৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:৩৩:৪২ অপরাহ্ন


শুল্ক কমিয়ে কি বার্তা দিল আমেরিকা
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৮-২০২৫
শুল্ক কমিয়ে কি বার্তা দিল আমেরিকা ডোনাল্ড ট্রাম্প


মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছিলেন। এনিয়ে সারা দেশে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বলা চলে সবক্ষেত্রেই দেখা দেয়া চরম অস্থিরতা। বলা যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্নধার প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক ইমেজ ও সঙ্কট সমাধানে তার সক্ষমতা প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর মধ্য দিয়ে সেই অস্থিরতায় ছেদ পড়েছে। এ-নিয়ে দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের মধ্যে যেমন একটা স্বস্তিভাব দেখা দিয়েছে, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে সম্পৃক্তরাও আস্থা ফিরে পায়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ-টি আসলে কি ছিল? এটা কি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার একসময়ের যুদ্ধের নতুন সংস্করণ যা বাণিজ্য যুদ্ধ বলে ব্যাপক প্রচার পাচ্ছে। আর সেই যুদ্ধে কি বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী পার্টনার হতে পেরেছে? তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক শুল্ক বাড়িয়ে দিয়ে আবার চট করে একটি ‘গোপনা চুক্তি’র মাধ্যমে তা কমানোর মধ্য দিয়ে আমেরিকা আসলে কি বার্তা দিল? এমন জল্পনা-কল্পনা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের।

জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের ওপর নতুন করে যে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক নির্ধারণ করেছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক ভয়াবহ অস্থিরতা দেখা দেয়। অতীতের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের একটি পক্ষ সাফাই গাইতে থাকে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক নির্ধারণে বাংলাদেশের কিছুই হবে না। আরেক পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যা-র কিনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি বিশাল ইমেজ আছে তিনি কি পারবেন এই বাড়তি শুল্ক ঠেকাতে? একটি মহল প্রচার করতে থাকে তিনি আসলে পারছেন না বা পারবেন না..। কারণ আমেরকিার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে ড. ইউনূস সরকারের সম্পর্ক অতটা মধুর না। বলা যায় প্রধান উপদেষ্টাকে ব্যর্থ বলে গোপনে-প্রকাশ্যে সমালোচনা চলতে থাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে খবর প্রকাশি হয় যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩১ জুলাই বৃহস্পতিবার তা কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। শুল্ক নিয়ে হোয়াইট হাউসের এক ঘোষণায় এ তথ্য জানানো হয়।

এর প্রতিক্রিয়া কে কি বললেন..

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর শুল্ক হার কমে আসায় একে ঐতিহাসিক চুক্তি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের শুল্ক আলোচকদের আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘এটি সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য’। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখা গেছে ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা এব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশ হওয়াটা বিশাল এক স্বস্তির খবর। প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছাকাছি পাল্টা শুল্কের কারণে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব। কেউ কেউ ‘আমরা ভালো অবস্থানে আছি। আশা করছি, পাল্টা শুল্কের কারণে মার্কিন বাজারে চাহিদা কমলেও আমাদের রপ্তানি কমবে না। এর কারণ চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরবে। তবে বড় দাগে ব্যবসা নিতে হলে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারেরও কিছু সহযোগিতা লাগবে।’

ইতিবাচক ফলাফল শুরু..

ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশ হওয়াটা বিশাল এক স্বস্তিকর বলে জানিয়ে এর দেশের আর্থিক দিকগুলিই তুলে ধরেছেন। এতে বলা হচ্ছে প্রথম দফায় ৩৭ শতাংশ, পরের দফায় ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানায় রপ্তানি আদেশ স্থগিত, বাতিল কিংবা পণ্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। কিন্তু গত ১ আগস্ট শুক্রবার বাড়তি শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণের পর ক্রেতাদের কেউ কেউ আবার রপ্তানি আদেশ বহাল করেছেন।

কিন্তু আসল বার্তা কি...

