৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:৪০:৫৫ অপরাহ্ন


গুপ্ত মহাপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে এরা কারা
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-০৮-২০২৫
গুপ্ত মহাপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে এরা কারা প্রতীকী ছবি


ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ ফেব্রুয়ারিতে হবে কি-না তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার মাঝেই আবারও হোচট খেলো ভোটাধিকার প্রত্যাশী রাজনৈতিক দল ও জনগণ। এবার খোদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সংস্কার ও বিচার না করে নির্বাচন দেওয়া হলে পুরনো সমস্যা আবার ফিরে আসতে পারে। তার এই বক্তব্যের পাশাপাশি মাঠে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতিবাচক বক্তব্যও চলমান জল্পনা-কল্পনাকে আরও উসকে দিচ্ছে। এখনো প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে নির্বাচন কি হচ্ছে? 

কি বললেন প্রধান উপদেষ্টা

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সিএনএ টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন করতে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। নির্বাচনের আগে সংস্কার এবং ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তবে সংস্কার ও বিচার না করে নির্বাচন দেওয়া হলে পুরোনো সমস্যা আবার ফিরে আসতে পারে। 

নির্বাচন নিয়ে এর আগে সর্বশেষ ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীর উদ্দেশ্যে ৫ আগস্ট এক ভাষণ দিয়েছিলেন। এতে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠানো হবে, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করেন। তার এমন আশ্বস্ত করার পরপরাই সংস্কার ও বিচার না করে নির্বাচন দেওয়া হলে পুরোনো সমস্যা আবার ফিরে আসতে পারে বলে এমন বক্তব্যেকে অনেকে বাকা চোখে দেখছেন। আবার মাঠে যখন কারো কারো বক্তব্যেও একিই সুর পাওয়া যায়, তখন সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়।

সর্বশেষ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, দেশের অধিকাংশ মানুষ পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চায়। নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি চায়। প্রধান উপদেষ্টাকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, পিআর, সংস্কার এবং জুলাই সনদের আইনগত বিষয়ে গণভোট দিন। জনগণই এসবের সিদ্ধান্ত নেবে। এছাড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এই বলে যে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদানের আগে এবং পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলে, দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারকে দাবি পূরণে বাধ্য করা হবে।

এদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচন যত দ্রুত সম্ভব হওয়া উচিত। তবে সেটা অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন হতে হবে। নভেম্বর, ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে-যেকোনো সময় নির্বাচন হোক। কিন্তু পুরোনো নিয়মে না। জনগণের সামনে প্রকৃত অপশন থাকতে হবে। অন্যদিকে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ঘোষিত জুলাই ঘোষণাও অপূর্ণাঙ্গ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, ঘোষণাপত্রে সংস্কার করা সংবিধানের আলোকে নির্বাচনের কথা বলে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি পাশ কাটিয়ে গেছেন প্রধান উপদেষ্টা। অথচ দেশের মানুষ নতুন সংবিধান চায়। যখন মানুষ শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন চায়, তখনই নতুন সংবিধানের প্রয়োজন হয়। যদি টেবিলের আলোচনায় নতুন সংবিধান না হয়, আমরা রাজপথে নামতে দেরি করব না।

বিএনপি’র কণ্ঠে ষড়যন্ত্রের গন্ধ

এদিকে নির্বাচন নিয়ে যখন খোদ প্রধান উপদেষ্টা একধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ইমেজে গড়ে উঠা রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের দাবি-দাওয়া অনুযায়ী নির্বাচন না হলে, তা মেনে না নেয়ার কথা বলছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ তাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের উদার গণতান্ত্রিক দলের নেতারা আবারও সন্দেহের গন্ধ পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে অনেকে বলাবলি শুরু করছেন, প্রকাশ করছেন আশঙ্ক। সম্প্রতি নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত জাতির সংশয় আছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেছেন, নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। 

অন্যদিকে সংসদ নির্বাচন নিয়ে যারা শঙ্কা প্রকাশ করে তারা গণতন্ত্রের শত্রু। তারা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষের শক্তি নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, তারা হয়ত কোনো না কোনো কারণে নিজের কথাগুলোই ইনিয়ে-বিনিয়ে বলছেন; যাতে করে নির্বাচনকে বিলম্বিত করা যায় অথবা বানচাল করা যায় অথবা নির্বাচন অনুষ্ঠান না হোক সেটা চায়। অন্যদিক নির্বাচন নিয়ে কেউ ষড়যন্ত্র করলে বিএনপি নয়, জনগণ তাদের প্রতিহত করবে বলেন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। 

কোথায় রোডম্যাপ?

এদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগামী সপ্তাহে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে যাচ্ছে বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। এ বছরের ডিসেম্বরে তফসিল এবং আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভোটগ্রহণের লক্ষ্য রেখে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। রোডম্যাপ ঘোষণার কথা জানিয়ে গত ১৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আশা করছি-আগামী সপ্তাহে রোডম্যাপ ঘোষণা দিতে পারব। এতে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। কিন্তু কই সে-ই রোড ম্যাপ? এরিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এমন রোডম্যাপ দেওয়ার খবর জানা যায়নি। অন্যদিকে ৫ আগস্টের ভাষণে প্রধান উপদেষ্ট জানিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাব, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করেন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এসব দেখা যাচ্ছে না। তবে ইসির পক্ষ থেকে এব্যাপারে একটি আশ্বাস মিলেছে সে-ই এক সপ্তাতের মধ্যে। 

তাহলে হচ্ছে কি? কেউ কি গুপ্ত পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে? 

