৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৪১:৬ অপরাহ্ন


সুষ্ঠু নির্বাচনের আস্থা তৈরি হওয়ায় সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাড়াকাড়ি
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৭-২০২৫
সুষ্ঠু নির্বাচনের আস্থা তৈরি হওয়ায় সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাড়াকাড়ি আন্দোলনে সংখ্যালঘুরা


যেনো তেনোভাবে নির্বাচন সামনের দিনগুলিতে হচ্ছে না। কিংবা আমার ভোট আমি দিবো, তোরটা-ও দিয়ে দিবো-এমন পরিস্থিতি আবার ফিরে আসার আশা ধীরে ধীরে ফিঁকে হয়ে যাচ্ছে। আবার দিনের ভোট রাতে করে বিজয় বাগিয়ে নেওয়ার চিন্তাও এখন করতে সাহস পাচ্ছে না। সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে আস্থা তৈরি হওয়ায় দেশের এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। এধরনের পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুদের একটি অতিউৎসাহী অংশ যারা বিভিন্ন সময়ে কোনো না কোনো দলের লেজুরবৃত্তি করতে হতো তাদের তৎপরতা কমে আসছে। অন্যদিকে কোনো একটি দল ভুলিয়ে ভালিয়ে অতীত কর্মকান্ডের কারণে ক্ষমা চেয়ে সংখ্যালঘুদের দিয়ে তাদের ভোটবাক্স তাজা করারও দিন ঘনিয়ে এসেছে। এসবকারণেই দেশে এখন সবদলের টার্গেট হচ্ছে সংখ্যালঘুদের মন শান্তি করা। তাদের নানান ধরনের আশ্বাস দিয়ে চাওয়া হচ্ছে ভোট। ভোট শুরু না হতেই তাদের ভোট ব্যাংক নিয়ে রীতিমত কাড়াকাড়ি শুরু করে দিয়েছে সবদলই। সম্প্রতিক রাজনৈতিক মাঠ ঘুরে দলগুলির বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ কর্মসূচিতে এগুলি ফুটে উঠছে। 

নির্বাচন নিয়ে গ্যারান্টি

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশ বিদেশে দফায় দফায় আশ্বস্ত করে যাচ্ছেন এই বলে যে, ১৭ বছর পর ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন বাংলাদেশে হবে। সর্বশেষ ১১ জুন লন্ডনে চ্যাথাম হাউজে ‘এক নীতি সংলাপে’ মূল বক্তা হিসেবে অংশ নিয়ে এ মন্তব্য করেন প্রধান ‍উপদেষ্টা। এর কয়েকমাস আগে নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকন অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসন সাক্ষাৎ করতে এলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নির্বাচন। সরকার আগামী সাধারণ নির্বাচনকে ঐতিহাসিক এবং দৃষ্টান্তমূলক করতে চায়।

বদলে যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি আচার আচরণ

যখনই হোক না কেনো আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তা হতেই হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। জোর করে কিংবা ব্যালট বাক্স আগে ভাগে ভরিয়ে দিয়ে ভোট করা সম্ভব হবে না-এটা এখন বাংলাদেশের সব দলই টের পেয়ে গেছে। বিশেষ করে বিএনপি’র পাশাপাশি এখন দেশে সব ইসলামী দল সংখ্যালঘুদের ভোটবাক্সই নয় তাদের যাবতীয় দেখভালের দায়িত্বও কাধে নিয়ে যাওয়ার প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করতে কেউ কেউ প্রতিবেশী দেশের আস্থাভাজনদেরও কাজে লাগাচ্ছেন। চলছে বক্তব্যের ফুলঝুড়ি..। এমনই চালচিত্র দেখা গেছে সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মহাসমাবেশে। এই মহাসমাবেশে যোগ দিয়ে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদের নেতারাও বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে উপস্থিত নেতাদের বক্তব্যে লক্ষ্য করা গেছে তারা এ সমাবেশটি কেবল বিএনপিকে তাদের শক্তি সামর্থ জানান দিতে আয়োজন করেনি। তাদের মূল টার্গেটই ছিল সংখ্যালঘুদের ভোট ব্যাংকে হানা দেয়া। এতে তারা একদিকে একটি প্রতিবেশী দেশকে যেমন আস্থায় নিতে চায়, তেমনি এদেশের সংখ্যালঘু বিশেষ করে সব আমলইে নির্যাতিত ও বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হিন্দু সম্প্রদায়কে টার্গেট করেছে। কেননা ইসলামী দলের ওই সমাবেশে দেখা গেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের। দেখা গেলো বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্রে সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া ও বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিকে। 

