৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:১৫:৫৮ পূর্বাহ্ন


অর্থনীতির অসুস্থতা কাটছে না
ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৫-২০২৪
ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ


বিশ্বের অধিকাংশ দেশ করোনা অতিমারির অভিঘাত এবং বৈষয়িক যুদ্ধ এবং সংঘর্ষের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া কাটিয়ে উঠলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি কিন্তু এখনো অসুস্থ। দেনা পরিশোধের চাপ, মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকায় মুদ্রাস্ফীতি দীর্ঘতর হচ্ছে। আমদানি-রফতানি সংকুচিত হচ্ছে, জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ায় শিল্প-কারখানাগুলো পরিচালনায় সংকট চলছে, দেশীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। নানা ধরনের কৃচ্ছ্রতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও সুফল মিলছে না।

 সংকট পথে থাকা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের নানা ধরনের প্রচেষ্টা নিলেও এখন পর্যন্ত সুফল মিলছে না। দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, সুশাসনের অভাবের কারণে সর্বত্র দুর্নীতির সর্বগ্রাহী প্রভাব বর্তমান পরিস্থিতির মূল কারণ বলে বার বার বলে আসছেন। শাসক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা অশুভ সিন্ডিকেট দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বুনিয়াদ ভেঙে ফেলেছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলো আমদানি-রফতানিতে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং করে মুদ্রা পাচার করেছে। দুবাই, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক এমনকি কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে দুর্নীতিগ্রস্ত বাংলাদেশিরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে। অথচ দেশে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপনে হিমশিম খাচ্ছে সীমিত আয়ের স্বল্প ও মধ্যবিত্ত। এই অবস্থার দ্রুত অবসান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। দেনার দায়ে রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা দ্রুত পাল্টানো না হলে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছে অনেকে।

অর্থনীতির বেহাল অবস্থায় আসছে নতুন আর্থিক বছরের বাজেট ঘোষণার সময়। নতুনভাবে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের নতুন টার্মে প্রথম বাজেট ঘোষিত হবে ৬ জুন। বলা হচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজারে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে নতুন বাজেটে দ্রব্যমূল্য কমানোর বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর। সর্বশেষ এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বেড়েছে। এতে করে বেশিরভাগ নিত্যপণ্য বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মুহূর্তে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা। যেভাবেই হোক বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। ইতিমধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা। আগামী ৬ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন করা হবে। জনগণকে স্বস্তি দেওয়া হবে। অথচ গত তিন টার্মে ১৫ বছর একাধারে ক্ষমতায় থেকেও সরকার কিন্তু অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারেনি। সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন কর্মকা- সম্পাদন করলেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার ঘনিষ্ঠ সুবিধাবাদী মহল অবাধ দুর্নীতি করে উন্নয়নের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন না হওয়ায় সিন্ডিকেটগুলো সরকারের অধিকাংশ শুভ উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিয়েছে। সরকার ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ মুখ থুবড়ে পড়েছে।

দেশের কৃষক সমাজ কিন্তু প্রতি নিয়ত বাম্পার ফসল ফলন করছে। কৃষিজাত দ্রব্য, মাছ, মাংস, সবজি, ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক স্বাবলম্বী। অথচ বাংলাদেশিরা সরকার ঘনিষ্ঠ মধ্যস্বত্ব ভোগীদের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে কৃষক এবং উৎপাদনকারীরা সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। প্রশ্ন জাগে দেশে পর্যাপ্ত উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশকে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য আমদানিনির্ভর থাকতে হয়? কেন সরকার অশুভ সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না?

উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত দুনিয়ার প্রায় সব দেশ বৈষয়িক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রায় সব দেশ সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ দেশ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। পারছে না বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, এপ্রিল মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.২২ শতাংশে, যা মার্চ মাসে ছিল ৯.৮৭ শতাংশ। শহরের তুলনায় গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে। এ কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ সীমিত আয়ের মানুষ। এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০.২২ শতাংশের অর্থ হলো ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ করতে হয়েছে, সেই একই পণ্য এই বছরের এপ্রিলে কিনতে খরচ করতে হয়েছে ১১০ টাকা ২২ পয়সা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৪৪ শতাংশ। এর আগে ২০২৩ সালের এপ্রিলে জাতীয়ভাবে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৮৪ শতাংশ। যদিও নতুন বাজেটে সরকার সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি রাখতে চায়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি নানামুখী সংকটের কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া, ইসরাইল-ফিলিস্তিন এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের প্রভাব এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়েছে। দেশে ডলারের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এতে করে আমদানি খরচ বাড়ছে। ফলে বাড়ছে সবধরনের নিত্যপণ্যের দাম।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন নতুন বাজেটে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের প্রতিফলন ঘটবে। সাধারণ মানুষ যাতে স্বস্তি পায় সে বিষয়গুলোতে বাজেটে জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে আমদানিকৃত নিত্যপণ্যের দাম যাতে না বাড়ে সে বিষয়ে বাজেটে বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছে এনবিআর। এছাড়া এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোনোভাবেই যাতে নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম না বাড়ে সে বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কোটি পরিবারের হাতে সময়মতো টিসিবির পণ্য পৌঁছে দেওয়া, খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রম চালু রাখা, ডিলারদের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ১৫ টাকায় চাল বিক্রি কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি (কাবিখা) ও সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আরো বেশিসংখ্যক মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বাজেটে বিশেষ ঘোষণা থাকবে। নিম্ন আয়ের মানুষকে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য দিতে টিসিবির কার্যক্রম আরো বাড়ানো হতে পারে।

প্রতি বছর বাজেট ঘোষণার সময় অনেক উঁচু আশা পোষণ করা হয় কিন্তু আর্থিক বছর শেষে প্রত্যাশার অধিকাংশ অপূর্ণ থেকে যায় বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণে। অনেকের মতে সরকারের কিছু উপদেষ্টা, মন্ত্রী, সচিবদের ভুল পরামর্শে সরকারের সকল মন্ত্রণালয়ে কম বেশি দুর্নীতি হওয়ায় উন্নয়ন কাজের অযাচিত ব্যায় বৃদ্ধি হয়। দুর্নীতির রাঘব-বোয়ালরা থাকে দুর্নীতির বাইরে। দেশে এখন অন্তত ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষ হাজার কোটি টাকার মালিক। যাদের অধিকাংশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লোপাট করে বিদেশে পাচার করছে। দুর্নীতি দমন কমিশন মাঝেমধ্যে চুনাপুঁটিদের ধরলেও বড় বড় দুর্নীতিবাজরা আছে স্বচ্ছন্দে। একমাত্র জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতের অব্যবস্থাপনার কারণে লক্ষ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। অথচ দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ আইন নামের আড়ালে দোষীদের ইনডেমনিটি দেওয়া আছে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, সমাজসেবা, বাণিজ্য, বিদ্যুৎ জ্বালানি এমন কোন খাত নেই যেখানে দুর্নীতির কালো হাত সম্প্রসারিত হয়নি। বিদ্যমান অবস্থা কিন্তু দ্রুত সরকারের আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে। আশা করি সরকার অচিরেই ইতিমধ্যে ব্যর্থ প্রমাণিত একান্ত আমলা নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক পেশাদারদের কাজের স্বাধীনতা দিবে। স্বচ্ছতা এবং জনগণের কাছে দায় বদ্ধতা নিশ্চিত করে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করবে।

শেয়ার করুন