৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৫:২১:৪৪ অপরাহ্ন


জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইন বাতিল করা ট্রাম্পের পক্ষে প্রায় অসম্ভব
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-১১-২০২৪
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইন বাতিল করা ট্রাম্পের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ডোনাল্ড ট্রাম্প


অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকান জনগণকে আবেগিকভাবে প্রভাবিত করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের আইন বাতিল করা তার প্রশাসনের জন্য প্রায় অসম্ভব কিন্তু একধরনের আবেগিক ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে আমেরিকানদের বোঝাতে পেরেছেন যে, তিনি প্রথমদিনেই তা বাস্তবায়ন করবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন একজন অভিজ্ঞ রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, ক্যাসিনো ও এন্টারটেইনমেন্ট ব্যবসায় তিনি ছিলেন সফল। তিনি জানেন কীভাবে মানুষের মন জয় করতে হয় এবং আমেরিকানদের ওপর প্রভাব ফেলতে হয়। তার রাজনৈতিক কৌশলেও এ ব্যবসায়িক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। ট্রাম্প তার নীতিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যাতে আমেরিকান জনগণ তার প্রতি বিশ্বাস তৈরি করে। তার রাজনৈতিক অবস্থান আরো শক্তিশালী হয়। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচারাভিযানে ট্রাম্প তার বক্তব্যে আমেরিকান জনগণকে একধরনের আবেগিক চাপের মধ্যে ফেলেছেন। তিনি ইমিগ্রেশন, অর্থনৈতিক সমস্যা, কর্মসংস্থান সংকট এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যাতে মানুষের মনে ভয় এবং উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। এই ভীতি তৈরির মাধ্যমে তিনি জনগণের সমর্থন লাভ করেছেন এবং আমেরিকান নাগরিকদের মনোযোগ তার দিকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াট হাউসে ফিরে আসার প্রথমদিন নির্বাহী আদেশ জারির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের জন্মগ্রহণকারী শিশুদের নাগরিকত্ব প্রদান করার দীর্ঘস্থায়ী সংবিধানিক নীতি বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমেরিকান ইমিগ্রেশন রাইটস সোসাইটির রিপোর্ট অনুসারে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫.১ মিলিয়ন শিশু অবৈধ অভিবাসী পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে। যার মধ্যে ৪.১ মিলিয়ন শিশুর পিতামাতা নাগরিকত্ব লাভ করেছে এবং ১ লাখ শিশুর পিতামাতা গ্রিন কার্ডধারী। বাকি ৯ লাখ শিশুর পিতা-মাতা এখনো অবৈধভাবে বসবাস করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৫০ লাখ ৭৬ হাজার ১০০ জন শিশু রয়েছে, যাদের অবৈধ অভিভাবক আছেন। এর মধ্যে ২১ লাখ ২৭ হাজার ৯০০ জন শিশু রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, ফ্লোরিডা, নিউইয়র্ক এবং জর্জিয়ার মতো রাজ্যে। অন্যদিকে ছোট স্টেটগুলোর মধ্যে হাওয়াই, আলাস্কা এবং ডেলাওয়্যার রাজ্যে এই সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। হাওয়াইতে ৭ হাজার ৬০০, আলাস্কায় ২ হাজার ৩০০ এবং ডেলাওয়ারে ৯ হাজার ৮০০ শিশু রয়েছে, যাদের অবৈধ অভিভাবক রয়েছে। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বলেছিলেন, তিনি প্রথমদিনে ফেডারেল সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেবেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী যে কোনো শিশুর পিতা-মাতা একজন আইনত স্থায়ী বাসিন্দা বা নাগরিক হওয়া উচিত। ডোনাল্ড ট্রাম্প জন্মসূত্রে নাগরিকত্বকে একটি ‘পাগল সিদ্ধান্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া সহজ হবে না। এটি কেবল একটি নতুন সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করলেই হবে না, যার জন্য প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট প্রয়োজন হবে। তার সঙ্গে তিন-চতুর্থাংশ স্টেটের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট যদি ১৪তম সংশোধনীর নাগরিকত্ব অনুচ্ছেদটির আরো কঠোর ব্যাখ্যা গ্রহণ করে, তবে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হতে পারে। তবে, এজন্য সুপ্রিম কোর্টকে সুপ্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য থেকে ব্যাপকভাবে বিচ্যুত হতে হবে, যা নিশ্চিত করে যে, দেশে জন্ম নেওয়া শিশুরা তাদের পিতা-মাতার অভিবাসন অবস্থা নির্বিশেষে বৈধ মার্কিন নাগরিক। কংগ্রেস বা প্রেসিডেন্ট যদি জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে আইন বা নির্বাহী আদেশ প্রবর্তন করতে চায়, তবে তা ১৪তম সংশোধনী বিরোধী হবে। তার সঙ্গে অভিবাসী অধিকার সংগঠনগুলো আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। মামলাগুলো সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত শেষ করতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে শেষ হবে না। 

