৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:৩২:০৫ পূর্বাহ্ন


৫ না ১২ ফেব্রুয়ারি- জানাবেন প্রধান উপদেষ্টা
যে কোনো মুহূর্তে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৭-২০২৫
যে কোনো মুহূর্তে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস


প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে লন্ডনে তারেক রহমানের বৈঠকের পর থেকে দেশের রাজনীতিতে অন্যরকম এক আবহ বইতে শুরু করে। বিএনপি বিষয়টি পজেটিভ ধরে নিয়ে যেসকল দাবি- দাওয়া নিয়ে সোচ্চার ছিল, সেটাতে নীরবতায় চলে গেছে। তবে সরব হয়ে উঠেছে ইসলামী ব্যানারের কতিপয় রাজনৈতিক দল। এরা কখনো এক জোট, কখনো আলাদা। কখনো সংস্কার শেষে নির্বাচন। কখনো পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন মেনে নেওয়া হবে না-জাতীয় রাজনীতির বক্তব্য মাঠ গরম করে ফেলার প্রাণন্ত চেষ্টা করতে দেখা গেছে। 

এর বাইরেও নির্বাচনী প্রচারণাও চালাচ্ছেন এদের কেউ কেউ। কারণ এসব ইসলাম নামধারী রাজনৈতিক দলের ব্যানারে থাকা দল বহু আগেই কে কোথায় নির্বাচন করবেন সেটা নির্ধারিত করে রেখেছেন। এদের প্রার্থিতার ফাইনাল ঘোষণা হবে ইসির তফসিল ঘোষণার পর। এতে করে প্রচারণা থেমে নেই ওইসব সম্ভাব্য প্রার্থীর। দীর্ঘদিন যাবৎই প্রচারণায়। 

এদের হঠাৎ আবিষ্কার পিআর পদ্ধতি নিয়েও ছিল ব্যাপক উত্তাপ। বর্তমানে সেটাও থেমে গেছে। কারণ এ ব্যাপারে সংবিধানে কোনো কিছুই উল্লেখ নেই। সংবিধানে পিআর আনতে হলে সংসদে পাস হতে হবে। আর এবার সংস্কার কার্যক্রমে এ পদ্ধতি নিয়ে আসতে হলে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য হতে হবে। কিন্তু বিএনপি তো পিআর ইস্যুটাকে অন্যরকম বিশ্লেষণ কষে সেটা একরকম ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসনের ‘ফাঁদ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং এতে মোটেও রাজি নন বলে জানিয়ে দেওয়ার পর থেকে এ প্রক্রিয়া স্তিমিত হতে শুরু করে। 

এমন এক গুমট পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত চলছিল নির্বাচন কী আদৌ হবে এমন এক প্রোপাগান্ডা? সেটাও কেউ কেউ বলছেন এটাও পতিত সরকারের সমর্থিত কতিপয় সুশীল নামধারীর উর্বর মস্তিকের কারসাজি! সেটাও এখন আর হালে পানি পাচ্ছে না। যদিও প্রচারণাটা থেমেও নেই। 

ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন চার-পাঁচদিনের মধ্যে ক্রয়োদশ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দেবেন বলে একটা মাধ্যমে ফোকাস করেছেন। সে চার-পাঁচদিনও শেষ হতে চললো। তার সে কথা অনুসারে এ সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বা তার আগ বা পরে ঘোষণা দিতে পারেন প্রধান উপদেষ্টা, হয়তো জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে। 

গত ২৬ জুলাই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ১৪টি রাজনৈতিক দলের বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের ওই তথ্য জানান দেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার। 

তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ক্যাটাগরিক্যালি (সুস্পষ্টভাবে) বলেছেন তিনি আগামী চার-পাঁচদিনের মধ্যে নির্বাচনের সময়সীমা, তারিখ ঘোষণা করবেন। আলোচনার সবচেয়ে ফলপ্রসূ বিষয় হচ্ছে এটা। দেশে যে অরাজকতা, তার একমাত্র সমাধানের পথ নির্বাচন এটা সরকার বুঝতে পেরেছে।’ জাতীয় পার্টির এই নেতা বলেন, এর (নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা) চেয়ে আনন্দের বার্তা আর কিছু হতে পারে না। নৈরাজ্যের সমাধান করবে নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।

বৈঠক শেষে বাংলাদেশ লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টাকে তিনি বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের প্রধান সমস্যা আইনশৃঙ্খলার অবনতি আর কোন অভিযান চালালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে?

