সদ্য পদত্যাগী আওয়ামী লীগ সরকারে শেষ দিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের ও রওশনপন্থি কারোই সহযোগিতা পায়নি। বরং দু’পক্ষই সুযোগ বুঝেই সময় মতো আওয়ামী লীগের বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পক্ষে অবস্থান নিয়ে এই প্রতিশোধ নেয়া হয়।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওই সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাশ থেকে সরে যায় জাতীয় পার্টি। সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাতে গড়া জাতীয় পার্টি দলটি সে সময়ে পুরোপুরি ইউ টার্ন নিয়েছিল। এর বিপরীতে দলটি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বিবৃতির পাশাপাশি মন্তব্য করে যাচ্ছিল। কিন্তু আর এসব নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে সে সময়ে ক্ষোভ পাশাপাশি দলটির প্রতি রেখেছে কঠোর নজরদারিও রেখেছিল।
এখন দেখা যাক কে কি বলেছিলেন
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এবং বিরোধীদলের নেতা জি এম কাদের একে যৌক্তিক আন্দোলন বলে অভিহিত করেন। শিক্ষার্থীদের অহিংস কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সমর্থন এবং যৌক্তিক আন্দোলনে সশস্ত্র হামলার নিন্দা জানান। বলেছেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী তরুণদের অভিনন্দন।
তাদেরকে বীর মুক্তিসেনা হিসেবে অভিহিত করতে চাই।’ আবার আন্দোলনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম নির্যাতন চলছে বলে অভিযোগ করেছেন বিরোধী দলের নেতা জি এম কাদের। তিনি বলেছেন, একদিকে সরকার বলছে, ছাত্রদের সব যৌক্তিক দাবি মেনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে এখনও কয়েকজন শিক্ষার্থী নিখোঁজ রয়েছে। মামলায় আটক হয়েছে অনেকেই, যা সরকারের দ্বিচারিতা ছাড়া কিছুই নয়।
অন্যদিকে আরো পরে সংঘাত প্রাণহানির জন্য সরকার বিএনপি-জামায়াকে দায়ী করলেও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) অভিমত প্রকাশ করেছে যে, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ রূপ নিয়েছে জনতার আন্দোলনে। দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা, গণতন্ত্রহীনতায় মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ছিল। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, চলমান অহিংস ছাত্র আন্দোলনের প্রতি জাপার সমর্থন অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের দেওয়া হতাহতের তালিকা জাপা বিশ্বাস করে না।
যৌথ সভার প্রস্তাব কার পক্ষে
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে জাতীয় পার্টির জরুরি যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সময়ে বনানী জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের কার্যালয় মিলনায়তনে পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা জিএম কাদেরের সভাপতিত্বে এ যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। যৌথসভা শেষে সভার সিদ্ধান্তগুলো গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরেন জাতীয় পার্টি মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি। সভার সিদ্ধান্তগুলোর চুম্বক অংশগুলি তুলে ধরা হলো। এতে বলা হয় জাতীয় পার্টির এই যৌথ সভা সর্বসম্মতভাবে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জ্ঞাপন করে। সেই সঙ্গে চলমান অহিংস ছাত্র আন্দোলনের প্রতি জাতীয় পার্টির সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
বলা হয় এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ন্যায্য দাবি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমনের প্রক্রিয়াকে তীব্র নিন্দা জানানো হয় সভায়। নিহত ছাত্র-ছাত্রীরা বীর মুক্তিসেনা হিসেবে আখ্যায়িত হবে এবং একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রকৃত শহিদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। সভায় ছাত্র হত্যার সঙ্গে জড়িত সব সরকারি কর্মকর্তা, উস্কানিদাতাকে আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সভায় সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভা মনে করে কেপিআইভুক্ত স্থাপনাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর হামলা ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারে সভার সিদ্ধান্তও ছিল বেশ তীর্ষক। জাপার পক্ষ থেকে বলা হয় এ ব্যাপারে নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব সরকারের। সরকার এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এই দায় সরকার এড়াতে পারে না। এর পাশাপাশি সহিংসতায় নিহত ও আহত সাংবাদিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবিও করা হয় সভায়। এভাবেই (জি এম) কাদের পন্থিরা সে সময়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
অন্যদিকে একেবারে বসে ছিল না রওশনপন্থিরাও। তবে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক সপ্তাহ আগেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে ‘নাশকতাকারীদের’ রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে বিচার চেয়েছিল। কিন্তু ঠিক সরকার পতনের কয়েকদিন আগে সুর বদলে ফেলে রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলটি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফাকে সমর্থন করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পদত্যাগ দাবি করে বসে। আন্দোলনে প্রণহাণিকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যাও দেয়। রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন জাপার (রওশন) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন, সন্ত্রাস দমনের নামে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত করতে প্রশাসন নারকীয় গণহত্যা চালাচ্ছে। ছাত্রদের সকল ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে অবিলম্বে জুলুম-নির্যাতন ও গণগ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে। অযোগ্য বাকপটু মন্ত্রী, এমপিদের পদত্যাগ ও অতি উৎসাহী পুলিশ অফিসারদের বরখাস্থ করতে হবে। আন্দোলনে নিহতদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
ডিকবাজি কেন?
