জুলাই আগস্ট ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ সূচিত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের তিন মাস পরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এসেছে বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ। এ সরকারের অংশীজন হিসেবে পরিচিত বিশিষ্ট ব্যক্তির উদ্ধৃত্তি দিয়ে শুরু করি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব এবং ক্রীড়াবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ১৩ নভেম্বর তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লিখেছেন-‘আমরা ৫ আগস্ট সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিতে প্রস্তুত ছিলাম। কেউ যদি রক্তস্নাত এই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করতে চায়, চূড়ান্ত বিপ্লবের ডাক তাদের বিরুদ্ধেই আসবে।’
আসিফ মাহমুদ সরকারের উপদেষ্টা হয়ে এই ধরনের কথা বলা থেকে এটি স্পষ্ট যে, সরকারের গৃহীত কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ইতিমধ্যে সরকারঘনিষ্ঠ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের মধ্যে বিতর্ক এবং বিভেদ সূচিত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণা দিয়েছে, তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সম্পর্ক স্থাপন করবে। ভালো কাজের প্রশংসা করা হবে, মন্দ কাজের সমালোচনায় থাকবে সরব। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সরকারে উপদেষ্টা এবং বিশেষ সহকারী নিয়োগকে সন্দেহের চোখে দেখছেন সমন্বয়করা। নিজেদের কার্যালয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সমন্বয়কদের একটি সভায় উপরিউক্ত ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। আওয়ামী লীগের প্রতি অতীত সহানুভূতির কারণে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নিয়োগে ক্ষোভ ঝাড়েন সমন্বয়করা।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সরকারে থেকে কেন এমন মন্তব্য করলেন তার পটভূমি অনুসন্ধানেও দেখা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সর্বশেষ তিন উপদেষ্টা নিয়োগ প্রসঙ্গ। এছাড়া তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের একটি সুপারিশপত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। যার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন নাহিদ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণ বিষয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি সেøাগান নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এসব ঘটনায় শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ নাহিদ ইসলামের পক্ষ নিয়ে ‘উই আর নাহিদ’ হ্যাশট্যাগ চালু করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার এবং অভ্যুত্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে যারা বিভিন্নভাবে প্রশ্ন তুলে অভ্যুত্থান ব্যর্থ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিপ্লবের ডাক দেওয়ার কথা জানালেন আসিফ মাহমুদ।
সবাই জানে অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ছাত্র-জনতার মহান আত্মত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশকে সংকটের পথ থেকে উদ্ধার করে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনার মহান উদ্দেশো নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় সাময়িকভাবে এসেছে। এখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবদান খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে এটিও মানতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি সত্তা। তাদের প্রতিটি কাজ প্রতিটি পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হবে সেটি ভাবাও সঠিক না। তবে কোনো বিতর্কিত ব্যাক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে দেওয়া হলে প্রতিবাদ আসতেই পারে।
সরকার কার্যক্রম শুরু করার পর থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা মহল নানা সংকট সৃষ্টি করে সরকারকে বিপদে ফেলতে চেষ্টা করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতা সহায়ক শক্তি হিসেবে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করেছে। কিন্তু সংবিধান বাতিল এবং সংবিধান অনুযায়ী, বর্তমানে একমাত্র বৈধ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করার সময় থেকেই সরকারের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
স্মরণে রাখতে হবে, এই সরকার বিপ্লবী সরকার নয়। দেশে সামরিক শাসন বা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। কর্তৃত্ববাদী সরকার আমলে সব ক্ষেত্রে অরাজকতা সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠাগুলোর মৌলিক অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে। একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে সব ক্ষেত্রে দ্রুততম সংস্কার করা সম্ভব নয়। সংবিধান সমুন্নত রেখে অনেক সংস্কার করতে পারবে না এই সরকার। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে উৎবেগ উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। নানা ধরনের মেরুকরণের কথাও শোনা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তন নিয়েও উৎকণ্ঠা আছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে। এমনকি বিতর্কিত ‘মাইনাস টু’ ফরমুলা নিয়েও কথা শোনা যাচ্ছে।
রূঢ় বাস্তবতা হলো নিজেদের পাপে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নৌকাডুবি হলেও তৃণমূলে দলটির সংগঠন এবং দেশ বিদেশে ব্যাপক অনুরাগী সমর্থক আছে। কৌশলগত কারণে ওদের ভোট ব্যাংকের দিকে নজর আছে ক্ষমতা প্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলোর। তাই সংগত কারণে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা যতই দাবি করুক পতিত আওয়ামী লীগকে অচ্ছুৎ রাখতে বাস্তবে সেটি সম্ভব হবে না অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে। তেমনি সরকারের প্রতি কাজ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের মনোপুত হবে সেটিরও নিশ্চয়তা নেই।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশকে বেশকিছু বিষয়ে ভারতের ওপর নির্ভর করতেই হবে। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির কারণে ভারতবিরোধী বা ভারতবিদ্বেষী কোনো সরকার দীর্ঘদিন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। বিষয়টি বিএনপি ও জামায়াত ভালোভাবে উপলব্ধি করে। তাই মুখে যাই বলুক প্রকৃত প্রস্তাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতের সঙ্গে ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখছে। তবে বাংলাদেশকে একান্ত ভারতনির্ভর হতে হবে সেটিও মানবে না সাধারণ মানুষ।
সরকার নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এমতাবস্থায় নতুন কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হোক সেটি কেউ কামনা করে না। বাংলাদেশ ছোট দেশ। সবাই সবাইকে চিনে। কেউ কোনো বিতর্কিত কাজে জড়িয়ে পড়লে সেটি অনির্দিষ্টকাল ঢেকে রাখা যায় না, ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে দ্রুত যে কোনো বিতর্কিত কাজ ছড়িয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের নেতা-নেত্রীদের স্মরণে রাখতে হবে, তাদের কার্যক্রম জনগণ অনুসরণ করছে।
প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে এতোদিন পরও কেন আন্দোলনের সময় আহত বীরদের রাজপথে আন্দোলন করতে হচ্ছে? কেন তাদের কাছে প্রতিশ্রুত আর্থিক সহযোগিতা পৌঁছেনি? কেন তাদের সেবা-শুশ্রূষার সুষ্ঠু ব্যবস্থা উপেক্ষিত আছে? সরকারি হাসপাতালগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রূষার জন্য একটি তহবিল আছে। এখন এমনিতেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা সীমিত থাকায় এই তহবিল অব্যবহৃত থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সমন্বয় করে এ তহবিল জুলাই-আগস্ট আন্দোলন সময়ে আহতদের চিকিৎসায় খরচ করতে পারে। এই ধরনের অতি অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলোর প্রতি নজর না দিয়ে কারণ-অকারণে বিতর্ক সৃষ্টি করা সমীচীন নয়।
দেশপ্রেমিক জনগণ চায় সরকার ঘনিষ্ঠ মহল যেন নিজেদের মধ্যে কারণ-অকারণে বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চাপে না ফেলে। অন্যদিকে সরকারের উচিত কোনো নতুন বিতর্ক সৃষ্টি না করা। সরকারের অংশ হয়ে কোনো উপদেষ্টার নতুন করে বিপ্লবের ডাক দেওয়া উচিত নয়।