৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৪৪:০৮ অপরাহ্ন


ক্ষমতাবানদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়েছে : আনু মুহাম্মদ
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৮-২০২৫
ক্ষমতাবানদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়েছে : আনু মুহাম্মদ প্রফেসর আনু মুহাম্মদ


গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ১৫ বছরে মিথ্যা মামলা থেকে, সাধারণ জনগণ ও শ্রমিক মুক্তি পায়নি। কিন্তু ক্ষমতাবানদের মামলা দ্রুত নিস্পত্তি হয়েছে, যেমন-প্রধান উপদেষ্টার। তিনি আরো জানান, ‘গত এক বছরে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি, এখনো বিচার বিভাগের বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ‘উপর’ এর আদেশে হয়। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির আয়োজনে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর দায়িত্ব ও ভূমিকা পর্যালোচনা’ সভা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এসব কথা বলেন। 

আনু মুহাম্মদ আরো বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসের মাথায় আশু করণীয় হিসেবে জুলাই আহতদের চিকিৎসার আহ্বান জানিয়েছে। ইতোমধ্যে ২২ হাজার পরিবার বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। অথচ গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার খুব সহজেই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসইভাবেই আন্তঃমন্ত্রণালয় ও জুলাই আহতদের চিকিৎসা নিয়ে কার্যরত স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয় করে একটি সেল গঠন করেই জুলাই আহতদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে পারতো। 

আনু মুহাম্মদ মব সন্ত্রাসের কয়েকটি দিক ভাগ করে জানান, ‘এ মুহূর্তে মব সন্ত্রাস হচ্ছে কখনো পদ দখল করতে, জমি দখল করতে এবং কখনো মতাদর্শিকভাবে আধিপত্য ঘটাতে। এ বিষয়ে সরকারের কোনো সন্তোষজনক ভূমিকা দেখা যায়নি। আমরা একদলীয়, সামরিক শাসনসহ বহু সরকার পেরিয়ে এলেও ৭৪ এর বিশেষ ক্ষমতা আইন এখনো বাতিল হয়নি। হাসিনা সরকারের আমলের নির্বতনমূলক অনেক আইনই বাতিল হয়নি। ইসরায়েল থেকে হাসিনা আমলে ক্রয়কৃত নজরদারি যন্ত্র এর ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি আমরা জানি না। তিনি আরো জানান, গত এক বছরে ব্যাংক, রেমিট্যান্স এবং রিজার্ভে কিছু অগ্রগতি দেখলেও পাচারকৃত অর্থ ও খেলাপি ঋত উদ্ধার হয়নি। ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস এখনো সক্ষম, স্বাধীন ও কার্যকর হয়নি, বিধায় ডাটা ম্যানুপুলেশন, ডাটা ম্যানুফেকচারড এখনো চলমান। পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা গত ১৫ বছরে ঋতযুক্ত নানাবিধ প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ ও নিপীড়ন করেছে। এ প্রকল্পগুলো মুল্যায়নের পরিবর্তে গত এক বছরে বিদেশি ঋতনির্ভরশীল বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রকল্পের ধারা শক্তিশালী হচ্ছে। বিদেশি নির্ভর, আমদানি নির্ভর বিদ্যুৎ জ্বালানি মহাপরিকল্পনা ক্রয় এখনো বাতিল করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। কৃষিপণ্য ক্রয়ে সরকারি নীতিমালা পরিবর্তন, প্রকৃতিবান্ধব কৃষি কমিশন, শ্রমিকের জন্য প্রতিশ্রুতিমূলক ১৮ দফা ত্রিপক্ষীয় চুক্তির বাস্তবায়ন, এর কোনোটারই অগ্রগতি ঘটেনি বলে তিনি জানান।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ অবিলম্বে ঢাকা ও জেলার শিল্পকলাগুলোকে সেনাবাহিনীর আস্তানা হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘লিঙ্গীয়, জাতিগত, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এ চার বৈষম্য দূর না করে, অন্তর্বর্তী সরকার এ বৈষম্যগুলো বাড়িয়ে তুলছে, যা গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার বিপরীত। বিমানবন্দরে লাউঞ্জ ঠিকই হয়েছে, কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনে সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়নি। আমেরিকার সঙ্গে গোপন, নতজানুমূলক এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি জনগণের আড়ালে হয়েছে এবং সে চুক্তি না প্রকাশ করার শর্তে ‘নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ তারা করেছে। একইভাবে জুলাই ঘোষণাপত্রে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে, যা এ সরকারের অস্বচ্ছতা, স্ববিরোধিতা, জনগণের মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়ার লক্ষণকে প্রমাণ করে। তিনি মনে করেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে প্রশাসনিক, সাংগঠনিক সংস্কারের পাশাপাশি দায়িত্ব সহকারে অন্তর্বর্তী সরকারকে পক্ষপাতিত্বহীন হতে হবে এবং সুষ্ঠু সমন্বয় করতে হবে।