কাদের ও রওশনপন্থিরা শেষ বেলায় শেখ হাসিনার বিপরীতে কেনো অবস্থান নিলো? কেনো দু’গ্রুপই শেখ হাসিনার বিপরীতে অবস্থান নিলো? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাদের ও রওশনপন্থিরা শেষ বেলায় আসলে হাসিনার ওপর একধরনের প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে। কাদের ও রওশনপন্থি দু’পক্ষই মনে করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাদের সাথে নানান ধরনের চল-চাতুরি করেছে। কেননা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে কাদের পন্থীদের ধারণা ছিল তারা আওয়ামী লীগের সাথে ২৬টি আসনে সমঝোতার বাইরেও আরো কয়েকটি আসন তারা বাগিয়ে নেবে। কিন্তু তাদের মাথায় একটুও আসেনি কি হতে পারে তাদের সামনে। শেষ বিচারে ১১টি আসন নিয়েই জাপার জি এম গ্রুপকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। এসবের পেছনে শেখ হাসিনার কূটকৌশল মনে করে কাদের পন্থিরা। অন্যদিকে সেসময়ে দলীয় প্রতীক ‘লাঙ্গল’র নিবন্ধন নিয়ে যে টানাটানি শুরুও হয়েছিল সেটি শেখ হাসিনার কূটকৌশলই মনে করেন কাদের পন্থিরা। অন্যদিকে ঢাকায় সম্মেলন করে জাপার নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করেছিল রওশনপন্থীরা। এর মধ্য দিয়ে আরেকটি ‘ব্র্যাকেটবন্দী’ জাপার নেতা হন রওশন এরশাদ।
আরওই সময়ে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা বলেছে, তারাই মূল দল। এমন পরিস্থিতিতে রওশনপন্থীরা অনেক আশা করেছিল তারা সে-সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থন পাবে। জি কাদেরের বিরুদ্ধে চাপ বজায় রাখবে । কিন্তু শেষ বিচারে জাপা’র কাদের বা রওশনপন্থি কেউ জাপা’র সমর্থন পায়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আসলে সব দিক থেকে মাজা ভাঙ্গা জাপা দেখতে চেয়েছিল। এজন্য তাদেরকে কৌশলে মূলত অস্থির করে রাখা হয়েছিল যেনো ওই সময়ে মাঠে আন্দোলনরত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র সাথে কোনো ধরনের জট পাকাতে না পারে। সেসময়ে অস্থির জাপাকে নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে ছিলো আওয়ামী লীগ। পুরো ব্যাপারটি সুচতুর মেধাবী রাজনীতিবিদ (জি এম) কাদের যেমন বুঝে ফেলেন। তেমনি রওশনপন্থিরাও আঁচ করতে পারে।
তবে প্রবল ক্ষমতাধর আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কোনোভাবেই দু’পক্ষই উচ্চবাচ্য করতে পারেনি। কিন্তু কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষই বুঝে যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আর শ্বাস নেই। এখনই ঝোপ বুঝে কোপ মারতে হবে। আর সেজন্যই উপযুক্ত সময়ে উভয় পক্ষই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পক্ষেই কথা বলতে থাকে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহলের মতে, এটা কাদের ও রওশনপন্থিদের পক্ষ থেকে হাসিনার শেষ বেলায় তার ওপর ওই সব কর্মকাণ্ডের জন্য একটা প্রতিশোধ ছাড়া কিছু না।