির টেকনোলজিসের প্ল্যাটফর্মে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্দেশ জারি করেন, যাতে বলা হয়-আমেরিকার সব সরকারি দফতরের তথ্যভান্ডার একটি কেন্দ্রীভূত সিস্টেমে আনা হবে এবং সেই সিস্টেম চালাবে বেসরকারি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান প্যালান্টির টেকনোলজিস। কর, স্বাস্থ্য, অভিবাসন, সামাজিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলাসহ প্রায় সব তথ্যভান্ডারকে একটি মাত্র সফটওয়্যার প্ল্যাটফর্মের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। সরকার বলছে, এটি দক্ষতা, নিরাপত্তা ও সমন্বয় বাড়াবে। ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যাখ্যা, এতে তথ্য বিশ্লেষণ সহজ হবে, নীতি প্রণয়ন দ্রুততর হবে এবং নিরাপত্তা জোরদার হবে। কিন্তু সমালোচকদের আশঙ্কা, এতে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে নামে নতুন এক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে অর্থাৎ সাধারণ নাগরিকরাই সরকারের নজরদারির প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এটি আসলে আমেরিকান নাগরিকদের জীবনযাপন, অর্থনীতি ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর নজরদারি কড়াকড়ি করার একটি ডিজিটাল অস্ত্র।
প্যালান্টির সূচনা হয়েছিল প্রতিরক্ষা খাতে। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি মূলত সিআইএ, পেন্টাগন ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ শুরু করে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সময় প্যালান্টিরের ডাটা বিশ্লেষণ সফটওয়্যার সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। পরে তারা ধীরে ধীরে বেসামরিক খাতেও প্রবেশ করে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় হাসপাতাল ও ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশনের তথ্য ব্যবস্থাপনায় কোম্পানিটি সরকারকে সহায়তা করে। এভাবে জাতীয় নিরাপত্তার হাতিয়ার থেকে প্যালান্টির ধীরে ধীরে পরিণত হয় একটি সর্বগ্রাসী সরকারি ডাটা কমট্রোলারের ভূমিকায়।
আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যাংক সবাই এখন নির্ভর করছে একটি সফটওয়্যার কোম্পানির ওপর যার নাম প্যালান্টির। কোম্পানিটির বর্তমান মূল্য প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার, অথচ সাধারণ মানুষ এর নামও খুব একটা শোনেনি। ২০০৩ সালে ৯/১১ হামলার পর প্যালান্টির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার মূল লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসী হামলা ঠেকানো। প্রথমে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অর্থ দিতে রাজি হননি, কিন্তু সিআইএ থেকে ২ মিলিয়ন ডলার প্রথম অর্থায়ন হিসেবে আসে এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাই প্রথম গ্রাহক হয়। প্যালান্টির ফোনকল, ইমেইল, ব্যাংকের হিসাব, সিসিটিভি ফুটেজ, পুলিশের তথ্যসহ সব ডাটা একত্র করে বিশ্লেষণ করে, লুকানো যোগসূত্র বের করে এবং মানুষের ভবিষ্যৎ আচরণও অনুমান করে।
প্যালান্টির প্রধান দুটি ব্যবহারিক সফটওয়্যার হলো ‘গথাম’ এবং ‘ফাউন্ড্রি’। ‘গথাম’ সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের জন্য তৈরি, যা সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক শনাক্ত করে টার্গেট মুহূর্তে নজরে আনে; ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজতেও এই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছিল। ‘ফাউন্ড্রি’ সরকার ও কোম্পানির জন্য ব্যবহৃত হয়, যা অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, পরিবহনসহ সব তথ্য একত্রিত করে এবং সিমুলেশন চালিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পূর্বাভাস দেয়, যেমন এয়ারবাস বিমানের ত্রুটি ধরানো, ফেরারি গাড়ির রেসের কৌশল ঠিক করা, হাসপাতাল ও রোগীর চাহিদা পূর্বানুমান করা।
