নিউইয়র্ক সিটির ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার সাবওয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে পড়ে গুরুতর আহত হওয়া বাংলাদেশি যুবক মারুফ হোসেনকে গত ৩০ জুন ২২.৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিয়েছে ব্রঙ্কস কাউন্টির সিভিল কোর্টের একটি জুরি বোর্ড। আদালতে ১২ সদস্যের জুরি বোর্ড মামলার সকল তথ্যপ্রমাণ পর্যালোচনা করে গত ৩০ জুন রায় ঘোষণা করে। ২০১৭ সালের জুন মাসে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাইসাইকেল ডেলিভারি কর্মী মারুফ হোসেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে একটি রেস্তোরাঁয় ডেলিভারি দিতে যাওয়ার পথে পার্কচেস্টার সাবওয়ে স্টেশনের একটি ভাঙা ও বিপজ্জনক প্ল্যাটফর্মে হোঁচট খেয়ে তিনি ট্রেন লাইনে পড়ে যান। সেই মুহূর্তে একটি ট্রেন স্টেশনে ঢুকছিল এবং তা তার বাঁ-পায়ের পাঁচটি আঙুল কেটে দেয়। দুর্ঘটনার তীব্রতায় তার পেলভিসে ফ্র্যাকচার, হিপ ডিসলোকেশন, মেরুদণ্ডে ফাটল এবং মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে। এই দুর্ঘটনার ফলে তিনি সারা জীবনের জন্য সাধারণ চলাফেরায় অক্ষম হয়ে যান এবং বর্তমানে তাকে নিয়মিত চিকিৎসা ও পারিবারিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়।
এই ঘটনার ছয় মাস পর, মারুফ হোসেন নিউইয়র্ক সিটি ট্রানজিট অথরিটির (এমটিএ) বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, সাবওয়ে প্ল্যাটফর্মের রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতির জন্যই এই দুর্ঘটনা ঘটে। তার আইনজীবীর দাবি, যদিও মারুফ হোসেন শুরুতে ২০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন, তখন এমটিএ কেবল ১ লাখ ডলার অফার করে তাকে ভয় দেখিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করে। এমনকি আদালতে এমটিএ পক্ষের একজন কিশোরী প্রত্যক্ষদর্শী এবং একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী সাক্ষ্য দেন, মারুফ হোসেন আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে প্ল্যাটফর্ম থেকে লাফ দিয়েছিলেন। কিন্তু মারুফের হোসেনের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত মেডিকেল ও মনোবৈজ্ঞানিক প্রমাণ এবং তার সোজাসাপটা বক্তব্য-আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করিনি, আমি জীবনে খুশি ছিলাম। এসব তথ্য জুরি বোর্ডকে প্রভাবিত করে। এক মনোবিজ্ঞানীর মতে, দুর্ঘটনার তিনদিন পর হাসপাতালে করা পরীক্ষা থেকে দেখা যায়, মারুফ হোসেন মানসিকভাবে সুস্থ, তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা নেই এবং তিনি রোজা পালনরত অবস্থায় ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত ২০২৫ সালের জুলাইয়ে জুরি বোর্ড মারুফ হোসেনের পক্ষে রায় দিয়ে তাকে ২২.৭৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। প্রতি আঙুলের জন্য আনুমানিক ৪.৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ ধরা হয়, যা এমটিএর ইতিহাসে অন্যতম বড় ‘নিউক্লিয়ার ভেরডিক্ট’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মারুফ হোসেন এই রায়ের পর বলেন, ট্রানজিট অথরিটি আমাকে ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু সত্য শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। তার আইনজীবী দাবি করেন, এমটিএ ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরি করে তাকে দোষী প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু জুরি বোর্ড সেই ফাঁদে পড়েনি। বর্তমানে মারুফ হোসেন একজন মার্কিন নাগরিক।
মামলায় মারুফ হোসেন দাবি করেন, নিউইয়র্ক সিটির পরিবহন সংস্থা এমটিএ প্রথমদিকে তাকে মাত্র এক লাখ ডলারের একটি ক্ষুদ্র ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিল এবং তাকে ভয় দেখিয়ে সেটিতে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জুরি বোর্ড এমটিএর এমন কৌশল প্রত্যাখ্যান করে মারুফ হোসেনকে তার প্রাপ্য ন্যায্যতা দেয়। মারুফ হোসেন বলেন, জুরি বোর্ড তাদের মিথ্যাচার বুঝে ফেলেছে এবং আমাকে একটি স্বাভাবিক জীবনের দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে। মারুফের আইনজীবী নিক লিয়াকাস বলেন, এই রায় কেবল তার মক্কেলের জন্য বিজয় নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে-আর বড় কর্পোরেশনগুলো আইনি কৌশল ও কালক্ষেপণের মাধ্যমে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবে না।
এমটিএ আদালতে দাবি করেছিল যে মারুফ আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন এবং যে স্থানে তিনি পড়ে যান সেটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল না। এমটিএ পক্ষের এক কিশোরী সাক্ষী বলেন, তিনি মারুফকে ‘লাফ দিতে’ দেখেছেন। তবে মারুফের আইনজীবীর দাবি, সেই সাক্ষ্য এমটিএ নিজেরাই তৈরি করে ‘স্বতন্ত্র’ দাবি করেছিল। মারুফের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার কোনো অতীত রেকর্ড বা মানসিক সমস্যার কোনো প্রমাণ আদালতে পাওয়া যায়নি। রায় এখনো চ্যালেঞ্জ বা আপিলের মুখে পড়তে পারে। এমটিএর একজন মুখপাত্র বলেছেন, আমরা রায় পর্যালোচনা করছি এবং সব ধরনের আইনি বিকল্প বিবেচনা করছি।