৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৩:৩৯:৫২ অপরাহ্ন


দেশে বিদেশে ঝুঁকির মুখে আ’লীগ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০২-২০২৫
দেশে বিদেশে ঝুঁকির মুখে আ’লীগ আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা


বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দল বলে পরিচিত আওয়ামী লীগে মূল নেতৃত্বে প্রকাশ্যে এমনকি নেপথ্যে-ও দলটির সভাপতি পদে শেখ হাসিনার থাকা না থাকা নিয়ে দলের ভেতরে বাইরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন প্রতিবেদন প্রকাশের পর দলটির ভেতরে বাইরে এনিয়ে এখন জমজমাট আলোচনা। গণ-আন্দোলনের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া এই নেত্রীর পক্ষে আগামী দিনগুলিতে ভারতে বসে দল পরিচালনা থেকে নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের কর্মসূচি বা কোনো ধরনের বিবৃতি-ও দেয়া আদৌ সম্ভব হবে কি-না তা চলে আসছে ব্যাপক আলোচনায়। এর পাশাপাশি দেশে বিদেশে হাসিনার পক্ষে কাজ করা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে নানান ধরনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

কি আছে মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনে রিপোর্টে

জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন নিয়ে সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের ঘটনা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর)। ১১৪ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় জেনেভায়। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনার ভলকার টুর্ক নিজে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এধরনের প্রতিবেদন ঢাকায় প্রকাশ করা হয়নি বা সরকারের কাছে আগে হস্তান্তর করা হয়নি। কেননা তাদেরও ধারণা হয়েছে যে, ঢাকা থেকে অন্তর্বর্তী সরকার এটি প্রকাশ করলে এ-র গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হতো। এসব বিবেচনায় রেখে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনার ভলকার টুর্ক নিজে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। আর এই রিপোর্টের চুম্বক অংশ হলো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকার ও সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল। বলা হয়েছে ওই স্বৈরাচারী সরকার নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে যুক্ত করে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচার মারণাস্ত্র দিয়ে গুলি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, চিকিৎসা পেতে বাধা দেওয়ার মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে সরকার। বলা হয় যে, মূলত ক্ষমতায় টিকে থাকতে আন্দোলনকারীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। জাতিসংঘের হিসাবে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ১১৮ জনই শিশু। শেখ হাসিনার নির্দেশেই নির্বিচারে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি গুলি করে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেছে।

আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারা কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করার পরামর্শ দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ভারতে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের কথা বলেছে। এমনকি দরকার হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে সহায়তার কথাও বলা হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে। আর এখানেই খোঁজা হচ্ছে নানান ধরনের প্রশ্ন। কেননা বলা হচ্ছে জাতিসংঘের এমন প্রতিবেদনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ হত্যাযজ্ঞ পরিচালনাকারী দল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। এতে করে সারা দুনিয়ায় আওয়ামী লীগ’কে পাকা খুনীদের দল বলে চিহ্নিত করা হবে। আর এমন একটি দলের পক্ষে এবং এর সভাপতি শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য নেতাদের পক্ষে দাঁড়ানো বা প্রচার চালানো পক্ষান্তরে গণহত্যা পরিচালনাকারীদের পক্ষে উকালতি করার সামিল বলে গণ্য হবে। দেশে তো দূরে থাক বিদেশের মাটিতেও আওয়ামী লীগ ও দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতাদের পক্ষে দলটির সাধারণ কর্মী বা শুভানুদায়ীদের পক্ষে আন্দোলন সংগ্রাম করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। গণহত্যাকারী কোনো দলের পক্ষে সহজে কেউ কাজ করতে গিয়ে প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও নানান ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ে যেতে পারেন বলে কারো কারো আশঙ্কা। 

ভারতও বেকায়দায় পড়বে

ধারণা করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা সব সময় ভারতের বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা আশা করে বসে আসেন তারা-ও এখন নানান শংকায়। তাদের মতে, শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে ভারতও সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। কেননা ভারত জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীর পক্ষে দাঁড়াবে না। তাছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফিরত দেওয়ার জন্য ভারতকে বিভিন্ন ভাবে যে অনুরোধ জানিয়ে আসছে তা-ও এখন বেশ জোরালো হচ্ছে। আর এমন প্রক্রিয়ায় যদি বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে ফেলে সেক্ষেত্রে ভারত আসলেই কি করবে বা করতে পারবে তা-ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ভাবিয়ে তুলেছে। 

কাদের সিদ্দিকীর না

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম সম্প্রতি একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা, তাঁর অনুগত কিংবা বঙ্গবন্ধু পরিবারের কারোর নেতৃত্বে শত বছরেও আওয়ামী লীগ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না বলে। এর পাশাপাশি ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন-অনেকের ধারণা, শেখ পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এলে ভালো হবে। না, তেমন মনে হয় না। সেটি হবে না। বাংলাদেশে আর কখনও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ওই পরিবারের নেতৃত্ব কাজে আসবে না। কাদের সিদ্দিকী আরো বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের কিছু কিছু লোক ভাবছেন– দুই-এক মাস পরেই দেশে চলে আসবেন শেখ হাসিনা। এটি হতেও পারে। দুনিয়াতে এ রকম অনেক কিছুই হয়। আমার কাছে এটি ষোল আনাই ভোগাস মনে হয়। অন্য কোনো দেশ হাসিনাকে আমার দেশের সরকারপ্রধান বানিয়ে দিতে পারে, এটি এখনও আমি বিশ্বাস করি না। তিনি আরো বলেন, অন্যায় স্বীকার এবং ক্ষমাপ্রার্থনা করে সংশোধিত হলে আবার রাজনীতিতে হয়তো ফিরে আসতেও পারবেন শেখ হাসিনা। সেজন্যে তাঁকে এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের অনেকের মতো জেল-জুলুমও সহ্য করতে হতে পারে। সে সময় দয়াময় আল্লাহ তাঁকে দেবেন কিনা জানি না। 

শেষ কথা 

শেখ হাসিনা ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন এই নেত্রীর বিরুদ্ধে নানান ধরনের অভিযোগের একটি বড়ো হলো যে, তিনি তার আপনজনদের পাশাপাশি সুবিধাভুগীদের নিয়েই সটকে পড়েছেন। কোটি কোটি নেতা কর্মীর প্রতি তার কোনো ধরনের টান অনুভব করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। আর একারণে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কোনো ধরনের নির্দেশনা বা বক্তব্য রাখার যোগ্যতা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা আছে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর পাশাপাশি আইনগতভাবে নেতাকর্মীদেরকে আহবান জানিয়ে তিনি আর বক্তব্য-ও বিবৃতি দিতে পারবেন কি-না সেসব বিষয়গুলোও আলোচনায় চলে এসেছে। 

আলোচনায় এসেছে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি পদ থেকে অপসারণ করে অন্য কাউকে এর দায়িত্ব দেয়া নিয়ে। কারো কারো মতে, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন প্রতিবেদন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দলটির ওপর মরন ছোবল। কারো কারো অভিমত এধরনের বিপোর্ট প্রকাশের পর দলে ঐক্য আদৌ থাকবে কি-না কিংবা দলটির ভেঙ্গে ভেঙ্গে খান হয়ে যাবে কি-না সে প্রশ্নই দ্রুত সামনে চলে আসছে। তাদের মতে, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন প্রতিবেদন আওয়ামী লীগের মতো দলের মহাবিপর্যয় ডেকে এনেছে যা দেখতে খুব সময় লাগবে মনে করেন না রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল।

শেয়ার করুন