অভিবাসন দফতর ও আমেরিকান পরিবার
ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইচএস) এবং ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) প্যালান্টির সবচেয়ে বড় ক্লায়েন্ট। এখানে ব্যবহৃত হয় প্যালান্টির ফ্যালকন এবং গথাম প্ল্যাটফর্ম। এর মাধ্যমে অভিবাসীদের গতিবিধি, ফোন রেকর্ড, ব্যাংক তথ্য, এমনকি পারিবারিক সংযোগ পর্যন্ত ট্র্যাক করা হয়। এর ফলে শুধু অনাগরিকরাই নয়, তাদের সঙ্গে থাকা আমেরিকান নাগরিকরাও নজরদারির আওতায় আসছেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন নাগরিক যদি তার আত্মীয় বা স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন যিনি আনডকুমেন্টেড বা নথিবিহীন, তাহলে তারও সব ডাটা সরকারের নজরে চলে যাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এটি পরিবার ভাঙনের পাশাপাশি নাগরিকদের স্বাধীনতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
কর দফতর ও আর্থিক নজরদারি
ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিস (আইআরএস) প্যালান্টির সাহায্যে একটি বৃহৎ ডাটাবেস তৈরি করছে। এই সিস্টেমে প্রতিটি ট্যাক্সপেয়ারের আয়, খরচ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, লোন-এমনকি লেনদেনের ধরনও এক জায়গায় সংরক্ষণ হবে। ট্রাম্প প্রশাসনের যুক্তি-এতে কর ফাঁকি ধরা সহজ হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এটি সরকারের হাতে আমেরিকান নাগরিকদের আর্থিক জীবনের ওপর নজিরবিহীন নিয়ন্ত্রণ এনে দেবে। কংগ্রেসম্যান ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রশ্ন তুলছে-কর ফাঁকির নামে সাধারণ নাগরিকদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক গোপনীয়তা কি বলি দেওয়া হচ্ছে?
স্বাস্থ্য দফতর ও রোগীর ডাটা
ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস (এইচএইচএস) এবং সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) দীর্ঘদিন ধরেই প্যালান্টির ফাউন্ড্রি ব্যবহার করছে। কোভিড-১৯-এর সময় এটি ভ্যাকসিন বিতরণ, হাসপাতাল রিসোর্স এবং রোগীর ডাটা ট্র্যাক করতে ব্যবহার হয়েছিল। কিন্তু এখন এই ডাটাবেইজে আমেরিকান নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রেকর্ড যুক্ত হওয়ায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। গোপনীয়তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য অত্যন্ত সংবেদনশীল-এটি সরকার বা করপোরেট হাতে গেলে নাগরিকদের চাকরি, বীমা বা সামাজিক সুবিধার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সামাজিক নিরাপত্তা ও পেনশন তথ্য
সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এসএসএ)-এর সঙ্গেও প্যালান্টির ডাটা সংহতির পরিকল্পনা চলছে। যদি এটি কার্যকর হয়, তাহলে নাগরিকদের সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর (এসএসএন), মেডিকেয়ার সুবিধা, পেনশন রেকর্ড এবং অন্যান্য আর্থিক সুবিধার তথ্য একত্রিত হবে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এতে নাগরিকদের জীবনযাত্রার প্রতিটি দিক সরকার পর্যবেক্ষণ করতে পারবে এবং ভবিষ্যতে এটি রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হতে পারে।
পুলিশ বিভাগ ও প্রেডিকটিভ পুলিশিং
শুধু ফেডারেল নয়, স্থানীয় পুলিশ বিভাগগুলোও প্যালান্টির গথাম সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। এটি একটি ভবিষ্যত নির্ধারণমূলক পুলিশিং সিস্টেম-যেখানে অতীত অপরাধের তথ্য, ভৌগোলিক ডাটা এবং ব্যক্তিগত সংযোগ বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে কে অপরাধে জড়াতে পারে তার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। অনেক সময় এ সিস্টেমের কারণে নির্দোষ মানুষ, বিশেষ করে সংখ্যালঘু ও অভিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ অযথা পুলিশের টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন। সমালোচকরা একে বলছেন, ‘ডিজিটাল প্রোফাইলিং’ যেখানে ডাটার ওপর ভিত্তি করে মানুষকে আগেভাগে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আমেরিকানদের বিরুদ্ধে বিতর্ক
