১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০৪:১৯:১৯ পূর্বাহ্ন


‘নির্দোষ’ ইউনূস সরকার বেখবর
বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় উদ্বাস্তু ক্যাম্পের নকশা
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৭-২০২৫
বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় উদ্বাস্তু ক্যাম্পের নকশা


বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান ক্রমান্বয়ে এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। সমগ্র ভারত থেকে বাংলাভাষী সব মুসলিম নাগরিককে ভারত ক্রমান্বয়ে শুধু চিহ্নিতই করছে না, বরং তাদের একত্রিত করছে। আসামে চিহ্নিত করা হয়েছে বিজেপির ভাষায় ‘পুশ ব্যাক’ করার জন্য ১৯ লাখ বাংলাভাষী, যারা সেখানে ১৯৭১ সালের আগেই বসতি স্থাপন করেছিল। ভারত সরকার ক্রমান্বয়ে অল্প অল্প করে বাংলাভাষী মুসলিমদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে। সিলেট থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চলে মুসলিম বাংলাভাষীকে ‘পুশ ব্যাক’ করার কাজ চলছে। যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশি বলে তাদের অনেকেই চিৎকার করে ভারতীয় বলে দাবি করলেও তাদের আর্তচিৎকার ভারতের সীমান্ত চৌকিদারদের কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। বাংলাদেশের বর্তমান বলতে গেলে ‘নির্দোষ’ শাসকরা এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন না। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার মুখ থেকে যেমন এ নিয়ে কোনো কথা শোনা যায় না, তেমনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনেরও কোনো বক্তব্য নেই। এক্ষেত্রে বোধগম্য নয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান তার কর্মতালিকায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছেন কি না? বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এতোটাই নির্বোধের মতো আচরণ করছে, বিষয়টি যেন কোনো ধরনের ব্যবস্থাধীনে আনার মতো নয়। 

দীর্ঘদিন ধরে একটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে, বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত এখন তেমন শোনা যায় না। হিন্দুদের নিরাপত্তা বিধানে সরকারের কোনো অবদান আছে কি না বলা মুশকিল। কিন্তু তাতে যে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর অবদান রয়েছে তা বলাবাহুল্য। তারা হিন্দুদের ঘরে ঘরে গিয়ে বুঝিয়েছে, নিরাপত্তার বিষয়ে বাক্যবিনিময় করেছেন। কিন্তু সরকারি সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী কিংবা অন্যান্য বাহিনীরা কিছু করেছে কি না তার নজির নেই। তবে দেখা গেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী গ্রুপকে সরকার কিছুটা দমন করেছে। যেমন বহিষ্কৃত ইসকন নেতা চিন্ময়। যাকে ভারত ব্যবহার করতে চেয়েছে। পরম্পরা দেখা গেছে, ভারতের পক্ষ থেকে এ উসকানি আর নেই। কিন্তু লক্ষণীয়, ভারত এক বৃহত্তর চাল চালানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শঙ্কা জাগে আসামের চিহ্নিত মুসলিমদের বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করার জন্য ভারত কি উপায় খুঁজছে।

সবকিছু ছাড়িয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি ধন্যবাদ দেওয়া যায়-তাহলো এ সরকারপ্রধান ড. ইউনূস ভারতকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভূখণ্ড ও ভূখণ্ডবাসীদের দিয়ে কি করতে পারেন। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করলে উত্তর পূর্বাঞ্চলও অস্থিতিশীল হবে এক উক্তি করে ড. ইউনূস যদিও ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জাতিগত মেরুদণ্ডকে সোজা করে দিয়েছে, তারপরও দেখা যায় এর সংশ্লেষ নেই। নেই কোনো পরবর্তী প্রভাব। ইতোমধ্যে ভারত তার স্থলবন্দরসমূহ বাংলাদেশি পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বন্ধ করে দিয়েছে। আদানির সঙ্গে বিশ্বে নজিরবিহীন বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তির কোনো সুরাহা না করে তার পাওনা দিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ভারত চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতর থেকে এর কোনো প্রতিবাদ নেই। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে যেসব উপদেষ্টা রয়েছেন তাদের আওয়াজ দিনদিন ক্ষীণতর হচ্ছে। অনেকের আওয়াজ শোনা যায় না। যাদের আওয়াজ শোনা যায়, তাদের কোণঠাসা করার প্রয়াস চলছে। সংস্কার কমিশনের জগদ্দল পাথর আলী রীয়াজ, যিনি নিজে কোনোদিন শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে কিছুই লিখেননি, তিনি মানুষের কাছ থেকে ধার করা বিদ্যা নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব রেখেছেন। যুক্তির ধার গ্রহণ না করে তিনি যেসব কাণ্ডকীর্তন করছেন তা নেহায়েত হাস্যকর। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতো লোককেও এ সরকার বিবেচনায় নেয়নি। অথচ তিনি ভারতে গিয়ে যেভাবে সেখানে মুসলিম দলনের বিষয়টি বাংলাদেশে প্রভাব ফেলে তা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তার ফ্রন্টলাইনে প্রকাশিত দীর্ঘ সাক্ষাৎকার এ বিষযে প্রণিধানযোগ্য। অথচ বাংলাদেশে তার কোনো দাম নেই। কোনো বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের নেই কোনো আলোচনা। সংস্কার কমিশন মাঝেমধ্যে বসেন সংস্কার নিয়ে, কিন্তু সেখানে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেই। আলী রীয়াজ নিজেই একজন ভুয়া ফকফিকার আর তিনি বসে আছেন মাঝির আসনে। পরিশেষে যদি তিনি অশ্বডিম্ব প্রকাশ করেন, তাতে তার কোনো দায় নেই। দায় থাকবে প্রধান উপদেষ্টার। 

