৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৭:১৬:৩৩ পূর্বাহ্ন


দেশকে হামিন আহমেদ
মানুষ এখনো পিওর মিউজিক চায়
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৭-২০২৫
মানুষ এখনো পিওর মিউজিক চায় হামিন আহমেদ


হামিন আহমেদ। বাংলাদেশের ব্যান্ডসঙ্গীতের অন্যতম পথিকৃত। জনপ্রিয় ব্যান্ড দল মাইলসের দলনেতা। বর্তমানে বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন (বামবা)-র সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। গত ১৭ জুলাই প্রকাশ হয়েছে তার নতুন গান ‘খুঁজি তোমায়’। গানটির কথা লিখার পাশাপাশি সুর করেছেন ওয়ারফেজের পলাশ নূর। এ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির 

প্রশ্ন: আপনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যান্ডসংগীতের সঙ্গে যুক্ত। এত অভিজ্ঞতার পরও ‘খুঁজি তোমায়’-এর মতো নতুন প্রজেক্টে যুক্ত হওয়া আপনার কাছে কতটা চ্যালেঞ্জিং বা অর্থবহ মনে হয়েছে?

হামিন আহমেদ: আমার কাছে গান করা মানেই নতুন একটা জার্নি শুরু করা। আমি কখনো কাজকে ক্লান্তিকর মনে করি না। বরং যখন দেখি নতুন প্রজন্ম কিংবা সমসাময়িক শিল্পীদের সঙ্গে কোলাবোরেশন হচ্ছে-তখন এটা খুবই আশাব্যঞ্জক লাগে। ‘খুঁজি তোমায়’ গানটা শুনেই মনে হয়েছিল, এখানে গভীর একটা আবেগ আছে। ওয়ারফেজের পলাশ খুব আন্তরিকভাবে লিখেছে ও সুর করেছে। গানটায় একটা স্পিরিচুয়াল ফিল আছে, যা আমি নিজে অনুভব করতে পেরেছি। তাই এটাকে আমি চ্যালেঞ্জ না বলে একধরনের মিউজিক্যাল আত্মসম্পর্ক বলব।

প্রশ্ন: বর্তমান সময়ে যখন গান মূলত সোশ্যাল মিডিয়া ঘিরে ট্রেন্ড-ভিত্তিক হয়ে উঠেছে, তখন আপনি এমন একটি সিরিয়াস ও মেলোডিক গান বেছে নিলেন। এর পেছনে আপনার ভাবনা কী?

হামিন আহমেদ: আমরা একটা সময় পার করছি যেখানে গান অনেক সময় ভিজ্যুয়াল বা গিমিক নির্ভর হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, গান প্রথমত ‘শোনা’র জন্য-মিউজিক একটা শ্রুতিধর্মী শিল্প। আমি চাই মানুষ চোখ বন্ধ করে গান শুনুক, গানের কথা বুঝুক, সুরের আবহে ডুবে যাক। ‘খুঁজি তোমায়’ এমনই একটা গান-যেটা ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজানোর জন্য না, বরং মন দিয়ে শোনার জন্য তৈরি। এই ধরনের গান হয়তো ভিউ-ভিত্তিক ট্রেন্ডে না চলে, কিন্তু যারা মিউজিক ভালোবাসে, তাদের কাছে এটা ধনরত্ন হয়ে থাকবে।

প্রশ্ন: এটা কি ব্যান্ড কোলাবোরেশন নাকি আলাদা শিল্পীদের কাজ?

হামিন আহমেদ: গানটি একধরনের ব্যান্ড মেম্বারদের কোলাবোরেশন। পলাশ (ওয়ারফেজ) আমার খুব কাছের বন্ধু। ওর লেখা ও সুর আমার খুব ভালো লেগেছে। তারপর রুটনোট প্রোডাকশনের ইমরান আসিফ, যিনি আমাদের দুজনেরই ঘনিষ্ঠ, সে উদ্যোগটা নেয়। পলাশের রিকোয়েস্টে আমি গানটির সঙ্গে যুক্ত হই। ভয়েস দিই, গিটার বাজাই। পরে তূর্য (মাইলসের ড্রামার) যুক্ত হয়। গাজী শুভ্র ভিডিও ডিরেকশন করেছেন। আমরা সবাই চেয়েছিলাম যেন কাজটা পিওর থাকে-এই সময়ের ট্র্রেন্ডের বাইরে গিয়ে একটা নিখুঁত মিউজিকাল কাজ দাঁড় করানো যায়।

প্রশ্ন: তূর্যর ড্রামিং কেমন হলো?

হামিন আহমেদ: তূর্যর ড্রামিং আসলে খুব শর্ট নোটিশে করা। আমি তাকে বলি, ‘তুই একটা ট্র্যাক দিয়ে দে।’ ও কোনো ঝামেলা না করে বাজিয়ে দেয়। সেই অংশটাই গানটাকে ডাইনামিক করেছে। ব্যান্ডের স্পিরিটটা এখানেই-হুট করেও যখন কিছু করতে হয়, সবাই নিজেকে উজাড় করে দেয়।

প্রশ্ন: মানুষ কি এখনো ব্যান্ড বা পিওর মিউজিক শুনতে চায়?

হামিন আহমেদ: অবশ্যই চায়। সোশ্যাল মিডিয়ার এই শোরগোলের মধ্যেও শ্রোতাদের একটা বড় অংশ এখনো পিওর মিউজিক খোঁজে-যেখানে কথা, সুর, কম্পোজিশন সবকিছু মিলিয়ে একটা গভীরতা থাকে।

এই জন্যই এমন কোলাবোরেশন গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ বেছে বেছে ভালো কিছু শোনে। তারা রিয়েল ট্যালেন্ট বুঝতে পারে।

প্রশ্ন: গানটির রেকর্ডিং ও ভিডিও শুটিং প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল?