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে সক্রিয় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি একেবারে নিশ্চিত ছিল। কিন্তু এবার খোদ প্রধান উপদেষ্টা কেনো বলছেন, সংস্কার ও বিচার না করে নির্বাচন দেওয়া হলে পুরোনো সমস্যা আবার ফিরে আসতে পারে বলে নতুন মন্তব্য হাজির করেছেন- তখন আবারও নানান সন্দেহ দানা বাধছে। কারো কারো আশঙ্কা শেষ বিচারে নানা দাবি-দাওয়া আন্দোলন সংগ্রামের কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস হয়তোবা কুলকিনারাই পাবেন না। বা তিনি যাতে কূলকিনারা না পান তেমন পরিস্থিতিও তৈরি করা হতে পারে। আবার কারো কারো আশঙ্কা, যে যেভাবেই ব্যাখ্যা দিক না যেনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে দ্রুত পরিবেশ পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাপাারে আমেরিকার বাইডেন প্রশাসনের এক ধরনের নীতি কার্যকর ছিল। আর এখন ওই বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের আরেক নীতি দৃশ্যমান হতেও বেশি সময় লাগবে না বলে মনে করেন অনেকে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটা ফয়সালাও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করছে। 

এদিকে সম্প্রতি একটি ক্ষুদ্র ঘটনার পর অন্তর্বতী সরকারের ব্যাপারে অনেকের মধ্যে নতুন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। ঘটনাটি হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মারধরের শিকার হওয়ার পর গ্রেপ্তার রিকশাচালক আজিজুর রহমানের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর পাশাপাশি এই ধরনের একটি ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতিও অনেকের নজর কেড়েছে। সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, রিকশাচালক মো. আজিজুর রহমানকে কিসের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন হিসেবে একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা জানতে চেয়ে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে।

একই সঙ্গে ওই পুলিশ কর্মকর্তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যে কোনো অসংগতি রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা নিয়েছে ডিএমপি। একটি সূত্র জানায় শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোনো রাজনৈতিক সরকার না। সম্প্রতি তিনি এক সাক্ষাৎকারেও বলেছেন, নিজের নয়, জনগণের ইচ্ছায় সরকারপ্রধানের পদে বসেছি। তার এই মন্তব্যটিও জাতীয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বার্তা দেয় যে বাংলাদেশে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ হয়ে কাজ করছেন না বা করবেন না। এমন ইমেজ-ই তিনি প্রতিষ্ঠা করে যাবেন। কারো কারো মতে, ৩২ নন্বরের ওই ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারকে নাড়া দেওয়ার বিষয়টির পেছনে আরও অনেক রহস্য থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে কেউ কেউ মনে করেনা ড. ইউনুস কি এখন এটা প্রমাণে সক্রিয় হয়ে উঠবেন বা উঠছেন কি-না যে, একটি পরিচ্ছন্ন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে? তিনি কি এখন মনে করছেন যে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না করা গেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার শান্তিতে নোবেল পাওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবোধক হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না করা গেলে ড. ইউনুস তার শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর ইমেজ কি ধরে রাখতে পারবেন কি-না সে-ই বিষয়টি তার মাথায় এখন প্রচন্ডভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। শোনা যায়, বাংলাদেশে একটি পরিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর একটি প্রতিবেশি দেশের পাশাপাশি পশ্চিমাদের প্রচণ্ড চাপ আছে। চাপ আছে দেশে সবদলমতকে বিকশিত রাখার ব্যাপারে। আর সে-ই ধরনের চাপ থেকেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ফুল দিতে গিয়ে মারধরের শিকার সেই রিকশাচালকের জামিন পেয়েছে কি-না তা-ও অনেকের ভাবনার বিষয়। অন্যদিকে একটি সূত্র মনে করেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিষয় চাওড় হয়ে আছে যে, যেভাবেই হোক না কেনো ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হতে যাচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক মাঠে এটা ঠেকাতে পিআর, সংস্কার এবং জুলাই সনদের আইনগত বিষয়ে গণভোট দেওয়া কিংবা গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলে আসলে বিএনপি’র সেই বিজয় ঠেকিয়ে দিতে চান। তাই কেউ কেউ মনে জানুয়ারি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে বা তা আরও পিছিয়ে দিলে বিএনপি ও দলটির সাথে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেক্ষেত্রে সদ্য পতিত আওয়ামী লীগের পাশাপাশি পিআর, সংস্কার, জুলাই সনদের আইনগত বিষয়ে গণভোট দেওয়া কিংবা গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তোলে মাঠ ঘোলাকারীরাই লাভবান হবে। এখন প্রশ্ন এই দু’পক্ষ মিলে মিশে কি বিএনপিকে ঠেকাতে কোনো গুপ্ত কৌশল নিয়ে কাজ করছে। এমনও তো হতে পারে দীর্ঘ সতের বছর গোপনে পতিত আওয়ামী লীগের নুন খেয়ে তার দায় শোধ করতে মাঠে নির্বাচন বানচালে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে ওই দুই পক্ষ? এমনটাই এখন অনেকের ধারণা।

শেয়ার করুন