প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন সংবিধানস্বীকৃত একটি মৌলিক অধিকার হ্যাবিয়াস করপাস স্থগিত করার বিষয়ে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছেন হোয়াইট হাউসের উপপ্রধান নীতিনির্ধারক স্টিফেন মিলার। এই পদক্ষেপটি কার্যকর হলে, মার্কিন অভিবাসন নীতিতে এক বড় ধরনের রূপান্তর ঘটবে এবং এতে আটক অভিবাসীদের জন্য নিজেদের আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করার সাংবিধানিক অধিকার সীমিত হয়ে যাবে।
‘হ্যাবিয়াস করপাস’ হল একটি মৌলিক আইনগত অধিকার যার শিকড় ইংরেজি সাধারণ আইনে। এটি লাতিন ভাষার একটি শব্দগুচ্ছ যার অর্থ ‘তোমার দেহ হাজির করো’। এই অধিকার অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি রাষ্ট্র কর্তৃক আটক হলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে আদালতে আপত্তি জানাতে পারেন এবং সরকারকে তার আটকাদেশের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১, ধারা ৯-এ বলা হয়েছে, হ্যাবিয়াস করপাসের অধিকার স্থগিত করা যাবে না, তবে যখন বিদ্রোহ বা আক্রমণের ক্ষেত্রে জননিরাপত্তা প্রয়োজন হবে তখনই এটি স্থগিত করা যেতে পারে। এই বিধান কেবল ‘বিদ্রোহ’ বা ‘আগ্রাসন’-এর সময়ই এই অধিকার স্থগিত করার সুযোগ প্রেসিডেন্টকে দেয়।
হোয়াইট হাউসের বাইরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্টিফেন মিলার বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটি একটি সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে দেখছেন। সংবিধান অনুযায়ী, ‘বিদ্রোহ বা আগ্রাসন’-এর সময় হ্যাবিয়াস করপাস স্থগিত করা যেতে পারে। আমরা এই বিকল্পটি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছি। মিলারের মতে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে একটি অবৈধ অভিবাসীদের আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়েছে, যা একটি জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি এবং সেই যুক্তিতেই এই সংবিধানিক ধারা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মাত্র চারবার হ্যাবিয়াস করপাস স্থগিত হয়েছে। প্রথমবার গৃহযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন নিজ ক্ষমতাবলে এটি স্থগিত করেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস তার সেই পদক্ষেপ অনুমোদন করে। দ্বিতীয়বার ১৮৭১ সালে দক্ষিণ ক্যারোলিনায় কু ক্লুক্স ক্ল্যানের সহিংসতা দমনে এটি আংশিকভাবে স্থগিত করা হয়। তৃতীয়বার ১৯০৫ সালে ফিলিপাইনে বিদ্রোহ চলাকালে এবং চতুর্থবার ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে জাপানের হামলার পর হাওয়াইয়ে এই অধিকার স্থগিত করা হয়।
আইনবিশেষজ্ঞ ও সংবিধান বিশ্লেষকরা একমত যে প্রেসিডেন্টের একক ক্ষমতায় হ্যাবিয়াস করপাস স্থগিত করা সংবিধানবিরোধী। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির আইন প্রফেসর স্টিভ ভ্লাডেক বলেন, প্রেসিডেন্ট এককভাবে ভাবে এই অধিকার স্থগিত করতে পারেন না। এটি একমাত্র কংগ্রেসের ক্ষমতার মধ্যে পড়ে। তার মতে, স্টিফেন মিলার এড়িয়ে গেছেন যে, প্রায় সর্বসম্মত আইনি মত হলো, কেবল কংগ্রেসই এই অধিকার স্থগিত করতে পারে, প্রেসিডেন্ট নয়।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেট এবং আইনজীবী নিল কাটিয়ালের যৌথ প্রবন্ধে বলা হয়েছে, সংবিধান স্পষ্টভাবে না বললেও ঐতিহাসিক নজির ও আইনি ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এটি পরিষ্কার যে, কেবল কংগ্রেসই এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। লিংকনের সময়ও প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপ ছিল বিতর্কিত এবং পরে কংগ্রেস তা বৈধতা দেয়। পরবর্তী তিনবার প্রতিবারই কংগ্রেসীয় অনুমোদনের ভিত্তিতে এই অধিকার