২০২৫ সালের ফরচুন ৫০০ কোম্পানি তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ও প্রভাবশালী কোম্পানিগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অভিবাসী উদ্যোক্তা বা তাদের সন্তানদের দ্বারা। ২০২৫ সালের তালিকায় প্রথমবার স্থান পাওয়া ১৪টি কোম্পানির মধ্যে ১০টিই ’নতুন আমেরিকান’ কোম্পানি অর্থাৎ, যেগুলোর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অভিবাসী বা অভিবাসীদের সন্তান। এই তথ্য যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের অর্থনৈতিক অবদানের এক শক্তিশালী প্রমাণ।এই তালিকাভুক্ত ৫০০টি বৃহত্তম মার্কিন কোম্পানির মধ্যে ২৩১টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অভিবাসী বা তাদের সন্তানদের দ্বারা। মোট কোম্পানির ৪৬ দশমিক ২ শতাংশই নতুন আমেরিকানদের হাত ধরে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ১০৯টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরাসরি অভিবাসীদের দ্বারা, এবং ১২২টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন অভিবাসীদের দ্বিতীয় প্রজন্ম। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, বরং আমেরিকার অর্থনীতি ও সমাজে অভিবাসীদের অবিচ্ছেদ্য ভূমিকার জীবন্ত দলিল।
২০২৫ সালের ফরচুন ৫০০ তালিকায় নতুনভাবে যুক্ত হওয়া ১৪টি কোম্পানির মধ্যে ১০টি০ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অভিবাসী বা তাদের সন্তানদের দ্বারা। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, খুচরা ব্যবসা এবং গণমাধ্যম খাতের নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো একসঙ্গে ২০২৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের রাজস্ব অর্জন করেছে, যা এককভাবে একটি দেশ হিসেবে গণ্য করলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতো। বর্তমানে কেবল যুক্তরাষ্ট্র ২৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং চীনের ১৮ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি এর চেয়ে বড়।
তালিকাভুক্ত নতুন আমেরিকান কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইনগ্রাম মাইক্রো হোল্ডিং, জিই ভারনোভা, ওস্কার হেলথ, সলভেনটাম, পালো অল্টো নেটওয়ার্কস, সিএসি ইনটারন্যাশনাল, এনডেভার গ্রুপ হোল্ডিংস, অ্যাস হার্ডওয়্যার এবং কোর অ্যান্ড মেইন। যদিও এই কোম্পানিগুলোর সব প্রতিষ্ঠাতার অভিবাসন পটভূমি বিস্তারিতভাবে জানা যায়নি, তথাপি এগুলোর অন্তত অর্ধেকেরই প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অভিবাসী। এই ২৩১টি কোম্পানি শুধু রাজস্বই নয়, কর্মসংস্থানেও বিশাল ভূমিকা রাখছে। প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বজুড়ে ১ কোটি ৫৪ লাখেরও বেশি মানুষকে কাজের সুযোগ দিয়েছে। নতুন আমেরিকান কোম্পানিগুলো যে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদার তা নয়, বরং তারা সামাজিক অগ্রগতিরও পথিকৃৎ।
উদাহরণস্বরূপ, প্রযুক্তি জগতের বিশাল নাম এনভিডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাইওয়ান থেকে আসা অভিবাসী জেনসেন হুয়াং-এর দ্বারা। তিনি শৈশবে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং পরে ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটি ও স্ট্যানফোর্ড থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। তার হাত ধরে এনভিডিয়া শুধুমাত্র গ্রাফিক্স প্রসেসর নির্মাতা নয়, বরং আজকের এআই, অটোনোমাস গাড়ি এবং হাই পারফরম্যান্স কম্পিউটিংয়ের অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বিশ্ববিখ্যাত জিন্স নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৫৩ সালে জার্মান অভিবাসী লেভি স্ট্রস। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ড রাশের সময় সান ফ্রান্সিসকোতে আসেন এবং শ্রমিকদের টেকসই পোশাকের চাহিদা দেখে ডেনিম ও রিভেট ব্যবহার করে কাজের পোশাক তৈরি শুরু করেন। আজ লেভিস একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং মার্কিন শিল্প ইতিহাসের প্রতীক। এছাড়াও, সিরিইউএস এক্সএম একটি নতুন তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান, যার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড মার্গোলিজ কানাডার টরন্টো থেকে আগত। তার উদ্ভাবনী চিন্তাধারার ভিত্তিতে স্যাটেলাইট রেডিওর যাত্রা শুরু হয়, যা আজ লক্ষ লক্ষ শ্রোতার প্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। অ্যাস হার্ডওয়্যার-এর জন্ম ১৯২৪ সালে শিকাগোর পাঁচজন খুচরা দোকানদারের উদ্যোগে। এদের মধ্যে রিচার্ড হেস এবং উইলিয়াম স্টাউবার ছিলেন অভিবাসী পিতার সন্তান। আজ অ্যাস বিশ্বের সবচেয়ে বড় হার্ডওয়্যার কো-অপারেটিভ হিসেবে পরিচিত।
