এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জ্বালানি-বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মহলের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে মহাসংকট। যা সংঘটিত হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কতিপয় লুটেরা কর্তৃক। শিল্প উৎপাদন অর্থনীতি ক্রমাগত হয়ে পড়ছে পঙ্গু। বাংলাদেশ গ্যাস ফ্রাঞ্চাইজ জুড়ে তীব্র গ্যাস সংকট। গ্যাসের অভাবে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫০ শতাংশ অলস থেকে যাচ্ছে, রফতানিমুখী শিল্পকারখানাসহ সব শিল্প-কলকারখানার উৎপাদন নিদারুণ সংকটে, ক্ষুদ্র, মাঝারি অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলো চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট দৈনিক চাহিদার বিপরীতে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে পেট্রোবাংলার গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা। সার কারখানাগুলোর অধিকাংশ বছরের অধিকাংশ সময় উৎপাদন স্থগিত রাখছে। অধিকাংশ গৃহস্থালি ব্যবহারকারীরা ভুগছে গ্যাসের অভাবে। ঠিক এমনি সময়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় পেট্রোবাংলার মাধ্যমে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে নতুন শিল্প কলকারখানা এবং শিল্পকারখানায় স্থাপিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণ করার প্রস্তাব পাঠিয়ে জাতির সঙ্গে কৌতুক করেছে। কাল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে অনুষ্ঠিত গণশুনানির বিস্তারিত বিবরণ নানা মাধ্যমে জানার সুযোগ হয়েছে। আমি ক্যাবের পরামর্শক বন্ধুবর ড. শামসুল আলম, রুহিন হোসেন প্রিন্স এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। অস্ট্রেলিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক কাজ থাকায় উপস্থিত থেকে গণশুনানিতে অংশগ্রহণের সুযোগ না হলেও লিখিতভাবে আমার মতামত কমিশনে প্রেরণ করেছিলাম। জানি না সেটি কমিশন পড়েছে কি না।
২০০০-২০২৪ পর্যন্ত সব সরকারের দূরভিসন্ধিমূলক ভ্রান্তনীতি পরিকল্পনার কারণে বর্তমান জ্বালানি সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। নিরঙ্কুুশ আমলা নিয়ন্ত্রিত জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে হয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি। স্বেচ্ছাচারে বিপর্যস্ত জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাত নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ উন্নয়ন উপেক্ষা করে দুর্নীতিপরায়ণ সিন্ডিকেটের স্বার্থরক্ষার জন্য আমদানিকৃত জ্বালানির (কয়লা, এলএনজি, তরল জ্বালানি) দিকে ঝুঁকছে। করোনা, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা ভূরাজনৈতিক সংকটের কারণে বিশ্বজ্বালানি বাজার বিক্ষুব্ধ থাকায় বাংলাদেশের জন্য আমদানিকৃত জ্বালানি নির্ভরতা আত্মঘাতী হয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য ২০০৯-২০২৪ ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা, জ্বালানি মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, মুখ্য সচিববৃন্দ, জ্বালানি বিদ্যুৎ সচিববৃন্দ, পেট্রোবাংলা, বিপিডিবি এবং বিপিসির চেয়ারম্যানদের একান্তভাবে দায়ী। এ সময়ে জ্বালানি-বিদ্যুৎ সেক্টরে মেগাপ্রকল্পগুলোর নামে নির্বিচারে লুটপাট হয়েছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি সেক্টর থেকে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। অথচ সেসব দুর্নীতি এবং অনাচারের বাস্তবভিত্তিক তদন্ত না করে কেন অন্তর্বর্তী সরকার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির অপকৌশল নিয়েছে। আমি বাংলাদেশ জ্বালানি সেক্টরের ১৯৭৭-২০০৫ মাঠকর্মী হিসেবে লজ্জিত, ক্ষুব্ধ এবং মর্মাহত। আমি গ্যাস-বিদ্যুৎ সেক্টরের দুর্নীতিসমূহের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত এবং বিচার দাবি হওয়া প্রয়োজন।
১. কেন, কীভাবে জিটিসিএলের মুচাই কম্প্রেশার প্রকল্প উপস্ট্রিম গ্যাসফিল্ড অপারেটর শেভরনকে দেওয়া হয়েছিল? কেন এডিবির আর্থিক সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন থাকা জিটিসিএল কম্প্রেশার স্টেশন প্রকল্প চালু থাকা অবস্থায় কস্ট রিকভারির আওতায় একটি কম্প্রেশার স্টেশন স্থাপন অপেক্ষাকৃত অনেক উঁচু মূল্যে আইওসিকে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আশুগঞ্জ, এলেঙ্গায় দুটি কম্প্রেশার স্টেশন এবং বিবিয়ানা-ধনুয়া পাইপলাইন নির্মাণ করে অর্থ গচ্চা দেওয়া হয়েছে? এলেঙ্গা কম্প্রেশার স্টেশন আদৌ চালু করা হয়নি। আশুগঞ্জ কম্প্রেশার স্টেশন বন্ধ আছে।