গত ৯ আগস্ট বিজয়নগরে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম মিলনায়তনে (পল্টন টাওয়ার) গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির আয়োজনে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর : দায়িত্ব ও ভূমিকা পর্যালোচনা’ শীর্ষক সভা আয়োজিত হয়েছে। সভায় সভাপ্রধান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের ভূমিকা পর্যালোচনা করেছেন লেখক ও গবেষক কল্লোল মোস্তফা। পাশাপাশি গত এক বছরের অর্থনৈতিক, সংস্কৃতি এবং জুলাই আহতদের চিকিৎসাসংক্রান্ত পর্যালোচনা ব্যাখ্যা করেছেন যথাক্রমে-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতু, চলচ্চিত্রনির্মাতা আকরাম খান এবং স্থপতি ফারহানা শারমিন ইমু। 

কল্লোল মোস্তফা বলেন, গণঅভ্যুত্থানের কোন লিখিত ইশতেহার না থাকলেও মিছিলে, সেøাগানে, বক্তৃতায়, দেয়াল লিখনে প্রত্যাশাগুলো ফুটে উঠেছিল। এসব দেয়াল লিখনের মধ্যে দিয়ে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণি ইত্যাদি সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তিনি পর্যালোচনায় দেখান, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের তালিকা তৈরি, আহতের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন; ছাত্র-জনতার ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের বিচার, বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন। কিন্তু বিভিন্ন দাবিতে আহতদের প্রায়ই রাস্তায় নামতে দেখা গিয়েছে। এছাড়াও সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে গণঅভ্যুত্থানের সময় চালানো হত্যাযজ্ঞের বিচারের উদ্যোগ নিলেও কোনো বিচার সম্পন্ন না হওয়া, বেশ কিছু সংস্কার কমিশন, টাস্কফোর্স গঠন হলেও স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী, গণমাধ্যম ইত্যাদি কমিশনের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা না হওয়া, পুলিশ ও জনপ্রশাসনকে ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত করার সংস্কার সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখা না যাওয়া, খেলাপি ঋত উদ্ধারের ব্যাপারে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিতে দেখা না যাওয়া, বিচারব্যবস্থায় ও জামিনপ্রাপ্তি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হওয়া, বিদেশি ঋতনির্ভর মেগাপ্রকল্প বহাল থাকা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির বিধি সংশোধন, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, শিক্ষার মান উন্নয়ন, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধিতে কোনো পরিবর্তন না আসা, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো তা বাস্তবায়িত না হওয়া, রামপাল, রূপপুর কিংবা আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন না করা, ভারতসহ হাসিনা আমলের স্বাক্ষরিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তিগুলো প্রকাশ ও পুনর্মূল্যায়নের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া, সীমান্তে হত্যা বন্ধ না হওয়া, ২ হাজারের বেশি মানুষকে ভারত বাংলাদেশে পুশ ইন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়া, মতপ্রকাশে সরকারের দিক থেকে সরাসরি বাধা দেওয়া না হলেও নাগরিকদের ওপর হাসিনার নজরদারি ঠিকই থাকা-এসব ক্ষেত্র তার পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। তিনি আরো বলেন, বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব অব্যাহত রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই জামিন পাওয়া না পাওয়ার ক্ষেত্রে আগের মতোই রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করছে। সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা দল এনসিপির প্রতি পক্ষপাতিত্বেরও অভিযোগ রয়েছে।