একইভাবে, জেনারেল ইলেকট্রিক-এর প্রতিষ্ঠাতা থমাস এডিসনের পিতাও ছিলেন কানাডীয় অভিবাসী। এমন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা অভিবাসীদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, কঠোর পরিশ্রম এবং উদ্ভাবনী চিন্তার কারণে আজকের অবস্থানে এসেছে।তালিকায় উল্লেখযোগ্য নতুন সংযোজনগুলোর মধ্যে রয়েছে ইনগ্রাম মাইক্রো হোল্ডিং, জিই ভারনোভা, ওস্কার হেলথ, সলভেনটাম, পালো আল্টো নেটওয়ার্কস এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। এই কোম্পানিগুলো প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, প্রতিরক্ষা এবং খুচরা ব্যবসার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি নতুন আমেরিকান কোম্পানি গড়ে উঠেছে পেশাগত ও অন্যান্য পরিষেবা খাতে ৮০ শতাংশ, এরপর উৎপাদন খাত ৬৫.৬ শতাংশ এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাত ৫৭.৫ শতাংশ। অর্থাৎ, আমেরিকার উদ্ভাবনী খাতগুলোতে অভিবাসীদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি স্টেটে এই নতুন আমেরিকান কোম্পানিগুলোর ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এগুলো হলো: নিউ ইয়র্ক ৩৪টি কোম্পানি, ক্যালিফোর্নিয়া ৩০টি, টেক্সাস ২২টি, ইলিনয় ২০টি, ফ্লোরিডা ১৩টি এবং ভার্জিনিয়া ১৩টি। এই রাজ্যগুলো অভিবাসী উদ্যোক্তাদের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং সেখানে কোম্পানির সদর দফতর থাকার কারণে স্থানীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
এই নতুন আমেরিকান কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত রাজস্ব অনেক দেশের জাতীয় জিডিপির চেয়েও বেশি। যেমন: জার্মানি ৪.৭ ট্রিলিয়ন ডলার , ভারত ৪.২ ট্রিলিয়ন ডলার এবং জাপান ৪.১ ট্রিলিয়ন ডলার। এই তিন দেশের সম্মিলিত অর্থনীতির চেয়েও বেশি রাজস্ব এসেছে অভিবাসী প্রতিষ্ঠাতাদের কোম্পানিগুলো থেকে। ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট উদ্যোক্তাদের প্রায় ২৩.৬ শতাংশই অভিবাসী। আতিথেয়তা ও খাদ্য পরিষেবা খাতে এই সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর অর্থ, শুধু ছোটখাটো ব্যবসা নয়, বরং বড় করপোরেট স্তরেও অভিবাসীরা আমেরিকার অর্থনৈতিক গতি নির্ধারণ করছেন।
প্রতিবছর ফরচুন ৫০০ তালিকা প্রকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। এই নির্দেশক থেকে বোঝা যায় কোন কোম্পানিগুলো আমেরিকার ব্যবসা জগতকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছরই দেখা গেছে, এই তালিকায় কমপক্ষে ৪০ শতাংশ কোম্পানি ছিল অভিবাসী বা তাদের সন্তানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তবে ২০২৫ সালে এই হার সর্বোচ্চ ৪৬.২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা অভিবাসীদের অবদানের ব্যাপারে আরও জোরালো বার্তা দেয়।
এই প্রতিবেদন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমেরিকার ইতিহাস, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সবই অভিবাসীদের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল। এইসব নতুন আমেরিকান কোম্পানি শুধু ব্যবসা করছে না, বরং উদ্ভাবন, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ গঠনে অপরিসীম অবদান রাখছে।
এ যেন এক চলমান প্রমাণ যে, অভিবাসীদের স্বপ্ন আর পরিশ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট সাম্রাজ্য। অতএব, অভিবাসীদের অবদান শুধু তাদের নিজেদের বা তাদের পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা গোটা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করছে। আজ যখন বিশ্বজুড়ে অভিবাসন ও জাতীয় পরিচয়ের বিষয়ে নানা বিতর্ক চলছে, তখন এই তথ্যগুলো স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে নতুন আমেরিকানরা কেবল আমেরিকারই অংশ নন, তারা আমেরিকার ভবিষ্যৎ নির্মাতা।