নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর ক্যাথি হোচুল সম্প্রতি রিপাবলিকানদের ‘বিগ আগলি বিল’ নামে নতুন আইনটির বিরুদ্ধে সতর্কতা জারি করেছেন করেছেন। এই আইনটি প্রায় ২০ লাখ নিউইয়র্কবাসীর মেডিকেইড এবং ৩ লাখ পরিবারের স্ন্যাপ (খাদ্য সহায়তা) সুবিধা হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই আইনটি স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্যসুবিধা ও অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা প্রোগ্রামে ব্যাপক কাটছাঁটের মাধ্যমে নিউইয়র্কের লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রাকে সংকটে ফেলে দেবে। গভর্নর হোচুল বলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, কোনো রাজ্যই এই আইনের নেতিবাচক প্রভাব পুরোপুরি মুছে দিতে পারবে না। আমি আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে কাজ করছি, যাতে নিউইয়র্কবাসীকে যতটা সম্ভব রক্ষা করা যায়, কারণ আপনার পরিবারই আমার লড়াই।
এই নতুন আইনটির ফলে মেডিকেইড এবং এসএনটিয়াল প্ল্যান (ইপি)-এর মতো স্বাস্থ্যসেবা প্রোগ্রামে ব্যাপক সংকোচন ঘটবে। প্রায় ২০ লাখের বেশি নিউইয়র্কবাসী তাদের স্বাস্থ্যবীমা হারাতে পারেন। এর মধ্যে প্রায় ৭ লাখ ৩০ হাজার আইনগতভাবে অবস্থানরত অভিবাসী এসএনটিয়াল প্ল্যানের আওতায় থাকলেও বীমাহীন হয়ে পড়বেন। এছাড়া প্রায় ১৩ লাখ মানুষ মেডিকেইড থেকে বাদ পড়বেন নতুন যোগ্যতা ও যাচাই প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে। এর ফলে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বীমাহীন হয়ে পড়বে এবং হাসপাতাল ও চিকিৎসা প্রদানকারীদের জন্য অপ্রতিফলিত চিকিৎসা ব্যয় বছরে ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হবে।
গ্রেটার নিউইয়র্ক হসপিটাল অ্যাসোসিয়েশন এবং হেলথ কেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব নিউইয়র্ক স্টেট)-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, স্টেটের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে বছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি কাটা পড়বে। এর ফলে মাতৃত্বকালীন যত্ন, মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা পরিষেবাগুলো কমে যেতে পারে। এমনকি কিছু হাসপাতাল আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এই প্রভাব আরো গভীর হবে। কারণ আইন অনুযায়ী পাঁচ বছরে গড়ে ১০ বিলিয়ন ডলার রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফান্ড বরাদ্দ থাকলেও নিউইয়র্কের হাসপাতালগুলো সেই অর্থ পাবে কি না-তা অনিশ্চিত।
খাদ্য সহায়তা প্রোগ্রাম স্ন্যাপের ক্ষেত্রেও এই আইন ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। এই প্রোগ্রামটি এতোদিন পুরোপুরি ফেডারেল সরকারের অর্থায়নে চলতো এবং দুই দল থেকেই রাজনৈতিক সমর্থন পেয়ে আসছিল। কিন্তু নতুন আইনে ২০২৭ সালের অক্টোবর থেকে রাজ্যগুলোকে স্ন্যাপ সুবিধার ১৫ শতাংশ ব্যয় নিজস্ব অর্থে বহন করতে বাধ্য করা হয়েছে। এর ফলে নিউইয়র্ক স্টেটের বাজেটে বছরে প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় যোগ হবে। অতিরিক্তভাবে, স্ন্যাপ প্রশাসনিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে ফেডারেল অংশীদারত্ব ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা রাজ্য ও স্থানীয় সরকারের ওপর আর্থিক চাপ আরো বাড়াবে। রাজ্য সরকারকে বছরে অতিরিক্ত প্রায় ৩৬ মিলিয়ন ডলার এবং কাউন্টি ও নিউইয়র্ক সিটিকে প্রায় ১৬৮ মিলিয়ন ডলার বহন করতে হবে। এসব ব্যয় ২০২৬ সালের বাজেটেই প্রতিফলিত হবে।