বসে নেই বিএনপি

রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকটা আকস্মিকভাবেও ঘটে গেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ওই মহাসমাবেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের উপস্থিতি। এতে জ্বালাময়ী ও ভবিষ্যতে বিশেষ করে তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি ভেতরে ভেতরে বেশ বিচলিত হয়ে যায়। একটি সূত্র জানায়, ইসলামী আন্দোলনের ব্যানারে ডাকা মহাসমাবেশ মঞ্চে এভাবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় উঠে পড়বে তা বিএনপি’র কোনো পর্যায়ের নেতাদের মাথায়-ই ঢুকেনি। যদিও সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের মনে একটু স্থান করে নিতে বিএনপি অনেক আগ থেকেই বেশ তৎপর ছিল। কেননা সংখ্যালঘুরা অতীতে বিএনপির বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক আচরণে ও সাম্প্রদাযিক শক্তি সাথে গাটছাড়া বাধার কারণে দুর্নাম কুড়িয়েছে। সংখ্যালঘুদের একটি বড়ো অংশই বিএনপি’র ধরে নিয়েছে যে, দলটি বাংলাদেশে একটি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও এর পাশাপাশি দলটি হিন্দু বিদ্বেষী দল। দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রচার আছে বিএনপি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দল ও এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ নেতা বা কর্মী নেই। কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও এদেরকে দলের নেতৃত্ব পর্যায়ে রাখাই হয় না। এমন দুর্নাম নিয়ে বিএনপি’কে দীর্ঘ ১৭ বছর একটি সাম্প্রদায়িক ও বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দল হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। 

হঠাৎ ইসকনের আলোচনা সভা

আর একারণে বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ওই মহাসমাবেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের উপস্থিতি বিএনপি’কে বেশ নাড়া দিয়েছে। দেখা গেছে, দলটি গত ৪ জুলাই শুক্রবার ইসকনের আলোচনা সভার আয়োজন করে। এমনকি অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও অসুস্থতার কারণে তিনি যেতে পারেননি। কিন্তু সেখানে তিনি এক বার্তায় ভবিষ্যতে ইসকন মন্দিরে আসার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। তবে একটি সূত্র জানায় ওইদিনের অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উপস্থিতি ইসকন নেতারা মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন। এদিকে ওই আলোচনা সভায় বিএনপি’র নেতারা আগামীতে ক্ষমতায় গেলে সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে কি কি করবেন তার একটা ফর্দও তুলে ধরেন। এতে বিএনপির ওপর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আস্থা রাখার আহ্বান নেতাদের। এদিকে ওই আলোচনা সভায় বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব ও সাবেক সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তারের বক্তব্য ছিল বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে এই নেতা বলেছেন, ‘বিএনপির প্রতি আস্থা রাখবেন। কোনো অপপ্রচারে বিভ্রান্তি হবেন না। কথা দিচ্ছি, বিএনপি আগামীতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর আমরা কাটার আঁচড়ও লাগতে দেব না। আর একটু আগ বাড়িয়ে এবিএম আব্দুস সাত্তার বলেন, শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে গত সাড়ে ১৫ বছরে সারা দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত প্রতিটি সহিংস ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হবে বলে জানান। এখানে বিএনপির কোনো লোক যদি জড়িত থাকে, তাদেরও বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না বলেও গ্যারান্টি দেন। 

শেষ কথা ও আন্তর্জাতিক চাপ

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমাগত হামলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে- এমন অভিযোগের দায়ভার অতীতেও ছিল। কিন্তু শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমলেও এমনটা হবে তা আন্তর্জাতিকমহল আশা করতে পারেনি। এজন্য তারা সোচ্চারও হয়েছে। সম্প্রতি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমাগত হামলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সংস্থা কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের ২০২৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে জুলাই গণ অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং তাদের মন্দিরের ওপর হামলা বেড়েছে বলে তাদের সংগঠনগুলো দাবি করেছে। মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তাদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন যা গণমাধ্যমে দেখা যায়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে-ও বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, এর পক্ষে শক্ত কোনও প্রমাণ নেই। বলা হয় ইউএসসিআইআরএফ-এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিস্থিতি নিয়ে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, তা একেবারেই সত্য নয়। বিশ্লেষকদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার দায়ভার যা-র ওপরই বর্তাক না কেনো এঅবস্থার উন্নয়ন ছাড়া আগামীতে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে একটি সুশাসনের দেশ হিসাবে এগুতে পারবে না। পড়বে পদে পদে ঝামেলায়। অন্যদিকে দেশের ভেতরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলি তাদের প্রতি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জনে ব্যাপক দৃশ্যমান কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। বিশেষ করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও করতে হবে। সেক্ষেত্রে দেশে প্রতিটি জনগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ভোটের মূল্য, তাদের উপস্থিতি সহযোগিতা আগামীতে বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট ফ্যাক্টর। এসব বুঝেই সব দলই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছে। আর এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি’ও চুপচাপ বসে নেই, শুরু করেছে দৌড়ঝাপ। কারো কারো মতে, আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা থাকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কদর বেড়ে গেছে।

শেয়ার করুন