স্থগিত করা হয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই মন্তব্যের পটভূমিতে ছিল একটি সাম্প্রতিক আদালতের রায়, যেখানে তুরস্কের নাগরিক ও তাফটস ইউনিভার্সিটির পিএইচডি শিক্ষার্থী রুমেইসা ওজতুর্ক-এর আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করে আদালত তার মুক্তির নির্দেশ দেয়। ওজতুর্ক যুক্তরাষ্ট্রে তার ছাত্রভিসা থাকা অবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে যে, তিনি একটি সন্ত্রাসী সংগঠনকে সমর্থন করেছেন এবং ইহুদি ছাত্রদের জন্য শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করছেন। যদিও তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অভিযোগ আনা হয়নি, তবুও তিনি ৪৫ দিন ধরে আটক ছিলেন। তিনি হ্যাবিয়াস করপাসের আবেদন করে আদালতে বলেন, তার গ্রেফতার মতপ্রকাশের অধিকার হরণের একটি অংশ এবং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এই রায়ের পরে, ট্রাম্প প্রশাসনের একাংশ আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। স্টিফেন মিলার সাংবাদিকদের বলেন, এটি আদালত নির্ভর করছে ঠিক কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর। আদালত যদি ‘সঠিক কাজ’ না করে, তবে প্রেসিডেন্ট নিজেই ব্যবস্থা নিতে পারেন। তিনি আরো বলেন, এই বিচারকরা শুধু নির্বাহী শাখার বিরুদ্ধেই নয়, কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিচ্ছেন।
প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী, অভিবাসন ও জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে আদালতের হস্তক্ষেপ তাদের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করছে। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রে আদালতের রায়ে স্থগিত হয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে যখন তারা হ্যাবিয়াস করপাস ব্যবহার করে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের হ্যাবিয়াস করপাস স্থগিত করার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানিক ও আইনি কাঠামোর জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। হ্যাবিয়াস করপাস, যেটি একটি মৌলিক আইনি অধিকার হিসেবে পরিচিত, এর মাধ্যমে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় শক্তির মধ্যে একটি সঠিক ভারসাম্য বজায় থাকে। এটি শুধু অভিবাসীদের জন্য নয়, বরং পুরো দেশের নাগরিকদের জন্যও একটি মৌলিক সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে।
এমনকি প্রশাসনের এই পদক্ষেপ যদি কার্যকর হয়, তবে তা একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক নজির স্থাপন করবে, যা ভবিষ্যতে অন্যান্য সরকারি পদক্ষেপের জন্যও পথ সুগম করতে পারে। এটি কেবল আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের প্রতি আঘাত হিসেবেও দেখা হতে পারে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো, যেমন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। কারণ তারা মনে করে, এটি একটি কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের প্রতিফলন এবং মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা ও অধিকারকে সংকুচিত করবে।
অতএব হ্যাবিয়াস করপাসের মতো মৌলিক অধিকারগুলোকে সুরক্ষিত রাখা একদিকে যেমন ব্যক্তির স্বাধীনতার জন্য অপরিহার্য, তেমনি এটি যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তি এবং আইনের শাসনের প্রতীকও। এই অধিকার হরণ করা হলে তা সমাজে গভীর ক্ষতির সৃষ্টি করতে পারে এবং সরকারের অতিরিক্ত ক্ষমতা জনগণের অধিকারকে চেপে ধরতে ব্যবহার করা হতে পারে। সুতরাং সংবিধান এবং নাগরিক অধিকার রক্ষায় এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনি ও সামাজিক প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।