নতুন আইনটি আরো কঠোর ও প্রশাসনিকভাবে জটিল কাজের শর্তারোপ করেছে স্ন্যাপ সুবিধাপ্রাপ্তদের ওপর, যার ফলে প্রায় ৩ লাখ পরিবার স্ন্যাপ সুবিধা হারাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর ফলে তাদের গড়ে মাসিক ২২০ ডলার খাদ্য বাজেট কমে যাবে, যা নিম্ন-আয়ের পরিবারের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। স্ন্যাপ-এড নিউইয়র্ক প্রোগ্রাম, যা কম আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যকর খাবার নির্বাচন ও রান্নার কৌশল শেখানোর মাধ্যমে স্ন্যাপ সুবিধার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতো, তা-ও এই কাটা পড়ার শিকার হবে। এই প্রোগ্রামের জন্য নিউইয়র্ক বছরে ২৯ মিলিয়ন ডলার পেতো, যা রাজ্যের ১৮টি কমিউনিটিভিত্তিক সংস্থা পরিচালনা করতো। এই ফান্ড হারানোর ফলে খাদ্যনিরাপত্তা আরো সংকটাপন্ন হবে।
এছাড়া স্ন্যাপ সুবিধার অর্থ মূলত স্থানীয় মুদি দোকান, কৃষক বাজার ও ফার্ম স্ট্যান্ডে ব্যয় হয়, যার ফলে স্থানীয় অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়। ইউএসডিএর গবেষণায় দেখা গেছে, স্ন্যাপে প্রতি ১ ডলার খরচ করলে ১.৫৪ ডলার অর্থনৈতিক কার্যকলাপ তৈরি হয়। নিউইয়র্কে বছরে স্ন্যাপের মাধ্যমে প্রায় ৭.৪ বিলিয়ন ডলার বিতরণ হয়, যা থেকে ১১.৫ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। এই বরাদ্দ কমে গেলে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসা, কৃষক ও স্থানীয় খাদ্য সরবরাহ চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। গ্রামীণ অঞ্চলের মুদি দোকান বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমে আসবে এবং রাজ্য ও স্থানীয় অর্থনীতি আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। ফ্রেশ কানেক্ট প্রোগ্রামের মতো স্ন্যাপ ম্যাচিং প্রোগ্রামগুলোর ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে, যার মাধ্যমে কৃষকদের অতিরিক্ত আয় নিশ্চিত করা হতো।
সার্বিকভাবে রিপাবলিকানদের ‘বিগ আগলি বিল’ নিউইয়র্ক স্টেটের স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্যনিরাপত্তা এবং সামগ্রিক সমাজকল্যাণের ওপর এক ভয়ংকর আঘাত হানছে। গভর্নর হোচুল এই আইন সংশোধনের জন্য এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে সহায়তা প্রদানের জন্য রাজ্য আইনসভা ও কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে নিউইয়র্কবাসীর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো-এই সংকটের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করা এবং রাজ্যের স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বজায় রাখা। রাজ্য প্রশাসন বর্তমানে জনস্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ব্যবসার পাশে দাঁড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
আসন্ন বছরগুলোতে এই আইন ও তার প্রভাব সম্পর্কে গভীর মনিটরিং ও গবেষণার মাধ্যমে নিউইয়র্ক স্টেট সম্ভাব্য সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে, যাতে লাখ লাখ মানুষ আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার আওতায় ফিরে আসতে পারেন। গভর্নর হোচুলের নেতৃত্ব এবং স্টেট প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করছে নিউইয়র্কবাসীর ভবিষ্যৎ।
‘বিগ আগলি বিল’ যে কতটা গভীরভাবে জনস্বাস্থ্য, খাদনিরাপত্তা ও স্থানীয় অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে, তা এখন স্পষ্ট। এই সংকট থেকে নিউইয়র্ককে উত্তরণ করাতে রাজ্য সরকার ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই একমাত্র পথ।