এর আগে দুই দফায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। এরপর বিকালে আরো ১৪টি দল-জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে আগেই ফেব্রুয়ারির একটা দিনক্ষণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান দেওয়া হয়। কিন্তু সম্ভাব্য সে তারিখটা কবে সেটা নিশ্চিত হয়নি এখনো। এসব প্রেক্ষাপটে যেটা ঠাহর করা যায় ফেব্রুয়ারির ৫ অথবা ১২ তারিখ এ দুটি দিনই বৃহস্পতিবার এবং দিনক্ষণ ঘোষণা দিলে এ তারিখই উল্লেখ করতে পারেন তিনি। এর বাইরে আরো একটা বৃহস্পতিবার রয়েছে সেটা ১৯। তবে যেহেতু পবিত্র মাহে রমজান মাস ঘনিয়ে আসছে তাই অতদূর হয়তো আর টেনে নেওয়া হবে না। 

এদিকে হঠাৎ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার কথা কেন জানান দিলেন প্রধান উপদেষ্টা এর সুস্পষ্ট কোনো কারণ না থাকলেও হয়তো তিনি একটি সময়কে ভীষণ গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেটা হলো গত বছরের ২৯ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট। কারণ গত বছর এ সময়টা ভীষণ টালমাটাল ছিল বাংলাদেশের পরিস্থিতি। ছাত্র জনতার আন্দোলন স্তিমিত করতে সব কার্যক্রম তিনি হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত কাজ হয়নি। এ সময়ের মধ্যেই শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পালিয়েও গিয়েছিল। ছাত্র-জনতার রোষানলে পড়ে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পালিয়ে যাওয়ার এমন সময়কেই বেছে নিয়েছেন হয়তো প্রধান উপদেষ্টা। বাংলাদেশের ইতিহাসে, স্বৈরাচারমুক্ত হতে এবং আন্দোলনের শহীদ হওয়াদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই প্রধান উপদেষ্টা যে গণতন্ত্রহীনতার জন্য স্বৈরাচারের উত্থান ও সাধারণ মানুষের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সে সময়ই মানুষের প্রাণের দাবি, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফেরানোর ঘোষণা দিয়ে এ জুলাইকে তিনি স্মরণীয় করে রাখতে চান। 

যদি ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হয়, তাহলে মাঝে এখনো ৬ মাস বাকি। এ সময়ে তিন মাস আগে তফসিল ঘোষণা হলে তারও আগে এখনো তিন মাস বাকি।

এতো আগে দিনক্ষণ ঘোষণার অরো একটা কারণ হয়তো থাকতে পারে, সেটা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি। ইতোমধ্যে বিভিন্নস্থানে কার্যক্রম সাময়িক নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টারত। তাদের লক্ষ্য একটাই যাতে দেশে কোনো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে না পারে এবং দেশে একটা অরাজকতা তৈরি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অকার্যকর করে দেখানো ও ব্যর্থতার দায় দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত দিয়ে সেখানে নতুন কোনো প্রশাসন বসানো। 

প্রধান উপদেষ্টার এক বক্তব্য এমন কিছুর ইঙ্গিতও মিলেছে। 

গত ২৬ জুলাই এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, পতিত শক্তি গন্ডগোল লাগিয়ে নির্বাচনের আয়োজনকে ভণ্ডুল করার চেষ্টা করছে। এ অপচেষ্টাকে প্রতিহত করতে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ‘অভ্যুত্থানের সব শক্তি মিলে একটি সুন্দর নির্বাচন করতে না পারলে এই মস্তবড় সুযোগ আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে’, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মতবিনিময়কালে প্রধান উপদেষ্টা এ কথাগুলো বলেন।

তিনি বলেন, পরাজিত শক্তি যখনই সুযোগ পাচ্ছে তখনই নানারকম গন্ডগোল সৃষ্টি করছে। এসব করে তারা দেশের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। ‘যখনই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি, তখনই নানা ষড়যন্ত্র সামনে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কোনো ষড়যন্ত্র করেই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। কারণ ফ্যাসিবাদ প্রশ্নে সবগুলো গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য স্পষ্ট’, বলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই সঙ্গে ওই অনুষ্ঠানে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তিনি। উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও প্রধান উপদেষ্টাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে ২১ জুলাই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতির বিষয়ে এক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর এই তিন মাসে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।’ তিনি জানান, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় জোরদারের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া নির্বাচনের সময় ৬০ হাজার সেনাসদস্য মোতায়েন থাকবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সবশেষ

দেশে এখন নানা জটিলতা বিরাজ করছে। তবে এর বড় সমাধান নির্বাচন। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা মাত্রই রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে নির্বাচনী হিসাবনিকাশ। প্রচার-প্রচারণা। প্রার্থিতা প্রাপ্তি ও হারানো। ফলে সবাই ওই একমুখী হলে ফাঁকে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢেলে সাজিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠুর নিমিত্তে সাজিয়ে ফেলতেও পারেন। যা প্রকারান্তে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের পথ তৈরিতে সহায়ক হবে বৈকি!

শেয়ার করুন