জাতীয় জীবনের মতো আমার জীবনের জন্য আগস্ট মাস বিচ্ছেদ আর গভীর দুঃখের মাস। আগস্ট ১৫, ২০০৫ আমাকে রাজনৈতিক কারণে ভিকটিম করে চাকরিচ্যুত করা হয়। সেই থেকে ২০ বছর পেশাদার প্রকৌশলী হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, আফগানিস্তানসহ নানা দেশে চাকরি করেছি। বাংলাদেশের জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের কর্মকর্তাদের অস্ট্রেলিয়ায় প্রশিক্ষণ কাজে জড়িত থেকেছি।
আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম। কাছে থেকে দেখেছি মহান মুক্তিযুদ্ধ। আছে সামান্য অবদান। হারিয়েছি অনেক কাছের বন্ধু, আত্মীয় ও প্রিয়জনকে। ১৯৭৭ থেকে ২০০৫ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বুকে নিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছর পেশাদার প্রকৌশলী হিসেবে নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সততা এবং দেশপ্রেম নিয়ে দেশের গ্যাস-জ্বালানি সেক্টরে কাজ করেছি। দেশের অনেক মাইলফলক সৃষ্টিকারী গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে কখনো মুখ্য, কখনো সহায়ক ভূমিকা পালন করেছি। কখনো অন্যায়ের কাছে মাথানত করিনি। অথচ অশুভ জ্বালানি সিন্ডিকেটের সক্রিয়তায় বিএনপি-জামায়াত সরকার কোনো কারণ না দেখিয়ে ২৫ আগস্ট ২০০৫ আমাকে জিটিসিএলের পরিচালক (অপারেশন) হিসেবে চাকরিচ্যুত করে বাংলাদেশের হয়ে অবদান রাখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। আজ ২০ বছর প্রবাস জীবনে নানা দেশে পেশাদার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার পর এখন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হিসেবে অবসর জীবনযাপন করছি। কারো প্রতি ঘৃণা, ক্ষোভ বা বিদ্বেষ নেই। দুঃখ আছে গ্যাস সেক্টরের অব্যাহত উন্নয়নে অবদান রাখতে না পারায়। দুঃখ লাগে গ্যাস-জ্বালানি সেক্টর অযত্ন-অবহেলা আর দুর্নীতির কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোয়।
আমি বুয়েট থেকে কেমি প্রকৌশলী হিসেবে ১৯৭৭ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর কিছুদিন বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকে চাকরি করি। ১৯৭৮ সালের ৪ জুলাই যোগদান করি তৎকালীন গ্যাস সেক্টরের সেরা প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে। এ সময় গ্যাস সেক্টরে কাজ করা অধিকাংশ প্রকৌশলী সুযোগ থাকায় চাকরি ছেড়ে লিবিয়া, ইরাকে চলে যায়। আমারও সুযোগ হয়েছিল কুয়েত রিফাইনারিতে চাকরিতে যাওয়ার। কিন্তু পেট্রো ডলারের মোহ উপেক্ষা করে আমি দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নেই মূলত মুক্তিযুদ্ধে সংশ্লিষ্টতা এবং বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সক্রিয়তার কারণে। সেই থেকে ২৮ বছর তিতাস গ্যাস, বিজিএসএল, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস, জালালাবাদ গ্যাস এবং জিটিসিএলে নিজের সাধ্য, সামর্থ্য উজাড় করে কাজ করেছি। আমার সুযোগ হয়েছে নিম্ন বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনের।
তিতাস গ্যাস ১৯৭৮-১৯৮১ : টঙ্গী-সাভার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ, হবিগঞ্জ-আশুগঞ্জ গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ, ঢাকা মহানগরী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এলাকায় গ্যাস বিতরণ পাইপলাইন নির্মাণ।
বিজিএসএল : ১৯৮১-১৯৮৮ : সৌভাগ্য হয়েছিল দক্ষিণ পূর্ব বাংলাদেশের গ্যাস উৎপাদন, সঞ্চালন এবং বিতরণের জন্য সৃষ্ট ভার্টিকালি ইন্টিগ্রেটেড কোম্পানিতে ভোরের পাখি হিসেবে কাজ করার। এই সময়ে বাখরাবাদ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নির্মিত ২৪ ইঞ্চি বাসের ১৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন, চট্টগ্রাম রিং মেইন নির্মাণ কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে সিটি গেট স্টেশন নির্মাণকাজ সম্পাদনের পর আমার হাতের ছোঁয়ায় চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো গ্যাসের শিখা জ্বলে উঠেছিল। আমি তখন উপব্যবস্থাপক (সঞ্চালন) হিসেবে বিজিএসেলে সঞ্চালন বিভাগ গড়ে তুলছিলাম। চট্টগ্রামে ইনফেকসাস ডিজিজ হসপিটালে প্রথম গ্যাস সংযোগের সময় উপস্থিত ছিলাম। পরবর্তী সময়ে কুমিল্লা কার্যালয়ে উপব্যবস্থাপক (বিতরণ) হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ফেনী এবং চাঁদপুর এলাকায় গ্যাস বিতরণ অবকাঠামো নির্মাণকাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করি। দুটি শহরে প্রথম ১০০ গ্যাস সংযোগ আমি নিজে উপস্থিত থেকে প্রদান করেছি। পরবর্তী সময়ে আমাকে বাখরাবাদ-ডেমরা সঞ্চালন পাইপলাইন এবং ডেমরা সিটি গেট স্টেশন চালুর দায়িত্ব দেওয়া হলে দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পাদন করি। আমাদের একটি টিমকে গ্যাস সঞ্চালন বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য নেদারল্যান্ডস পাঠানো হয়। সেখানে থাকা অবস্থায় জানতে পারি, আমাকে সিলেট গ্যাসফিল্ডে প্রেষণে বদলি করা হয়েছে ১৯৮৮ সালে।
