যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)-এর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক টড লায়ন্স। গত ২০ জুলাই সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা যে কোনো ব্যক্তিকে অপরাধমূলক রেকর্ড থাকা বা না থাকা নির্বিশেষে আটক করা হবে। পাশাপাশি অবৈধ শ্রমিক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কঠোরভাবে দায়বদ্ধ করা হবে। এ নীতিমালা ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে আরো কঠোর হয়েছে, ফলে আইসের অভিযান এখন আরো ব্যাপক এবং কঠোর মাত্রায় পরিচালিত হচ্ছে। লায়ন্স জানান, আইস তাদের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে প্রথমে যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধমূলক অভিযোগ রয়েছে, সেসব বিপজ্জনক ব্যক্তিদের টার্গেট করা হবে। তবে তার সঙ্গে স্পষ্ট করে তিনি বলেন, যেসব অবৈধ অভিবাসীর বিরুদ্ধে অপরাধের রেকর্ড নেই, তারাও যদি কোনো অভিযানের সময় ধরা পড়ে, তাহলে তাদেরও গ্রেফতার করা হবে।
তিনি আরো অভিযোগ করেন, যেসব স্টেট ও শহর সাংচুয়ারি নীতিমালার আওতায় আইসের সঙ্গে স্থানীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা সীমিত করে দিয়েছে, তা কার্যত আইসকে অভিবাসীদের খোঁজে সরাসরি কমিউনিটিতে যেতে বাধ্য করছে। ফলে বেড়েছে কোলাট্যারাল অ্যারেস্ট, অর্থাৎ যাদের বিরুদ্ধে সরাসরি টার্গেট করা হয়নি, কিন্তু অভিযানকালীন ধরা পড়েছে, এমন ব্যক্তিদের গ্রেফতার। লায়ন্স আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন এমন কাউকে পেলেই আমরা গ্রেফতার করবো। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে বাইডেন সরকারের সময় জারি থাকা নীতিমালা বাতিল করে আইসিইকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাইডেন আমলে শুধু অপরাধী, জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি ও সাম্প্রতিক অনুপ্রবেশকারীদেরই টার্গেট করার নির্দেশনা ছিল। ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এ নীতি বাতিল করে সব অবৈধ অভিবাসীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে।
হোয়াইট হাউসের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ স্টিফেন মিলারের নেতৃত্বে এখন আইসের প্রতি প্রতিদিন ৩ হাজার গ্রেফতারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও সেই সংখ্যা এখনো অর্জন হয়নি, তবে কংগ্রেস থেকে আইসের জন্য নতুন করে বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে করে প্রশাসনের এক বছরের মধ্যে ১০ লাখ অভিবাসী বহিষ্কারের লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেছে।
কোম্পানিগুলোকেও জবাবদিহির আওতায় আনার ঘোষণা
আইস প্রধান টড লায়ন্স জানান, ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে আগের মতোই কাজের স্থানে অভিযান চলবে। বিগত সপ্তাহগুলোতে নেব্রাস্কার একটি মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, লুইজিয়ানার একটি রেস ট্র্যাক এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন ক্যানাবিস খামারে শত শত অবৈধ অভিবাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু ক্যানাবিস ফার্ম থেকেই ৩০০ জনের বেশি অভিবাসী, যার মধ্যে ১০ জন নাবালক, আটক করা হয়েছে। যদিও কিছু শিল্পক্ষেত্র ট্রাম্পের এ পদক্ষেপে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং ব্যবসার ক্ষতির আশঙ্কা করেছে, জুন মাসে আইসিই সাময়িকভাবে খামার, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় অভিযান বন্ধ রাখলেও সেটি ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কৃষকদের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত দিলেও কীভাবে তা কার্যকর হবে সে বিষয়ে এখনো বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
লায়ন্স বলেন, শুধু অবৈধভাবে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিদের নয়, আমরা সেসব আমেরিকান কোম্পানির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছি, যারা এ শ্রমিকদের শোষণ করছে। তার ভাষায়, এটি কোনো ভিকটিমহীন অপরাধ নয়। বরং এসব তদন্তে জোরপূর্বক শ্রম, এমনকি শিশুশ্রম বা মানব পাচারের মতো অপরাধও প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করে বলেন, আমরা শুধু অবৈধ শ্রমিকদের নয়, তাদের নিয়োগ দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকেও জবাবদিহির আওতায় আনবো।