এখনো বাংলাদেশে চলছে ‘সংস্কার বনাম নির্বাচন’ নিয়ে খেলা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি চাচ্ছে নির্বাচন। ভারতও চায় নির্বাচন। কারণ মনে করা হচ্ছে, নির্বাচনই নিয়ামক শক্তি, ঠিক আছে। ধরে নিলাম নির্বাচনই নিয়ামক শক্তি। কিন্তু নির্বাচনের পর যে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা আসবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? কিন্তু অন্যদিকে তাকালে দেখা যায়, জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদের ‘বুলেট’ নিয়ে চলাফেরা প্রকাশ্যে এসেছে। কাজেই তাতে অন্যান্য সমন্বয়করা যে, প্রভাবিত হবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? বা তার মতো আরো সমন্বয়ক যে ঘাপটি মেরে নেই তার কি প্রমাণ?

এ সরকারের অনেক সুবিধা ছিল। যেমন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালানোর জন্য একটি কমিটি গঠন করা যেতো। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরো দক্ষ শক্তির হাতে ন্যস্ত করা যেতো, যেমন প্রফেসর শহীদুজ্জামান, যাকে বিশ্বের বুদ্ধিজীবী মহল সম্মান করে কথা বলেন। যিনি ভারতের চানক্য নীতির সমালোচক। অন্তত তাকে দিয়ে পররাষ্ট্রবিষয়ক কার্য চালানো যেতো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ড. ইউনূসের স্বজনপ্রীতির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। নুরজাহান বেগম নামে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী। তার নেই কোনো যোগ্যতা। অন্যদের কথা বলা যায় না, তবে এটুকু বলা যায় জুলাই বিপ্লবের সব দই ‘নেপোরা’ মেরে দিচ্ছে। নেপোরাই আজ ক্ষমতায়। যারা দই বানিয়েছে তারা আজ লাইনচ্যুত। 

বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের পেছনে একদিকে যেমন রয়েছে তৎকালীন ক্ষমতাশালী সরকারের ফ্যাসিবাদী নীতি, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে ছাত্র ও গণমানুষের অকাতরে জীবনদানের প্রতিশ্রুতি। শুধু তাই নয়, এ বিপ্লবের পেছন বিদেশি শক্তির ইন্ধনও ছিল প্রচণ্ড। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মদত ছিল স্পষ্ট। যেভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পদদলন চলছিল, ভারতের ওপর ভর করে যেভাবে বাংলাদেশ তার বিশ্ব বা আঞ্চলিক কৌশলগত অবস্থানের দিককে ভারত কবজা করছিল, তার বিরুদ্ধে ছিল অন্যান্য বিশ্বশক্তির উদ্বেগ। বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমেরিকা এশিয়ায় স্যাটেলাইটখ্যাত জাপানের নিরাপত্তা সেখানে ছিল না। যেমন ২০১৬ সালে গুলশান বেকারি হোটেলে বিদেশি যারা আইএস ক্যাডারের হাতে নিহত হয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশ ছিল জাপানি। বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্ররোচনায় সে সময় তা ধামাচাপা দেয়। তবে তার ব্যাকল্যাশও ছিল প্রচণ্ড। জাপানের বিনিয়োগ নিয়েও ফ্যাসিবাদী হাসিনা চক্র আমেরিকার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণের প্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের তা নিয়ে বোধের কমতি রয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে দেবপ্রিয়কে উপদেষ্টামণ্ডলীতে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রফেসর শহীদুজ্জামানকেও নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ড. ইউনূস সম্ভবত এমন কাউকেও নিতে চান না, যাদের উপদেশ তাকে গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু আগামী ২০২৬ সালের মার্চ মাসে আসামে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। এখন আসামে চলছে বাংলাভাষী খেদাও আন্দোলন। ছাত্র-যুবকরা আক্রমণ করছে বাংলাভাষীদের। আসামের বিধানসভায় গত মার্চ মাসে পাস হয়েছে বাংলাভাষীদের নির্বাসনের রোডম্যাপ। তারপর থেকে চলছে শনাক্তকরণ। মুসলিম ও হিন্দু দুটি তালিকা হচ্ছে। প্রস্তুতি চলছে যারা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগেই আসামে গেছে তাদেরও বেআইনি বলে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া। আগামী ২০২৬ সালের মার্চে আসামের নির্বাচনের আগেই তা হবে বলে ধারণা।

তাহলে সেখানে আরেকটি রোহিঙ্গা ক্রাইসিসের মতো ক্রাইসিস হবে। ড. ইউনূসের ইতিহাস জ্ঞানহীন উপদেষ্টারা তা নিয়ে কতটুকু সজাগ।

শেয়ার করুন