হামিন আহমেদ: ভয়েস রেকর্ডিং মার্চ-এপ্রিলে, আর ভিডিও শুট হয়েছে এপ্রিলের শেষ দিকে। আমি আর তূর্য একসঙ্গে শুট করেছি। পলাশ তখন ব্যস্ত ছিল, আমরা যখন যুক্তরাষ্ট্রে ট্যুরে যাই, সে তখন নিজের অংশের শুটিং করে। তবে ভিডিও দেখে কেউ বুঝবে না যে আমরা একসঙ্গে শুট করিনি। ভিডিওর প্রোডাকশন কোয়ালিটি ও সম্পাদনা এতটাই ভালো ছিল।

প্রশ্ন: রুটনোট প্রোডাকশনের এটি প্রথম কাজ-আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

হামিন আহমেদ: রুটনোট চাইছে এক্সক্লুসিভ কিছু করতে, যেটা বাজারে সাধারণভাবে দেখা যায় না। আমি বলব, এই ধরনের ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ মিউজিক দরকার এখন। মানুষের আগ্রহ ফেরাতে হলে অন্যরকম কিছু করতে হবে। আর সেটা রুটনোট বেশ ভালোভাবেই শুরু করেছে।

প্রশ্ন: মাইলসের ব্যস্ততা কেমন? নতুন গান বা অ্যালবামের ভাবনা আছে কি?

হামিন আহমেদ: গত ১০ বছরে আমরা গান রিলিজ করিনি। এটা শিল্পী হিসেবে আমাদের জন্য খুবই হতাশার। কারণ আমাদের গান বানানোর স্পিরিট এখনও রয়েছে। কিন্তু ইনসেনটিভ নেই, প্রফেশনাল কাঠামো নেই। তবুও আমরা নতুন কিছু গান তৈরি করেছি। সামনে সময় ও সুযোগ হলে এগুলো অ্যালবাম আকারে প্রকাশ করব। এখন আমরা দেশীয় কনসার্ট করছি, অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি, এরপর ২০২৬ সালের এপ্রিলে কানাডা ট্যুর।

প্রশ্ন: বামবার সভাপতি হিসেবে দেশের ব্যান্ডসংগীতের পরিস্থিতি নিয়ে আপনি কী ভাবছেন?

হামিন আহমেদ: দেখুন, মিউজিক এখন টিকে আছে মূলত ব্যান্ডগুলোর স্পিরিটে। কিন্তু নানা জায়গায় কনসার্ট বন্ধ হচ্ছে, প্রশাসনিক সহযোগিতার অভাব রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি অ্যাশেজ ব্যান্ডের কনসার্ট আটকে দেওয়া হয়েছে-এই ধরনের ঘটনা আগে দেখিনি। মিউজিককে যদি সাংস্কৃতিক উন্নয়নের অংশ না হিসেবে দেখা হয়, তাহলে ভবিষ্যতটা সংকটে পড়বে।

বামবা পর্যবেক্ষণ করছে। সময়মতো আমরা অবস্থান জানাব।

প্রশ্ন: বিদেশি শিল্পীদের জন্য বাজেট আছে, কিন্তু দেশি ব্যান্ডের জন্য থাকে না-আপনার মন্তব্য?

হামিন আহমেদ: আমরা যখন দেখি কোল্ডপ্লে বা এড শিরানের মতো শিল্পী আসার জন্য বাজেট তৈরি হয়, তখন ভালো লাগে। কিন্তু সমস্যা হয়, যখন দেশি ব্যান্ডদের জন্য বাজেট থাকে না। আমরা মাইলস নিয়ে শো করতে চাই, স্টেডিয়াম ভরে যায়, অথচ আয়োজকরা বাজেট নিয়ে পিছিয়ে যায়। এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। নিজের সংস্কৃতিকে মর্যাদা দিতে হবে। বামবা এ বিষয়ে চেষ্টা করছে, সরকারের সহযোগিতা পেলে আরও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে কখনো মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ছিল না-আপনার মতে, কেন?

হামিন আহমেদ: আমরা আসলে কখনোই প্রফেশনাল মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে পারিনি। একসময় পাটুয়াটুলী নির্ভর কিছু প্রতিষ্ঠান গানের অ্যালবাম প্রকাশ করত, কিন্তু শিল্পী, কপিরাইট, প্রডাকশন-এসব বিষয়ে কোনো নিয়মনীতি ছিল না। পরবর্তীতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এলেও এখানেও প্রফেশনাল কাঠামো তৈরি হয়নি। ফলে ব্যক্তিগত চেষ্টা হয়, কিন্তু একটা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠেনি।

প্রশ্ন: আপনি ভবিষ্যতে ব্যান্ডসংগীতকে কোন জায়গায় দেখতে চান?

হামিন আহমেদ: আমি চাই, আমাদের ব্যান্ডসংগীত আবার ফিরে যাক তার গৌরবময় অতীতে। এর জন্য আমাদের গঠনমূলক সমর্থন দিতে হবে, প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। নতুন প্রজন্ম খুব মেধাবী। তারা যদি সঠিক দিকনির্দেশনা পায়, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমরা ব্যান্ডমিউজিক নিয়ে গর্ব করতে পারব।

শেয়ার করুন