৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:৩৮:৫৪ পূর্বাহ্ন


সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার পুনরাবৃত্তি
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৮-২০২৫
সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার পুনরাবৃত্তি ভাঙ্গা ঘরের সামনে এক সংখ্যালঘু নারী


সংখ্যালঘুদের জীবনমান, সহবস্থান, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তায় সরকার ও প্রশাসনের দ্রুত ও নিরপেক্ষ পদক্ষেপের অভাবে তাদের উপর সহিংসতার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। যা সংবিধানের মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রের মূলনীতির পরিপন্থী। চলতি বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন জুলাই-এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করে এসব মন্তব্য করা হয়। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।

এতে আরো অভিযোগ করা হয় ধর্ম অবমাননা এবং নানা অজুহাতে সনাতন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা বন্ধ হয়নি বরং মাইকিং করে জনবল সৃষ্টি করে ঘরবাড়ি ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। বিস্তারিত তথ্যে গণমাধ্যমসূত্র ও এমএসএফ’র সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী দেখানো হয় যে, জুলাই ২০২৫ মাসে বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ৮টি ঘটনা ঘটেছে। এ সকল ঘটনার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ২টি, হেনস্থা করার ১টি, প্রতিমা ভাংচুরের ২টি, জমি দখলের ঘটনা ১টি এবং ১ টি ঘটনায় কটূক্তির অভিযোগে কিশোরকে গ্রেফতারসহ ১৫টি বাড়িঘরে হামলা ও ভাংচুর করা হয়। অপরদিকে জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন কিশোরী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

১ জুলাই বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একটি পল্লীতে গভীর রাতে দুর্বৃত্তদের হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং ১৮ টি ছাগল লুট করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। 

৪ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তী পদোন্নতির সাক্ষাৎকার দিতে এলে উপাচার্যের দপ্তরে তাঁকে হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছে ইসলামী ছাত্রশিবির ও ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ।

২৬ জুলাই রংপুরের গঙ্গাচড়ায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটূক্তির অভিযোগে সনাতন ধর্মাবলম্বী এক কিশোরকে (১৭) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় উত্তেজিত লোকজন ২৬ জুলাই রাত এবং ২৭ জুলাই বিকালে ওই কিশোরের বাড়িসহ সনাতন সম্প্রদায়ের লোকজনের ১৫টি বসতঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে। গ্রেফতারকৃত কিশোরের বিরুদ্ধে পরে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ এবং দন্ডবিধির ২৯৫ ধারায় মামলা করে দুপুরে আদালতের মাধ্যমে সম্মিলিত শিশু পুনর্বাসনকেন্দ্রে পাঠানো হয়। এলাকায় এখনো সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। 

নাটোরের লালপুর উপজেলার হালুডাঙ্গা শ্রীশ্রী মহাশ্মশান কালীমন্দিরের একটি কালীপ্রতিমা ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। ২১ জুলাই সন্ধ্যার পর থেকে ২২ জুলাই ভোরের মধ্যে মন্দিরটিতে এ ঘটনা ঘটে।

১৬ জুলাই খাগড়াছড়িতে এক কিশোরীকে (১৪) সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। ঘটনাটি ২৭ জুন হলেও সামাজিক লজ্জা ও ভয়ভীতির কারণে মেয়েটি প্রথমে কিছু প্রকাশ করেনি। কিন্তু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ১২ জুলাই বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ওই কিশোরী। পুলিশ এ ঘটনায় অভিযুক্ত ৬ জনের মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের আরমান হোসেন (৩২), ইমন হোসেন (২৫), এনায়েত হোসেন (৩৫), সাদ্দাম হোসেন (৩২)। এই ঘটনায় অভিযুক্ত মো. সোহেল ইসলাম (২৩) ও মো. মুনির ইসলাম (২৯) পলাতক রয়েছেন। 

পুরো জুলাইয়ের রিপোর্টটি উপস্থাপন করে সারসংক্ষেপে বলা হয় যে, সারসংক্ষেপ এ মাসের সবচাইতে ট্র্যাজেডি, যা পুরো দেশকে শোকে স্তব্ধ করে দিয়েছে তা হলো ২০ জুলাই দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল ভবনে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান ভেঙে পড়ার ঘটনা। সরকারি হিসাব মতে এখন পর্যন্ত বিমান সেনা, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও কর্মচারিসহ ৩৫ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে বর্তমানেও প্রায় চল্লিশের অধিক চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এখন পর্যন্ত হাসপাতাল মর্গে অজ্ঞাত রয়েছেন ২ জন। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের সমন্বয়হীনতা ও ব্যর্থতা ছিল অগ্রহণযোগ্য। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হাসপাতালে উপস্থিতি বা দলগতভাবে আহতদের দেখতে যাওয়া ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ব্যহত করাও ছিল দুঃখজনক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দৃশ্যমান কোনো ভূমিকাই প্রথম দিন দেখা যায়নি, যা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আমরা আশা করবো, নাগরিকগণের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্র ও সরকার যে দায়বদ্ধ, সেই অঙ্গীকার থেকেই নিহত ও আহতদের পরিবারগুলোর প্রতি সবধরনের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার পাশাপাশি স্কুলটির শিক্ষার্থীরা যেন ট্রমা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে তার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে সরকার যথাযথ দায়িত্ব পালন করবেন। 

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পূর্ব ঘোষিত ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’র পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে সমাবেশ ঘিরে যে সহিংসতা ও প্রাণহানি ঘটেছে, তা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ও নিন্দনীয়। এনসিপির সমাবেশের আগেই আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের কর্মীরা রাস্তায় গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ইউএনওর গাড়ি ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে সমাবেশস্থলে ভাঙচুর চালায়। সমাবেশ শেষে এনসিপি নেতাদের ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় পুলিশ ও সেনাসদস্যদের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ বাঁধে। এ ঘটনায় মোট পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও ৮ জন। অন্যান্য আহত শতাধিক। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত পরিমান সেনা, বিডিআর ও পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতিতে যে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, তা কারো কাম্য হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল এবং রাষ্ট্র এ ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। সরকার স্বীকার করেছে তাদের কাছে গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল তবে এতবড় ঘটনা ঘটবে তা জানা ছিল না। সঠিক তথ্য না থাকার এই ব্যর্থতার দায় সরকার কিভাবে এড়িয়ে যাবে?

দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী জুলাই ২০২৫ সময়ে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানকালে গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশী হেফাজতে, নির্যাতনে ও ভয়ে পালাতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে রাজনেতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে অন্তদ্বন্দ্বকালীন সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা কমেনি, তেমনি বেড়েছে দুস্কৃতিকারীদের হাতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিহত হওয়ার ঘটনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনার পর সাবেক সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে আন্দোলন বিরোধী বলে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা ও গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, জুন মাসের একই ধারায় নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা যেমন; গণধর্ষণ, ধর্ষণ ও হত্যা, আত্মহত্যা, হত্যা, শিশু ও নারীদের প্রতি শারীরিক নির্যাতন বেড়েই চলেছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা তথা সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। এ মাসে কারা- হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে।

শেয়ার করুন