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি বাজার, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের বড় রপ্তানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এরপরে শুল্ক কমানোর পরেও নানান সমালোচনা বা বিশ্লেষণ চলছে দেশ জুড়ে। সবপক্ষই তাদের উদ্বেগ উৎকন্ঠা বা সমালোচনা ছিল ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণের নেতিবাচক দিকটি নিয়ে। আবার এখন যখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে দিয়ে তাতে-ও নানান ধরনের চুলচেরা অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে পত্রিকার পাতা ভারী করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর বিষয়টিতে বৈশ্বিক রাজনৈতিক খেলা হয়ে গেছে তা কারো হিসাবে নেই। শুল্ক আরোপের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে আসলে একটি ভূ-রাজনৈতিক খেলা খেলছেন তা যেনো কারো মাথায় ঢুকছে না। প্রথমে বাণিজ্যে চড়া শুল্ক আরোপ করে আবার চট করে ৩৫ থেকে ১৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছেন। কিন্তু উপমহাদেশে বাংলাদেশ কে নিয়ে যে কি ভূ-রাজনৈতিক খেলা হয়ে গেলো এর ফাঁকে তা কিন্তু কারো যেনো বোধগম্য হচ্ছে না। 

কারো কারো মতে, এর মাধ্যমে আমেরিকা কার্যত বাংলাদেশকে দিয়ে আশে পাশের দেশগুলিকে টার্গেট করে একটি শক্ত বার্তা দিয়েছে । যা ধীরে ধীরে দ্রুতই পরিস্কার হয়ে যাবে। সে-ই বার্তায় যে বাংলাদেশের আশে পাশে থাকা দেশগুলির জন্য সামনের দিনে অনেক অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে তা-ও স্পস্ট হয়ে উঠবে তাড়াতাড়ি। আর সেক্ষেত্রে ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ বা মূলত যে আরেক ভূ-রাজনৈতিক খেলা তা স্পস্ট হয়ে উঠবে। আর এর পাশাপাশি বিশ্বের একক সুপারপাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে তার ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে রাজনীতিতে বাংলাদেশেকে আস্থায় নিয়েছে তা-ও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যে যুদ্ধে বাংলাদেশ সফলভাবে শরিক হতে পেরেছে বা বাংলাদেশ এখন শক্ত অবস্থান রয়েছে-এমন বার্তাও আছে এতে। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক চট করে শুল্ক কমানোর মধ্য দিয়ে আমেরিকা আসলে এমনই বার্তা দিয়েছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। তারা মনে করেন, এটা স্রেফ একটি বাণিজ্য চুক্তি না...। এর পেছনে রয়েছে সম্পূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু। তাদের মতে, শুল্ক বসানো আবার তা কমিয়ে নেয়া খেলা আসলে আমেরিকার নয়া ভূ-রাজনৈতিক খেলা।

যেই খেলায় বিশ্বের একক সুপারপাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শক্ত সমর্থক এ পরিণত করা হলো বাংলাদেশকে। শুল্ক কৌশল দিয়ে বাংলাদেশকে যে সাথে পেয়েছে এটাই মূলত একটি বার্তা। কূটনীতিকদের মতে, অতীতে সন্ত্রাসবাদের সাথে যুদ্ধে শরিক করে অনেক দেশকে পাশে পেয়ে পরবর্তীতে ওই দেশগুলি অনেক ধরনের সামরিক সহায়তা দিয়েছে আমেরিকা। আর এবার কি তাহলে বাণিজ্য যুদ্ধে অন্যদেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশকে সঙ্গী পেয়ে এমন বার্তাই দেয়া হচ্ছে কি-না, যে ভূ-রাজনৈতিক খেলার অন্যতম শক্ত ঘাটি বাংলাদেশ? 

তাই কারো কারো মতে, ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে যে একটি বড় শরিকের পরিণত হয়েছে কি-না সে বার্তা রয়েছে চট করে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর মধ্য দিয়ে। অনেকের বিশ্লেষণেও এসেছে যে, শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ এবং ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। কেননা সম্প্রতি দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক বেশ কয়েকটি ইস্যুতে আরও কিছুটা খারাপ হয়েছে, এটা এখনো চলমান। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক আরও তলানিতে চলে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। সেক্ষেত্রে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল জোট বলে পরিচিত কোয়াড ছাড়তে পারে নয়াদিল্লি-এমন আশঙ্কা আমেরিকানদের মধ্যে আছে। 

আবার কারো কারো মতে, শুল্ক আরোপ কৌশলিটি আমেরিকার এতোই ভূ-রাজনৈতিক যে, দেশটি এমন বাণিজ্য যুদ্ধ দিয়ে ভিয়েতনামকে চীনের বিকল্প সরবরাহ চেইন হিসেবে দাঁড় করাতে চাচ্ছে। সেদিক থেকে বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের প্রেক্ষাপটে বিশ্বের একক সুপারপাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপমহাদেশে ক্ষুদ্র এই বাংলাদেশকে একটি বড়ো ফ্যাক্টর হিসাবে ধরে নিয়ে এগুচ্ছে কি-না তা সময় বলে দেবে।

শেয়ার করুন