জাতীয় সংগীত ইস্যুতে তোলপাড় বাংলাদেশ! জামায়াত ইসলামের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের পুত্র সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আযমীর করা এক মন্তব্যে ওই সূচনা। বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যাতে রক্তগঙ্গার বিনিময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দীর্ঘ ১৬ বছর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতা চালানো আওয়ামী লীগ ও দলের প্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে গণঅভ্যুত্থান, এতে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার মধ্যে বিশাল ফাটল ধরেছে। এদের এক পক্ষ বলছে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন হলে এমনকি, কারণ এখানে বাংলাদেশের নাম ও মুক্তিযুদ্ধের কোনো কিছু নেই। যেটা চাপানো ভারতীয়দের। অন্যপক্ষ এ সংগীত মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণ করেছে এবং এ সংগীত এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহন করছে। এ দুই পক্ষের মধ্যে একটা বড় অংশ রয়েছে যারা নীরব ভূমিকায়!
যে বক্তব্যে বিতর্ক
৩ সেপ্টেম্বর প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আমান আযমী বলেন, ‘১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই?
‘আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশ থাকতে চাই। এ জাতীয় সংগীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থী। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি, আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা হোক।’
’৭২-এর সংবিধানকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেট নিয়েছিল পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য, স্বাধীন সংবিধান রচনা করে নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু তারা জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেট নেয়নি। সুতরাং এই সংবিধান আমার দৃষ্টিতে বৈধ নয়। নতুন করে একটা কমিটি করে নতুন সংবিধান তৈরি করা হোক, এটা বাতিল করা হোক।’
সংবাদ সম্মেলনে পুরোনো এক প্রশ্নের উত্তরে আবারও তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব সাহেব ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছেন এবং এটাই ৩০ লাখ হয়ে গেছে। কোনো জরিপ ছাড়া ৩০ লাখ শহিদ বলে বলে তারা মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আপনারা জরিপ করে বের করেন, অ্যাকচুয়ালি ৩০ লাখ হোক আর ৩ কোটি হোক। আমার জানামতে, এটা ২ লাখ ৮৬ হাজার। তারা ৩ লাখকে ৩০ লাখ বানিয়ে ফেলেছে। এখনো সময় আছে, জাতিকে সত্য ইতিহাস জানতে দিন। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মিথ্যার ওপরে আপনারা গড়ে তুলতে দেবেন না। সত্যিকার একটা জরিপ করে আপনারা ব্যবস্থা করেন।’
বিতর্ক চলছে যেভাবে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একপক্ষ বলছে আমরা জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করবো। অন্যপক্ষ আমরা জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে দেবো না। রাজনৈতিকভাবে কোনো দলই এ ব্যাপারে মুখ খুলছে না। তবে এ ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীও প্রথম কোনো মন্তব্য না করলেও শেষাব্দি ৮ আগস্ট জামায়াতের সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন,‘আব্দুল্লাহিল আমান আযমী জামায়াতে ইসলামীর সদস্য নন। তিনি জাতীয় সংগীত পরিবর্তন নিয়ে যা বলেছেন, তা তার একান্ত ব্যক্তিগত মন্তব্য। এর ব্যাখ্যার দায় জামায়াতে ইসলামীর নয়।’ কিন্তু ৩ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই পক্ষে তোলপাড়!
বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হাজারো নিহত ও হাজার হাজার আহত ছাত্র-জনতার যে ইস্যু সেটা আযমীর ওই বক্তব্যের বিতর্কে অনেকটাই চাপা পড়ে যায়। যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক ও দলটির দোসর, আওয়ামী শাসনের সুফল ভোগ করা সুশীল তারাও মুখ খোলার একটা উপলক্ষ পেয়ে যায়। এমনকি আওয়ামী সমর্থক উদীচী শিল্পগোষ্ঠী যারা এতো বিশাল পরিমাণ ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডে গোটা বিশ্ব যেখানে বিস্মিত, সে ব্যাপারে উদীচী বা আওয়ামীপন্থী সুশীল সমাজের কেউ একটিবারের জন্য টু শব্দও করেনি। চুপ করে সার্কাস দেখার মতো বিষয়গুলো উপভোগ করে গেছে। ফলে এসব লোকেরাও এ বক্তব্যের বিতর্কে টেকনিক্যালি মাঠে নেমে নিজেদের সমর্থিত দলকে উজ্জীবিত করার কাজে সাহস জোগানোর চেষ্টা করেছেন।
ধর্ম উপদেষ্টা এক মন্তব্যে বলেছেন, আমরা এমন কিছু করতে চাই না, যাতে জাতির মধ্যে বিভেদ তৈরি হোক। যা দিয়ে তিনি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষে নন, এটাই বোঝাতে চেয়েছেন। এখানে অবশ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাংস্কৃতিক অঙ্গন সোচ্চার
ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীদের নাম যখন উঠে আসছে এবং দলটির নেতা শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ যখন কঠিন চাপে, ঠিক তখন আমান আযমীর বক্তব্যকে উপলক্ষ হিসেবে বা উঠে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে কেউ কেউ।
বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীবৃন্দ, যারা আওয়ামী লীগ সমর্থিত, তারা বেশ সোচ্চার মাঠে। গণঅভ্যুত্থানে সহস্রাধিক ছাত্র-জনতা হত্যায় যারা বিন্দু মাত্র টু শব্দ করেনি, তারা রাস্তায় ও বিভিন্ন সামাজিক প্ল্যাটফর্মে সোচ্চার হয়ে মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তারা উঠে দাঁড়ানোর একটা ম্যাসেজ দিচ্ছে এবং এতে তারা সফল। এমন ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও তোলপাড়। তবে বিএনপি ও তাদের সমর্থক দলসমূহ এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করে যাচ্ছে। এখানে বিএনপি সমর্থিত গ্রুপে জামায়াতে ইসলামী নেই এটা ক্লিয়ার। জামায়াতে তার সাবেক আমিরের পুত্রের বক্তব্যের সঙ্গে তারা একমত কি না বা ওই ধারা তারা বিশ্বাস করে কি না বা কখনো ক্ষমতায় গেলে বা ক্ষমতার অংশ হলে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের চেষ্টা বা ইস্যু তুলবেন কি না, সেটা ক্লিয়ার করেনি।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সঙ্গে আর কখনো জোটে না যাওয়া ও বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে যেসব স্থানে দখলদারিত্ব চলেছিল, সেগুলো রাতারাতি ৮০ শতাংশ বিএনপি দখল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ করে। এরপর থেকেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক শীতলতা বাড়ে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এর কড়া জবাব দেন। ফলে সংগতভাবেই বিএনপিও এ ব্যাপারে টু-শব্দও করেনি। প্রয়োজনও মনে করেনি। বিষয়টা যেহেতু জামায়াতকেন্দ্রিক, তাই এটা তাদের ইস্যু হিসেবেই মনে করে বলে জানা গেছে।
মাঠে নেই আওয়ামী লীগ
ক্ষমতাচ্যুত ও ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডের মামলায় জর্জরিত আওয়ামী লীগ মাঠশূন্য। ফলে এ জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম-পুত্র আমান আযমীর বক্তব্য প্রসঙ্গে ব্যাপারে তাদেরও নেই কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবুও আওয়ামী ঘরানার সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যেভাবে সোচ্চার, তাতে আওয়ামী লীগপন্থী সুশীলরাও এ ব্যাপারে অচিরেই মুখ খোলার সাহস দেখাবেন বা মন্তব্য করার তাগিদ মনে করবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কেননা ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ ঘরানার অনেকেই একই সুরে বলতে শুরু করেছে যে, জাতীয় সংগীত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী কার্যক্রমের অংশবিশেষ। আর এসব কাজ করতে একমাত্র তারাই উৎসাহী হবেন, যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন।
এছাড়াও আবদুল্লাহিল আমান আযমীর আরো একটি কথা বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গে। মহান স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা। আযমী বলেছেন, এটা ভুল তথ্য। হবে ৩ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে সত্যটা জানাতে ৩০-এর স্থানে ৩ লাখ তদন্ত করে বের করারও আহ্বান জানিয়েছেন।
এটাও আওয়ামী লীগের কাছে একটি আপত্তিকর বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। দলটি মনে করে, শেখ মুজিবুর রহমান যেটা বলেছেন, ওটাই রাইট। সেখানে আর কোনো কাটছাঁট নয়। নেতার ভাষণ যা, সেটাই সত্য। এতোদিন পর এ বিষয়ে কথা উঠলে আরো অনেক বিষয় নিয়ে এমন বিতর্ক উঠতেই থাকতে পারে!