১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০৪:৬:৪৩ পূর্বাহ্ন


এমন বাংলাদেশই তো আমরা চেয়েছিলাম
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০৮-২০২৪
এমন বাংলাদেশই তো আমরা চেয়েছিলাম বন্যার্তদের জন্য স্বেচ্ছাসেবীদের ত্রাণ তৎপরতা


ভারত থেকে আসা প্রবল বন্যার তোড়ে প্লাবিত হয়েছে দেশের পূর্বাঞ্চল। কালবিলম্ব না করে মানবতার চিরন্তন হৃদয়াবেগ নিয়ে দুর্গত মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশের আপামর ছাত্র-জনতা। সর্বস্তরের মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বন্যার্তদের সহায়তায়। সর্বশক্তি নিয়ে দেশের এই ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নেমেছেন। যে যেভাবে পেরেছেন অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, উদ্ধার, আশ্রয় দিয়ে, কায়িক শ্রম দিয়ে ত্রাণ কাজে সহায়তা করছেন। তারা বলছেন, এ ঐক্যই দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধারের প্রধান শক্তি।

দেশে যখন বন্যার তা-ব তখন ফেসবুকের বুক ভরা ছিল শুধু ত্রাণকাজের ছবি, ভিডিও আর এ সংক্রান্ত হরেক রকম আবেদনে। বিভিন্ন গ্রুপ, সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও মানুষ এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরেছেন তাদের আহ্বান, অনুরোধ, অভিমত, অভিজ্ঞতা। মুঠোফোন নম্বর, ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর, যোগাযোগের ঠিকানা ইত্যাদি।

এ বন্যার সময় পাকিস্তানের সঙ্গে টাইগারদের টেস্ট খেলা চলছিল। বন্যার খবরের কারণে টেস্ট ম্যাচের বিষয়টিও গৌণ হয়ে যায় ফেসবুকে। ফারদিন হাসান নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পুরা ফেসবুক ওয়ালে খেলা নিয়ে একটা পোস্টও দেখলাম না। সবার চিন্তা কেবল বন্যা ও ভারতের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে। আমার দেশটা আসলেই বদলে গেছে, আমার দেশের মানুষ দেশ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে! এই দেশ আর যাই হোক, বিপথে যাবে না।’ ছাগলনাইয়ার মিশু মজুমদার ফেসবুকে লিখেছেন, ছাগলনাইয়া বাজার তাদের মিশু ফিলিং স্টেশন থেকে ত্রাণকাজে ব্যবহৃত যানবাহনের জন্য বিনামূল্যে জ্বালানি তেল দেওয়া হচ্ছে।

বন্যার এ সময়টাতে টিএসসিতে ছিল ভিন্ন এক চিত্র। ত্রাণ নিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগমে টিএসসি এলাকা ছিল লোকারণ্য। টিএসসির ফটকে বুথ সামলাতে হিমশিম খান শিক্ষার্থীরা। কেউ বোতলজাত পানি ও খাওয়ার স্যালাইন, কেউ মুড়ি-চিড়া, কেউ বিস্কুট, আবার কেউ খেজুরসহ বিভিন্ন শুকনা খাবার নিয়ে আসেন। স্বেচ্ছাসেবক ছাত্রছাত্রীরা সেগুলো হাতে বা কাঁধে করে টিএসসির অভ্যন্তরীণ ক্রীড়াকক্ষ ও ক্যাফেটেরিয়ায় নিয়ে জমা করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এ উদ্যোগে অনেকে নগদ অর্থ দিয়েও শরিক হন। বুথে বসা ছাত্রীরা খাতায় অনুদানের অঙ্ক লিখে টাকা জমা রাখেন। জানা যায়, সেখানে প্রায় নগদ কোটি টাকা জমা পড়েছে প্রতিদিন।

ত্রাণকাজে নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ, ঢাবি পরিবার, বিভিন্ন বিভাগ। দীপ সাহা নামের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘জগন্নাথ হলের সরস্বতী পূজার জাঁকজমক আর বাজেট বাংলাদেশের কে না জানে, প্রায় ৮০টি মণ্ডপে একসঙ্গে পূজা হয়। সবচেয়ে সুন্দর বিষয়টি হচ্ছে, প্রায় প্রতিটা মণ্ডপ থেকেই পূজার বাজেটের একাংশ বন্যার্ত মানুষদের সহায়তার জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

একইভাবে সুরেশ নামের একজন লিখেছেন, খাগড়াছড়িতে বৌদ্ধভিক্ষুরা ত্রাণকাজে অংশ নিচ্ছেন। দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে তারা তিনটি কমিটি করে কাজ করছেন। বরিশালের অয়ন চক্রবর্তী লিখেছেন, চক্রবর্তী বাড়ির দুর্গামন্দিরে এবার দুর্গাপূজার বাজেটের একটি অংশ বন্যাদুর্গতদের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। এটা মোটেও দান নয়, এটা বন্যার্ত মানুষের অধিকার।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘ওমরা করার জন্য জমানো ১৪ হাজার ৫০০ টাকা বন্যার্তদের দিয়ে আনন্দিত।’