সিলেট গ্যাস ফিল্ড : ১৯৮৮-৮৯
সবার জানা ১৯৮৭ সালে সিলেট গ্যাসফিল্ডে সিলেট ৭ কূপ খননের সময় তেল আবিষ্কৃত হয়, সিলেট গ্যাসফিল্ডে ব্যবস্থাপক (উৎপাদন) হিসেবে কাজ করার সময় সৌভাগ্য হয় একমাত্র তেল কূপটি উৎপাদনের প্রথম বছর অপারেট করার। পাশাপাশি কৈলাশটিলা, ছাতক গ্যাসক্ষেত্র তখন উৎপাদনে ছিল। সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে আমি পেট্রোবাংলার পিআইইউয়ের সঙ্গে বিয়ানীবাজার, কৈলাশটিলা এবং রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের খননকাজে সমন্বয় করতাম। এ সময়ে সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ উপায়ে সিমিটার নামে একটি অখ্যাত কোম্পানিকে সিলেট এলাকায় তেল অনুসন্ধান এবং উন্নয়নের দায়িত্ব দেওয়ায় আমার ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করি। আমাকে জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানিতে বদলি করে তাৎক্ষণিক রিলিজ করা হয়। অথচ এ সময়ে আমরা গ্যাসক্ষেত্র ফ্রাঞ্চাইজ এলাকায় এডিবির আর্থিক সহায়তায় চারটি তেল অনুসন্ধান কূপখননের পরিকল্পনা করছিলাম।
জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি ১৯৮৯-৯০
কোম্পানিটি নোংরা আঞ্চলিকতার প্রভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল। কোম্পানির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে দিনদুপুরে শহরের রাস্তায় কোম্পানির উচ্ছৃঙ্খল কর্মচারীরা হেনস্তা করেছিল। এমনি একটি কোম্পানিতে শৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কারিগরিভাবে সক্ষম করতে সবার সঙ্গে এক বছর অনেক পরিশ্রম করি। সদর কার্যালয় শহর কেন্দ্র থেকে আখালিয়া স্থানান্তর করা হয়। আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে গ্যাস মিটারিং ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করে সিস্টেম লস কমানোর কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করি। ১৯৯০ শুরুতে বাখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রে উৎপাদন বিভ্রাটের কারণে সঞ্চালন লাইনে কনডেনসেট ঢুকে পড়ায় আমাকে বিজিএসেলে ফিরিয়ে আনা হয়।
বিজিএসএল দ্বিতীয় পর্ব ১৯৯০-১৯৯৪
শুরুতে দায়িত্ব ছিল উপমহাবাবস্থাপক হিসেবে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থেকে বাখরাবাদ-চট্টগ্রাম সঞ্চালন পাইপলাইন এবং চট্টগ্রাম রিং মেইন অনস্ট্রিম পিগ্গিং কাজ পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন সমন্বয় করা। কয়েকজন সাহসী সহকর্মীর নিবেদনে এ দুরূহ কাজ সম্পাদন ছিল আমাদের বিশাল অর্জন। অন্য তিন সহকর্মীর সঙ্গে আমাকে উপমহাব্যবস্থাপক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরিকল্পনা বিভাগ থেকে বিতরণ পরিকল্পনা, উপকরণ পরিকল্পনা এবং প্রকল্প পরিকল্পনায় আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত করি। নিজেরা ডিজাইন করে কাফকো সিএমএস, রাউজান বিদ্যুৎকেন্দ্র সিএমএস ফেব্রিকেট করি। এই কাজে অনুজ প্রকৌশলী সানোয়ার হোসেন চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
এ সময়ে চট্টগ্রাম এলাকায় কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গ্যাস চুরি শুরু হয়। আমাকে প্রধান করে একটি ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হলে প্রথম পরিদর্শনে দেড় ডজন শিল্পকারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করি। দুঃখের বিষয় কয়েকজন প্রকৌশলীর সম্পৃক্ততা দেখতে পাই, এ ঘটনার জেরে বিজিএসএল কর্মচারী ইউনিয়নে তাদের স্বার্থহানি ঘটে, কুমিল্লায় আমার কার্যালয়ে দুর্ব্যবহার করে। সবাই জানে বিতরণ ব্যবস্থায় দুর্বৃত্তায়ন সব সরকার সঠিক ভূমিকা নিতে অনীহা করায় গ্যাস চুরি ক্যানসারে পরিণত হয়েছে।
কুমিল্লায় অবস্থানকালে আবাসিক এলাকায় আমরা ক্রীড়া সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছিলাম। আমাদের একটি ভালো ফুটবল, ক্রিকেট দল ছিল, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস সাড়ম্বরে পালিত হতো। আমি এবং আমার পরিবারের কাছে বিজিএসএল স্মৃতি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
পেট্রোবাংলা এবং গ্যাস সেক্টরের প্রয়োজনে ১৯৯৪ জুলাই মাসে আমাকে নবগঠিত গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানিতে বদলি করা হয়। চলবে।