৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:১৩:৫২ পূর্বাহ্ন


ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেললো শিবির
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৯-২০২৪
ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেললো শিবির


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অধিকাংশ সমন্বয়করা এখন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে শ্রমিক, রাজনৈতিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবিসহ সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সর্বত বলাবলি হচ্ছে এমন একটি আন্দোলনে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ গোপনে বাস্তবায়নে কোমলমতি ছাত্রদের পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণকে ব্যবহার করা হলো কি-না? এসব আলোচনা সমালেচনার খবর মিলছে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার পাশাপাশি বিভিন্ন দলের নেতাদের সাথে কথা বলে।

প্রকাশ্যে ছাত্রশিবির

বিভিন্ন গণমাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতা ছাত্রশিবিরের সভাপতিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর থেকে এনিয়ে আলোচনা। এখন পুরো আলোচনা রাজনৈতিক অঙ্গনে মারাত্মক দিকে টার্ন নিয়েছে। কেননা গত ২১ সেপ্টেম্বর শনিবার আবু সাদিক কায়েম নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাকে চিনতেন কোনো ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্তা নেই। এভাবে নিজেকে দলনিরপেক্ষ বলে প্রচার করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় নেতা বনে যায় সে। যদিও তার এমন আত্মপরিচয় গোপন করার ব্যাপারে একটি গণমাধ্যমে বলেছেন, পরিস্থিতির কারণেই এতদিন তিনি নিজের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। 

অন্যরা বলছে তারা প্রতারিত

নিজের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রাখা নিয়ে আবু সাদিক কায়েমের বর্তমান ব্যাখ্যার ব্যাপারে বললেও বাকিরা এটা মেনে নিতে নারাজ। কেননা আবু সাদিক কায়েমকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে তাকে সব মহল থেকে দলনিরপেক্ষ একজন ত্যাগী ছাত্র হিসাবে মেনে নেন। কিন্তু মেনে নেয়া এসব ছাত্র-জনতা এখন পড়েছেন বিপাকে। মাঠে আন্দোলন করেছেন, তাদের অনেকেই এখন নিজেদের প্রতারিত বোধ করছেন বলে গণমামধ্যমের খবর বেরিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেল শিবির নেতা কায়েমের পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর বেশ “অস্বস্থিতে” পড়েছেন বলে গণমাধ্যমে জানান। বলেছেন, “উনি যে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সেটা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না, একিই অবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্য নেতারাদের বেলায়ও। তারা নানা প্রশ্নবানে বেকায়দায়

ঢাবি ভিসি কিভাবে চিনলেন শিবির সভাপতিকে

এদিকে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সভা ডাকা হয়। দেখা যায় এই সভাটি কিছুটা গোপনীয়ভাবে হয় ওইদিনই সকালে। শিবিরসহ আরো দু’টি সমমনা ছাত্র সংগঠন ওই সভায় অংশ নেয়। জানা গেছে, ওই সভা পরিবেশ পরিষদের ব্যানারে ডাকা হয়নি। কিন্তু এতে শিবিরের দুজন নেতা সভাটিতে অংশ নেওয়ার পর এ নিয়ে ভিসির কাছে প্রশ্ন তোলেন কয়েকটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতারা। ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ শনিবারের মতবিনিময় সভায় ভিসিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি কীভাবে তাঁকে (শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি) খুঁজে পেলেন?’ ভিসি নিয়াজ আহমেদ খান তাঁর এই প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়। এদিকে গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ (বাসদ) কয়েকটি বাম ছাত্রসংগঠনের নেতারা সভায় শিবিরের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেন ওই সভায়। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই বা হঠাৎ কিভাবে শিবিরকে মতবিনিময় সভায় ডেকেছে? এগুলোও রহস্য সৃষ্টি করেছে। 

প্রতিবাদ করলো ছাত্রদল

বিএনপি সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের একজন নেতাও গণমাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভার ব্যাপারে প্রতিবাদ করেছেন। ছাত্রদলের ঢা বি’ শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন জানান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হঠাৎ যেভাবে শিবিরকে মতবিনিময় সভায় ডেকেছে, আমরা সেটি সমর্থন করি না। সেজন্য স্পষ্ট ভাষায় এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছি। এছাড়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রদলের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা গণমাধ্যমে বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তাদের অবস্থান প্রকাশ করতে হবে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো এবং অন্যান্য অংশীজন মিলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