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি

৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা যেন নতুন সাজে সেজেছে। দেওয়ালগুলোতে নেই ব্যানার পোস্টারের জঞ্জাল। দেওয়ালগুলো সেজে উঠেছে রংতুলির আঁচড়ে। শুধু ঢাকা নয় গোটা দেশের শহুরে দেওয়ালগুলোই এখন রঙিন। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পোস্টারগুলোর জায়গায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের গল্প। যে গল্পের অধ্যায়গুলোতে রয়েছে বিদ্রোহ, বেদনা, হাসি-কান্না, প্রত্যয়, দুর্নীতি, স্বপ্নসহ নানা বিষয়। যেগুলোর সিংহভাগেই রয়েছে ক’দিন আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে হয়ে যাওয়া ছাত্র-জনতার লড়াইয়ের গল্প, গণহত্যার নৃশংসতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে এই চিত্রগুলোয় গুণমুগ্ধ প্রশংসা করছেন সবাই। 

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে উঠেছে দেওয়ালগুলো। মিরপুর ১০ নম্বর সড়কে দেখা যায়, এলাকাজুড়েই রঙের ছোঁয়া। এর মধ্যে কয়েকটি বিশেষভাবে চোখে বাধে। যাতে লেখাÑ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’, ‘মানব সভ্যতা গড়বো আমরাই’, ‘দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই’, ‘বিকল্প আমরাই’। মিরপুরের মেট্রোরেলের পিলারগুলোতে বৈচিত্র্যপূর্ণ গ্রাফিতি। কয়েকটি গ্রাফিতিতে চোখ আটকে যায়, যাতে লেখাÑ‘শোনো মহাজন, আমরা অনেকজন’, ‘আমার বিচার তুমি করো, তোমার বিচার করবে কে’, ‘স্বাধীনতা ৩৬ জুলাই ২৪’ ইত্যাদি। এছাড়াও দুটি গ্রাফিতির সামনে অনেকেই ছবি তুলছিলেন। যাতে দেশের রঙিন বেলুনের পাশে লেখা ‘এঊঘ-ত, আরেকটি গ্রাফিতিতে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার বুকে তিনটি গুলির চিহ্ন, দু’হাতে ভাঙা শিকল, পেছনে বাংলাদেশের মানচিত্র।

সরকার পরিবর্তনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে, এখনো হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন প্রায় অভিভাবকশূন্য। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টর, ডিনরা পদত্যাগ করেছেন। কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো পদাধিকারী ব্যক্তিদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন।

এর ব্যতিক্রম দেখলাম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগ ঠেকানোর জন্য আন্দোলন করেছেন। উপাচার্য শিক্ষার্থীদের ডেকে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘সম্মান রক্ষার জন্যই আমি পদ ছেড়ে দিয়েছি। এই পদে থেকে অসম্মানিত হলে পরে শিক্ষক হিসেবেও ছাত্রদের সামনে মুখ দেখাতে পারবো না।’ এ যুগে যে এ রকম আত্মমর্যাদাসম্পন্ন উপাচার্য আছেন, তা অনেক হতাশার মধ্যেও আমাদের আশাবাদী করে তোলে। বলছি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য ড. মাহমুদ হোসেনের কথা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি শিক্ষার্থীদের পক্ষে দৃঢ় ভূমিকা নেন এবং ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকতে দেননি। সে সময় উপাচার্য ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমার ক্যাম্পাসে কোনো পুলিশ প্রশাসন ঢুকতে পারবে না; এখানে আমিই প্রশাসন।’ তার এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে।

যেখানে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে শান্তি রক্ষার অজুহাতে ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে এনেছেন, সেখানে মাহমুদ হোসেন দৃঢ় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেননি।

এটাকে ব্যতিক্রম বললেও কম বলা হবে। শিক্ষাঙ্গনে যখন নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদাধিকারী ব্যক্তিরা সরকারের মন রক্ষার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তখন মাহমুদ হোসেন একা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তিনি সরকারকে জানিয়ে দিয়েছেন, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তায় বাইরের কারো প্রয়োজন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হলেও ক্যাম্পাসের ভেতরে পুলিশকে ঢুকতে দেননি তিনি। এজন্য শিক্ষার্থীরা তার প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় সেখানে ছাত্রলীগ দৌরাত্ম্য দেখাতে পারেনি।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত ভেবেছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা নানা রকম সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মাহমুদ হোসেন সে চেষ্টা করেননি। বরং শিক্ষার্থীদের অনুরোধ রক্ষায় অপারগতা প্রকাশ করেছেন। দেশে দুর্যোগ-দুর্বিপাক আসতেই পারে। সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন উক্তি, ছবি কিন্তু বলে দিচ্ছে, সম্মিলিত মানুষের বিপুল চেষ্টায় মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। কালি মন্দিরের দানবক্সের টাকা যাচ্ছে বন্যার্তদের জন্য। মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে সনাতন ধর্মের মানুষ। বৌদ্ধভিক্ষু মাথায় করে বস্তা বস্তা ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। ব্রহ্মচারী ও সাধুরা ঘরে ঘরে গিয়ে পানি খাবার দিচ্ছে। তরুণরা নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করছে। সাধারণ মানুষ নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে এসেছে। আর কি দরকার?

আমাদের এ সমাজে মাহমুদ হোসেনের মতো আত্মমর্যাশীল উপাচার্যরা আছেন। আমাদের এ নতুন বাংলাদেশে মুসলমানরা মন্দির পাহারা দেয়। হিন্দু ভাইয়েরা মন্দির তহবিল থেকে বন্যার্তদের সাহায্য করে। এটাই তো সম্প্রীতির বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে কেউ হারাতে পারবে না। কেউ না।

নিউইয়র্ক, ২৬ আগস্ট ২০২৪

শেয়ার করুন