এ অবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতিমালা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অভিবাসী সম্প্রদায়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এমন পদক্ষেপ অভিবাসীদের মানবিক অধিকার হরণের শামিল এবং শ্রমশক্তি ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ট্রাম্পের জনসমর্থন হ্রাস
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিকে ঘিরে আমেরিকানদের মধ্যে ট্রাম্পকে ঘিরে জনমতের দ্রুত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এ জনসমর্থন হ্রাস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক অবস্থান ও জনপ্রিয়তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, অভিবাসন ও বহিষ্কারের মতো কঠোর নীতির কারণে মার্কিন জনগণের এক বড় অংশ ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছে। নির্বাচনী বছর সামনে রেখে এই পরিবর্তন ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন প্রচারণার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সম্প্রতি সিবিএস নিউজ ও ইউগভ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ২০ জুলাই প্রকাশিত ফলাফলে ট্রাম্পের সামগ্রিক অনুমোদনের হার নেমে এসেছে ৪২ শতাংশে, যেখানে ৫৮ শতাংশ মার্কিন নাগরিক তার বিরোধিতা করেছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মতে, অভিবাসন ও বহিষ্কারের নীতিই ট্রাম্প সম্পর্কে তাদের মত গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। ৬১ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, অভিবাসন ইস্যুটি তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনীতির চেয়েও বেশি।
জরিপে আরো দেখা গেছে, ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির প্রতি অনুমোদনের হার এখন ৪৪ শতাংশ, যা গত ফেব্রুয়ারির তুলনায় ১০ পয়েন্ট কম। ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৫৪ শতাংশ। বিশেষ করে প্রশাসনের ব্যাপক বহিষ্কার অভিযানের প্রতি জনসমর্থনও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। জুলাই মাসে মাত্র ৪৯ শতাংশ উত্তরদাতা এসব অভিযানকে সমর্থন করেছেন, যেখানে ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৫৯ শতাংশ। গত কয়েক মাসে এই বহিষ্কার কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থন ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে এবং বর্তমানে এটি সামান্য নেতিবাচক ধারায় প্রবেশ করেছে। এ সমর্থন মূলত রিপাবলিকান ও ট্রাম্পপন্থী ভোটারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
জরিপে দলীয় বিভাজনও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। ৯১ শতাংশ রিপাবলিকান ট্রাম্পের বহিষ্কার নীতিকে সমর্থন করলেও মাত্র ১৪ শতাংশ ডেমোক্র্যাট এ নীতির পক্ষে মত দিয়েছেন। স্বাধীন বা নিরপেক্ষ ভোটারদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ বহিষ্কারের বিরোধিতা করেছেন এবং ৪১ শতাংশ পক্ষে রয়েছেন। অভিবাসীদের আটক কেন্দ্রে রাখার নীতিতেও উল্লেখযোগ্য বিরোধিতা দেখা গেছে। ৫৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী এ ব্যবস্থার বিপক্ষে মত দিয়েছেন, যেখানে ৪২ শতাংশ সমর্থন জানিয়েছেন। রিপাবলিকানদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ এ নীতির পক্ষে মত দিলেও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ এতে সম্মতি জানিয়েছেন।
এ জরিপটি ১৬ থেকে ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ২ হাজার ৩৪৩ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ওপর পরিচালিত হয়। জরিপের সম্ভাব্য ত্রুটির সীমা ২ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, এ জরিপ ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতির জনপ্রিয়তায় ধসের একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরছে, যা তার পুনর্নির্বাচনের প্রচারে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।