যে কারণে ঢাবি শিবির নিষিদ্ধ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্যে রাজনীতি বন্ধ করা হয়েছিল নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সব সংগঠন। তারা সবাই একমত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির রাজনীতি বন্ধ করেছিল। একিই সময়ে জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন ‘ছাত্র সমাজে’র রাজনীতিও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ছাত্র শিবির হচ্ছে ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীতাকারী দল জামায়াতের ছাত্র সংগঠন। 

শেষ কথা

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে গত ১৭ বছর ধরে নিপিড়ন নির্যাতন চালিয়েছিল বলে দেশে বিদেশে রযেছে ব্যপাক প্রচারণা। তারা ১৭ বছর ধরে গনতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। কখনো একতরফা বা দিনের ভোট রাতে আবার ডামি নির্বাচন কইে ক্ষমতায় জেকে বসেছিল। এই সময়কালে দেশের তরুন সমাজের বিরাট অংশ যারা নিজের ভোট নিজে দিতে পারেনি, সেসব তরুনদের মনের মধ্যে ক্ষোভ অসন্তোষ ক্ষমতাসীনদের অজান্তেই দিনের পর দিন ফুসে উঠছিল। অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিনের পর আরো অনেকি ক্ষেত্রে নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ছাত্রসমাজ। চাকুরি ক্ষেত্রেও ছিল মারাত্বক বৈষম্য। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে কোটা নিয়ে সরকার ছিনিমিনি খেলেছে বছরের পর বছর। এমনই পরিস্থিতিতে ছাত্ররা মাঠে নামে ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে। গড়ে তোলা সে-ই আন্দোলনে প্রথমে কোনো রাজনৈতিক দলই প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়নি বলা যায় এক ধরণের দূরত্ব বজায় রাখেন। অনেকে ভেবেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এটি একটি সরকারি নাটক। বলাবলি হচ্ছিল বিএনপি’র নেতৃত্বে আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে এমন আন্দোলন করা হচ্ছে । কিন্তু দিনের পর দিন পরিস্কার হয়ে যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারটি সম্পূর্ণ দলনিরপেক্ষ একটি সবার জন্য প্লাটফরম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গড়ে উঠা এই আন্দোলন আরো তুঙ্গে উঠে যখন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে থাকা আইন শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগও হত্যাযজ্ঞে যোগ দেয়। আর এতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। কিন্তু বর্তমানে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার সে-ই আন্দোলনের নেপথ্যে বা মাস্টারমাইন্ড হিসাবে ছাত্র শিবিরের প্রকাশ্যে এসে একক কৃতিত্ব বলে প্রচারে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে খ্দো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে থাকা সমন্বয়করদের মধ্যে। এর পাশাপাশি ওই আন্দোলনকে শুধুমাত্র দলনিরপেক্ষ এবং এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মনে করে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে সেসব শ্রমিক, কৃষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিল্পীরাও অস্বস্থিতে পড়েছেন। এক হিসাবে দেখা যায়, 

জুলাই বিপ্লবে শহীদ ১৪২৩, আহত ২২ সহস্রাধিক। বলা হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে অন্তত ৯৬ শিক্ষার্থী প্রাণ দিয়েছেন। অন্য জেলায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩৯ জন। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে হাসিনা সরকারের পতনের অভ্যুত্থানে ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞে এসব শিক্ষার্থী জীবন দেন। নিহত শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠান ও তাদের স্বজন-সহপাঠীর সঙ্গে যোগাযোগ এবং তথ্য বিশ্লেষণ করে ১৩৫ শিক্ষার্থীকে হত্যার তথ্য নিশ্চিত করতে পেরেছে একটি বহুল প্রচারিত গণমাধ্যম। আবার এই আন্দোলনে ২ শতাধিক পোশাক শ্রমিক নিহত হন। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তাহলে কি কেউ রাজনীতিতে কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শ গোপনে বাস্তবায়নে কোমলমতি ছাত্রদের ব্যবহার করেছে। তারা নিজেদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এমনটি করেছে? কারো কারো মতে এমনটা হলে জাতিকে ভবিষ্যত নয় সহসাই অনেক ক্ষতির শিকার হতে হবে। তবে কারো কারো মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে যারা গত ১৭ বছর ধরে নিপিড়ন নির্যাতন চালিয়ে গণতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল তারা বেশ উপভোগ করছে এমন পরিস্থিতি, যা অনেককে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। 

শেয়ার করুন