আকরাম খান বললেন, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা থাকলেও গত এক বছরে জনগণকে বিভেদ ও বিদ্বেষের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। একধরনের জোরপূর্বক ধারণা চাপিয়ে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ তৈরি করা হচ্ছে। প্রান্তিক মানুষের সংস্কৃতি প্রকাশের অন্যতম জায়গা মাজার ভাঙা হচ্ছে, আবার সে মাজার সংস্কৃতির অন্যতম অংশ কাওয়ালি চর্চার মতো প্রহসন করা হচ্ছে। একটি গোষ্ঠী বিটিভি এবং শিল্পকলাকে কুক্ষিগত করে রেখেছে, যেখানে সরকারি মদতে প্রোপাগান্ডামূলক কাজ চলছে কিন্তু স্বাধীন সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে না। বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অকার্যকর ও আমলা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। গত এক বছরে স্বাধীন ফিল্ম কমিশন গঠনের কে নো উদ্যোগ দেখা যায়নি। টেলিভিশনের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যবিষয়ক এক অলিখিত সেন্সরশিপ শুরু হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতি করুণ দশা থেকে এক বছরে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। শিল্পীদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়েছে, সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে ডিজিএফআইয়ের নজরদারি বেড়েছে। পাশাপাশি মব সন্ত্রাসের কারণে সাংস্কৃতিক জায়গায় সেলফ সেন্সরশিপ শুরু হয়েছে। জাতীয় সংগীত নিয়ে অহেতুক বিতর্ক হচ্ছে, ময়মনসিংহের নাটকের মঞ্চ ভেঙে ফেলা হচ্ছে, এসব নিয়ে সরকারের কোনো শক্তিশালী ভূমিকা যেমন নেই, তেমনি বাজেটেও সবচেয়ে কম অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সংস্কৃতি খাতে।

ফারহানা শারমিন ইমু বলেন, গত এক বছরে জুলাই আহতরা কখনোই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায়োরিটি লিস্টে আসতে পারিনি। এ দেশের জুলাই আহতদের ৯০ ভাগ নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী পরিবারের বলেই কি তারা প্রায়োরিটি লিস্টে আসতে পারেনি? ইমু আরো বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন-এমনকি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদফতর’ প্রত্যেকটি আলাদাভাবে তালিকা তৈরি করেছে। একাধিক তালিকা একদিকে তালিকাভুক্তির অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও হাওয়া হয়ে গিয়েছে, এভাবে আহতদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা বাড়িয়েছে। জুলাই আহতের চিকিৎসা লড়াইয়ের ময়দানে পরিণত হয়েছে।

মোশাহিদা সুলতানা, যে ইনফরমেশন সিস্টেম দিয়ে শ্রমিকদের তালিকাভুক্তি করে উন্নয়নের কাজে লাগানোর কথা, সে ইনফরমেশন সিস্টেম ব্যবহৃত হচ্ছে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে, শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করতে। আন্দোলন করলেই সে ইনফরমেশন সিস্টেমে শ্রমিকের বিরুদ্ধে তালিকাভুক্তি করা হয়, যাতে ওই শ্রমিক আর কাজ না পায়। মোশাহিদা আরো বলেন, ১১টি কমিশন হলেও অর্থ কমিশন হয়নি। কর্মসংসস্থান সংক্রান্ত কোনো নীতি প্রণয়ন হয়নি। চিনিকল চালুর জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে চিনিকল চালুর প্রস্তাব থাকলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় বিদেশি বিনিয়োগের ওপর যত আগ্রহী, ততটা ভর্তুকি দিয়ে এ চিনিকলগুলো চালু করতে আগ্রহী নয়।

মুক্ত আলোচনায় গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের মনির রহমান মমিন বলেন, গত এক বছরে ২০ হাজার গার্মেন্টস শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, কিন্তু সে মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সাবেক জেনারেল ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার জানান, ‘অন্তর্বর্তী সরকার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলনের দাবিদাওয়া মেনে নিলেও তা পূরণে কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না’ তিনি দ্রুত দাবি বাস্তবায়নে আহ্বান জানান।

শেয়ার করুন