যদিও সরকার বলছে প্যালান্টির ব্যবহারে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়বে, কিন্তু বাস্তবে এটি নাগরিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অভিবাসন দফতরে পরিবার ভাঙন, কর দফতরে ব্যক্তিগত আর্থিক তথ্য, স্বাস্থ্য খাতে রোগীর গোপনীয়তা, সামাজিক নিরাপত্তায় পেনশন রেকর্ড এবং পুলিশের হাতে একটি ভবিষ্যত নির্ধারণমূলক পুলিশিং-সব মিলিয়ে প্যালান্টির এখন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে আমেরিকান জনগণের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র সরকারের চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
তবে প্যালান্টির কিছু বিতর্কিত দিকও আছে। ২০১২ সালে কোনো অনুমতি বা তদারকি ছাড়াই নিউ অরলিন্সে পুলিশকে সাহায্য করে সম্ভাব্য “ভবিষ্যৎ অপরাধী” চিহ্নিত করতে। এছাড়া ধনকুবের জেপি মরগ্যান নিজের কর্মীদের গোপন নজরদারি চালিয়েছিল, তাদের ইমেইল, কল, অফিসে প্রবেশ, এমনকি ইন্টারনেট ব্যবহার পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখেছিল। টানা ১৭ বছর লোকসানে থাকার পরও প্যালান্টির আজ প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। ২০২৫ সালে ট্রাম্প নির্দেশ দেন আমেরিকার সব সরকারি দফতরের তথ্যভাণ্ডার-কর, স্বাস্থ্য, অভিবাসন, নজরদারি- প্যালান্টির সঙ্গে যুক্ত করতে। এক সময়ের ছোট্ট সফটওয়্যার কোম্পানি এখন আমেরিকার গোয়েন্দা, সেনাবাহিনী, সরকারি দফতর ও বড় করপোরেটের মূল ভরসা হয়ে উঠেছে, যার পেছনে আছেন সিলিকন ভ্যালির বেতাজ বাদশা, প্রচণ্ড রগচটা পিটার থিয়েল।
সমালোচনা ও প্রতিরোধ
ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা, সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্যালান্টির ব্যবহারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কংগ্রেসে কয়েকজন সেনেটর প্রশ্ন তুলেছেন-সরকারি তথ্যভান্ডার একটি বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া কি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি নয়? সাংবাদিক ও গবেষকরা বলছেন, প্যালান্টিরের প্রযুক্তি কেবল বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে নয়, বরং আমেরিকান নাগরিকদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ওয়াচডগ সংস্থাগুলো দাবি করছে, নাগরিকদের সম্মতি ছাড়াই তাদের ব্যক্তিগত ডাটা এভাবে একীভূত করা সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করছে।
ভবিষ্যৎ আশঙ্কা
যদি সব দফতরের তথ্য একত্রিত হয়ে প্যালান্টিরের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তাহলে এটি এক প্রকার ‘ডিজিটাল নজরদারি রাষ্ট্র’ তৈরি করবে। সরকার তখন শুধু নাগরিকদের কর বা স্বাস্থ্য নয়, তাদের সামাজিক যোগাযোগ, অনলাইন কর্মকাণ্ড, আর্থিক লেনদেন সবকিছু ট্র্যাক করতে পারবে। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, এটি স্বাধীন গণতন্ত্র থেকে ধীরে ধীরে একটি ডাটা-চালিত কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে প্যালান্টির টেকনোলজিস যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক দক্ষতার অজুহাতে প্যালান্টির এখন এমনভাবে আমেরিকান নাগরিকদের জীবনে প্রবেশ করেছে, যা গোপনীয়তা, স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। সরকার যেভাবে প্যালান্টির ব্যবহার করছে, তাতে অনেকের চোখে এটি আমেরিকানদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ আমেরিকান জনগণের নিজস্ব স্বাধীনতা ও অধিকারকেই সীমিত করার হাতিয়ার।