যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে বড় পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অভিবাসীদের ব্যাপকভাবে গণবহিষ্কারের জন্য তিনি ১৭৯৮ সালের আইন অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট ব্যবহার করবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প কি ১৭৯৮ সালের আইন ব্যবহার করে ব্যাপক হারে অবৈধ অভিবাসীকে বহিষ্কার করতে পারবেন? এটি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিবাসীদের মধ্যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে এবং আইনের যথাযর্থতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা নানা মতামত দিয়েছেন। এ আইনটি মূলত যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রশাসনকে শত্রু রাষ্ট্রের নাগরিকদের আটক ও বহিষ্কারের ক্ষমতা দেয়, কিন্তু ট্রাম্পের বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক উঠেছে যে এটি সাধারণ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনের শান্তিকালীন সময়ে অবৈধ অভিবাসীদের গণবহিষ্কারে এ আইন প্রয়োগের অধিকার নেই। প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার ও ব্যাপক অভিবাসন দমন নীতির সিদ্বান্ত নিয়েছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্টে ১১ মিলিয়নের বেশি অবৈধ অভিবাসী রয়েছেন। মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েন করে অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতার করবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বাইডেন প্রশাসনের অধীনে চালু হওয়া দুটি গুরুত্বপূর্ণ অভিবাসন কর্মসূচি বাতিল করার পরিকল্পনা করছেন। দুটি গুরুত্বপূর্ণ অভিবাসন কর্মসূচির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ লাখেরও বেশি অভিবাসী বৈধভাবে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। তবে যারা এই কর্মসূচির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করলেও এখনো আশ্রয় পাননি তাদেরকে প্রথমে বহিষ্কারের জন্য পরিকল্পনা করছেন।
ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির রূপরেখা স্পষ্ট করা হলেও বিশদ পরিকল্পনা এখনো প্রশ্নের সম্মুখীন। প্রায় ১১ মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসীকে কীভাবে শনাক্ত করা হবে এবং কোথায় রাখা হবে তা এখনো অস্পষ্ট। এছাড়া এই পরিকল্পনার আওতায় বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তাদের দেশের সহযোগিতা নিশ্চিত করাও বড় চ্যালেঞ্জ।
ট্রাম্পের বক্তব্য অনুযায়ী, এই বহিষ্কার কার্যক্রম শুরু হবে কলারাডোর অরোরা শহর থেকে এবং এর নাম হবে ‘অপারেশন অরোরা’। তিনি দাবি করেন যে, কিছু অভিবাসী ‘আমাদের দখল করতে চায়’, যদিও এই দাবির কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। ১১ অক্টোবর কলোরাডোর অরোরায় একটি সমাবেশে তিনি বলেন, তিনি অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে সক্রিয় প্রতিটি অভিবাসী অপরাধী চক্রকে ‘সম্পূর্ণরূপে নির্মূল’ করবেন।
অরোরায় ট্রেন দে আরাগুয়া গ্যাং নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য
ট্রাম্প বিশেষভাবে একটি ভেনেজুয়েলান গ্যাংয়ের কথা উল্লেখ করেছেন, যার নাম ট্রেন দে আরাগুয়া, যারা নাকি কলোরাডোর অরোরার বেশ কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স দখল করে নিয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন। আগস্ট মাসে এই দাবিটি প্রথম আলোচনায় আসে যখন স্প্যানিশভাষী কিছু সশস্ত্র ব্যক্তির একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, তারা একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে হাঁটছে। তবে স্থানীয় কর্মকর্তারা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বলেছেন, ভেনেজুয়েলান গ্যাং নিয়ে উদ্বেগ ‘অতিরঞ্জিত।’ অরোরা পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, তারা ট্রেন দে আরাগুয়া গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে, তবে এরকম কোনো প্রমাণ মেলেনি যে, তারা আসলেই কোনো অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স দখল করে নিয়েছে।
১৭৯৮ সালের অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট কী?
অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট ১৭৯৮ সালের অ্যালিয়েন অ্যান্ড সিডিশন অ্যাক্টসের চারটি আইনের অংশ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত হয়েছিল। এই আইনগুলোতে বিদেশি নাগরিকদের নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া কঠিন করা, সরকারের সমালোচনা নিষিদ্ধ করা এবং প্রেসিডেন্টকে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে এই চারটি আইনের মধ্যে শুধু অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট এখনো কার্যকর আছে। এই আইনটি প্রেসিডেন্টকে শত্রু রাষ্ট্র বা সরকারের লোকদের যুদ্ধকালীন সময়ে বিচার ছাড়াই আটক ও বহিষ্কার করার ক্ষমতা দেয়, যদি সেই রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে বা এমন হুমকি দেয়।
অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট মূলত বিদেশি গুপ্তচর এবং যুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত নাশকতা প্রতিরোধের জন্য প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু সংবিধান বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সাধারণ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা ঠিক নয়। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ব্রেনান সেন্টারের ক্যাথরিন ইয়ন ইব্রাইট বলেছেন, এই আইন যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য তৈরি, শান্তিকালে এর ব্যবহার বৈধ হতে পারে না।
শেষবার কবে ব্যবহার করা হয়েছিল এই আইন?
এই আইনটি মোট তিনবার ব্যবহার করা হয়েছে, শুধু যুদ্ধের সময়ে। ১৮১২ সালের যুদ্ধ: তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস ম্যাডিসন এই আইনটি ব্রিটিশ নাগরিকদের ওপর প্রয়োগ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ : প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন জার্মান এবং তার মিত্র দেশের লোকদের বিরুদ্ধে এটি প্রয়োগ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ : প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট শত্রু রাষ্ট্রের লোকদের আটক করার জন্য এটি প্রয়োগ করেন।
ট্রাম্প কি এই আইনটি ব্যবহার করতে পারবেন?
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এই আইনটি মেক্সিকান ড্রাগ কার্টেল এবং ট্রেন দে আরাগুয়া গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন। তবে আইনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের এই আইন ব্যবহারের অধিকার নেই। আইন অনুযায়ী, কোনো বিদেশি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ বা হুমকি প্রদান করলে এই আইনটি প্রয়োগ করা যায়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিদেশি সরকারের সঙ্গে যুদ্ধে নেই। অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্টের প্রয়োগ শর্তগুলো শুধু শত্রু রাষ্ট্র বা সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেটি ট্রাম্পের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দক্ষিণ সীমান্তে অবৈধ অভিবাসন এবং মাদক চোরাচালান কোনো আক্রমণ নয়, যুদ্ধও নয় এবং এই আইনের অধীনে ব্যাপক অভিবাসী বহিষ্কার করা আইনসম্মত নয়। কোনো বিদেশি শত্রু বা যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া এই আইনের প্রয়োগ করার চেষ্টা করলে তা আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্টের একটি কালো ইতিহাস
এই আইনটি ব্যবহার করা হয়েছে ১৮১২ সালের যুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, এই আইনটি মূলত জাপানি বংশোদ্ভূত অনাগরিকদের বন্দি করতে ব্যবহৃত হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে জাপানি আমেরিকানদের জন্য অনন্তকালীন ধারণার জন্ম দেয়। ১৯৮৮ সালে কংগ্রেস জাপানি বন্দিদের জন্য ক্ষমা চেয়ে এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করে, যেখানে বলা হয়েছিল যে, এ আইনটি নাগরিকত্ব ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ হয়েছিল।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১৭৯৮ সালের অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট ব্যবহার করে ব্যাপক অভিবাসী বহিষ্কারের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের আইন, সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইনটি শুধু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এবং নির্দিষ্ট শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য হওয়ায় এটি বর্তমান অভিবাসন সমস্যার সমাধানে আইনগতভাবে প্রযোজ্য নয়। তাছাড়া এই ধরনের উদ্যোগ কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও কাঠামোও সীমিত। ট্রাম্পের এই প্রচেষ্টা আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালায় স্থায়ী পরিবর্তন আনার চেয়ে অস্থায়ী প্রতিক্রিয়া হিসেবে থেকে যাবে।