২. কেন গ্যাস অনুসদ্ধানের জন্য নির্ধারিত গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যবহার না করে এলএনজি আমদানিতে খরচ করা হয়েছে। বাপেক্সকে অনুদান না দিয়ে সুদে অর্থছাড় করে আর্থিক সংকটে ফেলা হয়েছে। বাপেক্সকে দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে গ্যাসকূপ খনন করা সম্ভব হলেও দ্বিগুণ মূল্যে বিদেশি কোম্পানি দিয়ে উন্নয়ন কূপ খনন করা হয়েছে।
৩. কাদের স্বার্থরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস উৎপাদনের ব্যবস্থা না করেই আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ সমান্তরাল গ্যাস পাইপলাইন, বগুড়া থেকে দিনাজপুর রংপুর পাইপলাইন নির্মাণ করে জিটিসিএলকে পঙ্গু বানানো হয়েছে?
৪. কোন অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে ২০১০ থেকে ২০২৪ পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এবং কয়েকজন পরিচালক মন্ত্রণালয় থেকে পদায়ন করা হয়েছে? পেট্রোবাংলার কোম্পানিগুলোতে কি কারণে শুধু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পরিচালকমণ্ডলীতে রাখা হয়েছে? পেট্রোবাংলার একজন বিতর্কিত পরিচালককে নিয়ে মিডিয়ায় নানা ধরনের প্রতিবেদন ছাপা হলেও দুর্নীতি দমন কমিশন অর্থের বিনিময়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। কীভাবে একজন বিতর্কিত দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ দীর্ঘদিন পেট্রোবাংলার মতো সংস্থায় দাপটের সঙ্গে কাজ করেছে সেটি বোধগম্য নয়।
৫. অভিযোগ আছে জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলার প্রচ্ছন্ন? প্রশ্রয়ে গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থায় গ্যাস চুরি সরবরাহ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে ফেলেছে। বিপুল পরিমাণ গ্যাস সিস্টেম লসের মাধ্যমে চুরি হচ্ছে। অনিরাপদ বিতরণ লাইনে বেশ কয়েকবার মারাত্মক দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হলেও কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।
৬. আসুন বিদ্যুতের ক্ষেত্রে দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ আইন ২০১০-এর যথেচ্ছ অপব্যবহার করে একশ্রেণির সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী মহলকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ আয়ের সুযোগ দিয়ে আখের গুছিয়েছে সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, চেয়ারম্যানরা। সেই তুলনায় সঞ্চালন ব্যবস্থা এবং জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার সংস্থান না করে আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েছে বিপিডিবি, পেট্রোবাংলা। কেন দেশে আবিষ্কৃত বিপুল পরিমাণ কয়লাসম্পদ মাটির নিচে পড়ে রয়েছে? কেন জলে-স্থলে গ্যাস অনুসন্ধান স্থবির হয়ে আছে? কাদের স্বার্থে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে?
৭. কাদের স্বার্থে কেন ভারতের এনার্জি মাফিয়া আদানি গ্রুপের সঙ্গে একতরফা বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয়েছে? কি জবাব আছে সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে?
সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর শ্বেতপত্র কমিটি করেছিল। সেখানে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের দুর্নীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত দিয়ে অভিযোগ আনা হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশন ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থান নিয়ে আছে।
অচিরেই হয়তো অন্তর্বের্তী সরকার নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। আশা করবো, সরকার জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতের মহাদুর্নীতির কয়েকজন হোতাকে অন্তত আইনের আওতায় আনবেন। একই সঙ্গে বলছি, জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় সাশ্রয় করে দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা হলে এই মুহূর্তে মূল্যবৃদ্ধির কোনো প্রয়োজন হবে না। তবে দ্রুত নিজেদের জ্বালানি আহরণ এবং উত্তোলনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।