৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:০৩:৫৫ পূর্বাহ্ন


উঁচু ভবনের চাপ বহনের ক্ষমতা ঢাকা শহরের নেই
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৯-২০২৫
উঁচু ভবনের চাপ বহনের ক্ষমতা ঢাকা শহরের নেই প্রতীকী ছবি


আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির কাছে সরকার রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় ভবন নির্মাণে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) বাড়ানোর সাম্প্রতিক উদ্যোগ ঢাকা মহানগরীর বাসযোগ্যতা ও সামগ্রিক পরিবেশকে আরও হুমকিতে ফেলবে। পরিকল্পনাবিদসহ বিভিন্ন সামাজিক, পরিবেশবাদী, পেশাজীবী ও নাগরিক সংগঠনের মতামত ও দাবিকে উপেক্ষা করেই সরকার এই সংশোধনের পথে হাঁটছে। এর ফলে জনবহুল ঢাকা শহরে উঁচু ভবনের সংখ্যা বাড়বে এবং ইতিমধ্যে স্থবির হয়ে যাওয়া শহরে পরিবহন, পরিসেবা-সহ সকল ধরনের নাগরিক সেবার উপর অসহনীয় চাপ পড়বে। এই চাপ বহন করবার ক্ষমতা এই শহরের নেই। 

এসব মতামত উঠে আসে সম্প্রতি বিআইপি’র কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত “ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের উদ্যোগঃ বিআইপি’র পর্যবেক্ষণ” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে। 

বিআইপির সহ সভাপতি পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিনের সঞ্চালনায়, ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের উদ্যোগ সংক্রান্ত বিআইপির পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনাসমূহ তুলে ধরেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-র সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

এতে আরো বলা হয় এই ধরনের উদ্যোগ কেন্দ্রীয় ঢাকা মহানগরীর বাসযোগ্যতাকেও একেবারে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। আবাসিক এলাকার ভবনসমূহের ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে ভবনের উচ্চতার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করতে হবে। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সরু রাস্তার পাশে বহুতল ভবন নির্মাণ অনুমোদন বন্ধ করতে হবে। এছাড়া ছয়তলার উপরের ভবনকে বহুতল ভবন বিবেচনায় নিয়ে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার সংশোধনী এনে ভবনে অগ্নি নিরাপত্তামূলক প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পনা প্রণয়নে স্বার্থ সংশি¬ষ্ট মহলের অনৈতিক প্রভাবকে দূর করে পরিকল্পনাবিদদের স্বাধীনভাবে কাজ করবার সুযোগ না দিলে শহরকে বাসযোগ্য করা এবং পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। 

এতে অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০২২ সালে গেজেট আকারে প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ ও টেকসই নগরায়ণের জন্য এলাকাভিত্তিক এফএআর মান নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ী ও স্বার্থ সংশি¬ষ্ট মহলের চাপের কারণে বারবার ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, যা ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে বড় বাধা। তিনি আরোও বলেন, ড্যাপ এর সাম্প্রতিক প্রস্তাবনায় অধিকাংশ এলাকায় এফএআর ২০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর ফলে নির্দিষ্ট এলাকায় অতিরিক্ত তলা নির্মাণের অনুমতি মিলবে, যা যানজট, জলাবদ্ধতা, আলো-বাতাস সংকট ও ইউটিলিটি সেবায় মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করবে। খিলক্ষেত, বাড্ডা, বাসাবো-খিলগাঁও, রামপুরা ও মিরপুরসহ অনেক এলাকায় এফএআর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, অথচ পরিকল্পনাবিদদের দাবিকে উপেক্ষা করে গুলশান-বনানী ও ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকায় সামান্য কমানো হয়েছে মাত্র। এতে ফার মানের বৈষম্য আবারও জিইয়ে রাখা হয়েছে এবং প¬ট মালিকদের অনার্জিত আয় বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে বিআইপি সহ অনেক পরিবেশবাদী সংগঠনের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী কৃষিজমি, জলাভূমি ও বন্যা প্রবাহ এলাকায় উন্নয়ন বন্ধের সুপারিশকে তিনি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে উলে¬খ করেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, ইতোমধ্যেই দুই কোটির বেশি মানুষের চাপের মধ্যে থাকা ঢাকার জন্য এই ধরনের সংশোধনী টেকসই উন্নয়নকে আরও বিপন্ন করবে। ড্যাপের মূল উদ্দেশ্য ছিল সুষম জনঘনত্ব ও মানসম্মত নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা, কিন্তু বর্তমান সংশোধনী সেই উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তিনি আরোও উলে¬খ করেন ২০২৫ সালের ১৮ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ড্যাপ ও ইমারত বিধিমালা পরিবর্তনের প্রভাব ও নাগরিক করণীয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। 

সংবাদ সম্মেলনটি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)সহ ১৫টিরও বেশি নাগরিক ও পেশাজীবী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছিল। তৎপরবর্তীকালে ড্যাপ নিয়ে উপরোক্ত সংগঠনসমূহের লিখিত সুপারিশ ও দাবি-দাওয়া গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এসকল দাবি-দাওয়ার কোন প্রতিফলন দেখা যায়নি ড্যাপের সংশোধনের উদ্যোগে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের ও হতাশার। 

বিআইপির সহ সভাপতি পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ড্যাপ পুনরায় সংশোধনের ক্ষেত্রে জনস্বার্থের পরিবর্তে ক্ষমতাশালীদের স্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে। শহরের উচ্চ জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক নীতি ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা মিলিত হয়ে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নই কেবল গুরুত্ব পাচ্ছে । 

সংবাদ সম্মেলনে বিআইপির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ড্যাপে এলাকাভিত্তিক নাগরিক সুবিধাদি যথা স্কুল, হাসপাতাল, পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতির যে প্রস্তাবনা দেয়া আছে, সেগুলোর বাস্তবায়নের রাজউক, সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারি সংস্থাসমূহকে অতি দ্রুত এলাকাভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নে আবাসন ব্যবসায়ীসহ স্বার্থের সংঘাত আছে, এমন কাউকেই অন্তর্ভূক্ত করা যাবে না। বিগত সময়ে গোষ্ঠীস্বার্থে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পরিকল্পনায় যেসকল পরিবর্তন করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক সঠিক তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 

পরিকল্পনা, ইমারত নির্মাণ, উন্নয়ন, পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সংশোধন প্রক্রিয়ায় স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবের বিষয়ে তদন্তপূর্বক আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর ব্যবস্থা গ্রহণ। দেশের পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন এবং মহাপরিকল্পনাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা ও আইনের বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সম্পৃক্ত আবাসন ব্যবসায়ী, শিল্প কারখানার মালিক, রাজনীতিবিদ, আমলা, স্বার্থসংশ্লিষ্ট পেশাজীবি, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি সংস্থাসমূহের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে ও পুনর্মূল্যায়নে শহরের বাসযোগ্যতা, ধারণক্ষমতা, নাগরিক সুবিধাদির সুষম বন্টন, এলাকাভিত্তিক সাম্য, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জলাশয়-জলাধার, কৃষিভূমি-জলাধার রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিআইপির বোর্ড সদস্য পরিকল্পনাবিদ আবু নাইম সোহাগ এবং পরিকল্পনাবিদ মোঃ ফাহিম আবেদীন।

শেয়ার করুন