১৪তম সংশোধনী

যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের প্রবর্তনটি ১৮৬৮ সালে ১৪তম সংশোধনী পাস করার মাধ্যমে হয়। গৃহযুদ্ধের শেষে ১৪তম সংশোধনী (অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে) সব স্টেটে আফ্রিকান আমেরিকানদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু অধিকার নিশ্চিত করে। এটি বিশেষভাবে ১৮৫৭ সালের ড্রেড স্কট সিদ্ধান্ত সংশোধন করে। সংশোধনিতে বলেছিল যে মার্কিন সংবিধান আফ্রিকান বংশোদ্ভূত লোকদের জন্য নাগরিকত্ব প্রদান করে না। ১৪তম সংশোধনীর প্রথম বাক্য, যা নাগরিকত্ব অনুচ্ছেদ নামে পরিচিত, যুক্তরাষ্ট্রের অঞ্চলে জন্ম নেওয়া সকল মানুষের জন্য জাতিগত কিছু সীমিত ব্যতিক্রমসহ জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ছিল।

এই অনুচ্ছেদে লেখা আছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী বা স্বীকৃত সব ব্যক্তি এবং তাদের ওপর যার বিচারিক এখতিয়ার আছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং যে রাজ্যে তারা বাস করে, সেই স্টেটের নাগরিক।

যদিও সমান অধিকারের জন্য লড়াই ১৪তম সংশোধনী পাসের পরও অব্যাহত ছিল, জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের ব্যবহারের মাধ্যমে নাগরিকত্ব অনুচ্ছেদটি নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী সব ব্যক্তি, জাতিগতভাবে যাই হোক, সমান অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করবেন।

১৪তম সংশোধনীতে সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যা 

জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিষয়ে ১৪তম সংশোধনী যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বড় বড় রায়ের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নাগরিকত্ব অনুচ্ছেদের যার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিচারিক এখতিয়ার আছে এই শব্দের মাধ্যমে কিছু অজ্ঞতা তৈরি হয়েছিল। অনুচ্ছেদ অনুসারে কে যুক্তরাষ্ট্রের বিচারিক এখতিয়ারের আওতায় পড়বে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তবে ১৮৯৮ সালের ইউনাইটেড স্টেটস বনাম ওয়ং কিম আর্ক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট একদম পরিষ্কারভাবে পূর্ববর্তী আইনের ভিত্তিতে এটি নিশ্চিত করে যে, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী যে কেউ, তাদের পিতা-মাতার অভিবাসন অবস্থান নির্বিশেষে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে জন্মগ্রহণ করবে।

ওং কিম আর্ক যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন চাইনিজ পিতা-মাতার কাছে। ১৮৯০ সালে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার সময় ওং কিম আর্ককে যুক্তরাষ্ট্র সরকার চাইনিজ এক্সক্লুশন অ্যাক্টের অধীনে তাকে প্রবেশে বাধা দেয়। এই আইন কিছু জাতিগত গোষ্ঠীকে নাগরিকত্বের জন্য স্থায়ীভাবে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। তবে সুপ্রিম কোর্ট ৬-২ রায়ে এটি ঘোষণা করে যে, যেহেতু আর্ক যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তিনি সত্যিকার অর্থে একজন মার্কিন নাগরিক। তাকে চাইনিজ এক্সক্লুশন অ্যাক্ট ১৪তম সংশোধনীর নির্দেশিকা উপেক্ষা করতে পারে না।

এখন পর্যন্ত, সুপ্রিম কোর্ট আবারও নিশ্চিত করেছে যে অবৈধ অভিবাসী এবং তাদের সন্তানরা ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিচারিক এখতিয়ারের’ আওতায় পড়েন। ১৯৮২ সালে প্লাইলার বনাম ডো মামলায়, সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে, ‘ডকুমেন্টেড’ এবং ‘অবৈধ’ অভিবাসীদের মধ্যে বিচারিক এখতিয়ারের বিষয়ে ‘কোনো যুক্তিযুক্ত পার্থক্য’ নেই, কারণ উভয়ই সামাজিক এবং আইনগত দায়িত্বের পরিপূর্ণ পরিসরে পড়ে। এই মামলায় বলা হয়েছিল যে, অবৈধ অভিবাসী শিশুদের শিক্ষাগ্রহণের জন্য সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল করা একটি অত্যন্ত জটিল ও প্রায় অসম্ভব প্রক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী এবং সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়গুলো এটিকে সুরক্ষিত করেছে, যা দেশটিতে জন্মগ্রহণকারী সব ব্যক্তির নাগরিকত্বের অধিকার নিশ্চিত করে। ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রচারণায় জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিষয়টি আবেগিকভাবে আমেরিকান জনগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশল হিসেবে দেখা যাচ্ছে। যদিও তিনি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এটি পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বাস্তবে এটি আইনি চ্যালেঞ্জ এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার কারণে সহজে বাস্তবায়িত হবে না।

শেয়ার করুন